মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্পের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৭ এএম


বর্তমান সরকার তার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বিদ্যুতের চাহিদা ও ঘাটতি পূরণে জ্বালানি তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্যয়বহুল এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে তখন বিশেষজ্ঞরা বেশ সমালোচনা করেন। এর বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। সরকার বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে ব্যয়বহুল হলেও তা থেকে সরে আসেনি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে তিন বছর, পাঁচ বছর ও ১৫ বছর মেয়াদি যেসব তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অধিক মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে, চুক্তির মেয়াদ শেষে এসব কেন্দ্রের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নিচ্ছে বলে জানা গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানিসহ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট। এই ১০ বছরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হয়েছে ১০০টির বেশি। তবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগই ব্যয়বহুল জ্বালানি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক। এর মধ্যে ৬৭টি ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই ভাড়াভিত্তিক ও ব্যক্তি খাতের। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে সাত-আট গুণ বেশি। ফলে জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সংস্থাটি সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে কিছু শর্তসাপেক্ষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেবে।
বিদ্যুতের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। গ্রামের লোকজনও এখন বিদ্যুৎ ছাড়া জীবনযাপনের কথা চিন্তা করতে পারে না। আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিক কেন্দ্র থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। এই অপরিসীম চাহিদা পূরণে সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপৎকালীন চাহিদা পূরণে সরকার তড়িঘড়ি করে জ্বালানিভিত্তিক ব্যয়বহুল রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলেও তা এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে চাহিদা মিটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা যে আশঙ্কা করেছিলেন তাই হয়েছে। একদিকে দুর্নীতির অভিযোগ, অন্যদিকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারকে লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তখন বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, বেসরকারি খাতের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে বিদ্যমান সরকারি যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদনসক্ষমতা বাড়ালে লোকসান কম হতো। দেরিতে হলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নতুন করে তেলভিত্তিক এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্যুতের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় শক্তির উৎপাদন সাশ্রয়ী প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের পরিকল্পনার বিকল্প নেই। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিদ্যুতের ক্রমাগত চাহিদা বাড়বে, এটা অবশম্ভাবী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি খাতসহ শিল্পকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এদিক বিবেচনা করে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাশ্রয়ী ও বিকল্প চিন্তা করতে হবে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধানতম শক্তি প্রাকৃতিক গ্যাস। এই গ্যাসের মজুদও দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। স্থলভাগে যে পরিমাণ গ্যাস রয়েছে, তার যথাযথ মজুদ এবং অনুসন্ধান করে উৎপাদন করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্যদিকে সাগরে গ্যাস খোঁজার জন্য বিশ্লেষকরা তাকিদ দিলেও কারিগরি সক্ষমতার অভাবে তা অনুসন্ধান করে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও সংকটে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে, বিশ্লেষকরা বিদ্যুতের বিকল্প উপায়ের উপর তাকিদ দিয়েছেন। আমাদের দেশে ইতোমধ্যে সোলার এনার্জি বা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি ধীরে হলেও শুরু হয়েছে। এ খাতটিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগিয়ে নেয়া দরকার। এটি পরিবেশ বান্ধবও। বায়ু চালিত উইন্ডমিলের মাধ্যমেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশে এ ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। জিওথারমাল বা ভূগর্ভস্থ পাথর ও পানিকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। বিশ্বের অনেক দেশেই সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। শহরে উৎপাদিত বর্জ্য থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এসব বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী। যেহেতু আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে এবং তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যয়সাপেক্ষ, তাই বিদ্যুতের উৎপাদন ও চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন বিকল্প প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে।
বর্তমান সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। গ্রামকে শহরে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ প্রতিশ্রুতি পূরণে অবশম্ভাবীভাবেই বিদ্যুতের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ছাড়া গ্রামকে শহরে পরিণত করা যাবে না। কাজেই সরকারকে অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সাশ্রয়ী ও বিকল্প পদ্ধতিতে কীভাবে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, তা চিন্তা করতে হবে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি কিংবা আমদানি করে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাশ্রয়ী প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। এছাড়া উৎপাদিত বিদ্যুতের অপচয় এবং চুরির বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেখা যায় যে, উৎপাদিত বিদ্যুতের উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। সিস্টেম লস, সঞ্চালন লাইন বা বিতরণ ত্রুটির কারণেও বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। এসব অনিয়ম দূর করার ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন