বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রয়োজন গণসচেতনতা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

পৃথিবী জুড়েই ডায়াবেটিস বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মহামারি আকারে এর বিস্তার ঘটছে। শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ক্যালরিবহুল ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় গ্রহণের অভ্যাস গড়ে ওঠায় মানুষের মধ্যে মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর এ ধরনের লোকদেরই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ডায়াবেটিস প্রধানত দু’ ধরনের- টাইপ-১ ও টাইপ-২। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৯৫ শতাংশ। আগে মানুষের জানা ছিল না যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বহুলাংশে প্রতিরোধ করা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, খাদ্যাভ্যাস ও জীবন-যাপন পদ্ধতির উন্নয়ন ও শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানোর মাধ্যমে শতকরা ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন গণ-সচেতনতা। আর মহামারি আকারে ধেয়ে আসা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় নীতিমালা থাকা আবশ্যক।
যথাসময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যক। (১) নিরাপদ আয়ূ বৃদ্ধি, (২) জীবন যাত্রার মনোনয়নের স্বার্থে এবং (৩) সমাজে চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি রোধকল্পে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধকল্পে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশন এর এপিডেমিওলজি এন্ড প্রিভেনশন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ২০০৬ সালে বার্সেলোনাতে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অন পেডিয়াট্রিকস এন্ড মেটাবলিক সিনড্রোম শীর্ষক একটি ঐক্যমত প্রতিষ্ঠাধর্মী কর্মশালার আয়োজন করে। এ কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল উন্নত ও অনুন্নত দেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধকল্পে কার্যকর কর্মপন্থার সুপারিশ গ্রহণ করা। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের বিষয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেখানেও অন্যতম অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধকল্পে আইডিএফ এর সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে দুটি টার্গেট গ্রুপের ঝুঁকি প্রতিরোধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণ (১) যারা বেশি ঝুঁকিতে এবং (২) ঝুঁকি নির্বিশেষে সকল জনগণ। উভয় গ্রুপকে বিবেচনায় এনে উন্নয়নশীল দেশে ‘জাতীয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ পরিকল্পনা’ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় জীবনযাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস ও আচার আচরণ ও সংস্কৃতিকে বিবেচনায় নিয়েই জাতীয় প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছ। যাদের ঝুঁকি বেশি তাদের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছ তিন ধরনের পদক্ষেপ। পদক্ষেপ-১: ডায়াবেটিস রোগী শনাক্তকরণ- পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যারা ডায়াবেটিসের বেশি ঝুঁকিতে আছে তাদের চিহ্নিত করা। চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট এবং নিজে নিজে পরীক্ষার মাধ্যমে এ গ্রুপ চিহ্নিত করার কাজ চলবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস জরংশ Assessment Form এ যে Parctical এবং Non-invasive প্রশ্নমালা দেয়া আছে তা পূরণ করেও তা বের করা যেতে পারে। এ ফর্মে বয়স, কোমরের মাপ, পরিবারের ইতিহাস, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা, দেহে পরিপাক প্রক্রিয়ার অবস্থা এবং ঔষধ সেবনের বিবরণ থেকে ডায়াবেটিস রোগী সনাক্ত করা যায়। পদক্ষেপ-২: ঝুঁকির পরিমাণ পরিমাপ। যারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন তাদের ঝুঁকির পরিমাণ কত সেটা নির্ণয় করতে একজন স্বাস্থ্যকর্মী কর্তৃক সতর্কতা সহকারে ঐ লোকের প্লাজমা গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। এটা শুধুমাত্র IGF এবং IGT করলেই হবে না তার সাথে অন্যান্য লক্ষণগুলো পরীক্ষা যেমন Lipid profile Selectrolytes করতে হবে। IGF এবং IGTথাকলে ডায়াবেটিস টাইপ-২ বৃদ্ধির প্রকোপ থাকে বেশি এটা ঠিক, কিন্তু অন্যান্য বিষয়গুলো পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিসকে ঠেকানো বা এ রোগে আক্রান্ত হওয়া দেরী করার ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়।
পদক্ষেপ-৩: টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধকল্পে পদক্ষেপসমূহ: ১) বিভিন্ন পরীক্ষা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে জীবন যাপন প্রণালীতে পরিবর্তন এনে, মোটামোটি মাঝারী মাপের দৈহিক অবস্থা-ওজন বজায় রেখে এবং নিয়মিত শরীরচর্চায় টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সহজতর হয়। ২) বিশেষ করে অধিক স্থূলতা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য বেশি ঝুঁকি বহুল। স্থূলতার স্থলে শরীরের ওজন কম হলে দেহে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধিপায়, হাইপার গøাসিমিয়া ও ডাই¯িøপিডিমিয়ার ঝুঁকি কমে যায় এবং হাইপারটেনশন হ্রাস পায়। যারা অতিকায় স্থূল তাদের উচিত ওজন কমিয়ে স্বাভাবিক ওজন মাত্রায় ফিরে আসা। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ মাত্রায় স্বাভাবিক ওজনের যে ওজন চার্ট দেয়া আছে তার থেকে কমবেশি ৫-৭% এর মধ্যে ওজন সীমিত থাকা আবশ্যক। ৩) ওজন কমানোসহ সকল ব্যাপারে শরীরচর্চা বিশেষ দরকার। নিয়মিত শরীরচর্চা সার্বিক শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। শরীরচর্চায় যাদের ইনসুলিনের প্লাজমা লেবেল বেশি তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটায় এবং রক্তচাপ কমায়। এছাড়া শরীরচর্চা শরীরের টিস্যু, মেটাবলিক অবস্থাকে সচল করে এবং হৃদস্পন্দন অবস্থার উন্নতি ঘটায়। পর্যাপ্ত শরীরচর্চা টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি যথেষ্ট কমিয়ে দেয়। আইডিএফ এর সুপারিশ হলো সপ্তাহের অধিকাংশ দিনে দৈনিক ন্যূনতম ৩০ মিনিট স্বাভাবিক শরীরচর্চায় (হাঁটা, সাতার, নাচ, সাইকেলিং) ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ কমিয়ে থাকে। ৪) এমন কিছু লোক যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তারা সহজে এ জীবন যাত্রা প্রণালীতে পরিবর্তন আনতে পারে না। আইডিএফ এর সুপারিশে ডাই¯িøপিডিমিয়া বেশি হলে শুধু ওজন কমিয়ে গøুকোজ টলারেন্স অবস্থা উন্নতি ঘটানো যায়। এ রকম ক্ষেত্রে গবঃভড়ৎসরহ এর ২৫০-৮৫০ মি. গ্রাম সেবন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সহায়ক হতে পারে।
বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের আক্রমণ থেকে রক্ষাকল্পে আইডিএফ একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস একটি নীরব প্রকৃতির অসংক্রামক রোগ যা মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে। সুতরাং সহজসাধ্য বা চটজলদি কোন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে জনস্বাস্থ্য সেবায় পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় ধৈর্যের সাথে, নিয়ম শৃঙ্খলা অবলম্বনের মাধ্যমে এ প্রয়াস চালাতে হবে। যে সমাজে অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন ব্যবস্থা বিদ্যমান সেখানে শুধু শিক্ষা ও তথ্য বিনিময় দিয়ে কাজ হবে না। সেখানে বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে পরিবেশ এবং সুস্থ্য স্বাস্থ্যকর সুষ্ঠু খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাসহ একটি উন্নত জীবন যাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আইডিএফ এর অভিমত শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট কর্ম পদ্ধতির দ্বারা টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। জীবন যাপনে অনুষঙ্গ হিসেবে অন্যান্য ব্যবস্থায় যেমন খাদ্য উৎপাদনকারী, প্রক্রিয়াকরণকারী, বাজারজাতকারী, খুচরা ব্যবসায়ী এবং হোটেল রেস্তোরাঁ ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের সকলেরই যথাসচেতন সংস্কার ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ থেকেই যায়। এরা সবাই এ খাদ্যে শক্তি ও চর্বি বা ডায়াবেটিসের জন্য হুমকি স্বরূপ খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী। এ নিরিখে আইডিএফ প্রতিটি দেশে নিজ নিজ জাতীয় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে আসছে। জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে প্রতিরোধ ভাবনা সম্পর্কে পরিচালিত সমীক্ষার ভিত্তিতে আইডিএফ এর মুখ্য সুপারিশ হচ্ছে: ১. সপ্তাহের অধিকাংশ দিনে দৈনিক ন্যূনতম ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করা। হাঁটার জন্য প্রত্যেকেরই উৎসাহিত করা উচিত। ২. প্রত্যেকেরই সুষম ওজন মাত্রায় থাকতে উৎসাহিত করা। ৩. বয়স্কদের নির্ধারিত ওজন মাত্রায় শতকরা ৫-১০ ভাগ কম বেশি সীমার মধ্যে সীমিত রাখা। ৪. শিশুদের শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তার ওজন ঠিক রাখা। ৫. উন্নত ও অনুন্নত বিশ্ব নির্বিশেষে নিজ নিজ সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে লাইফ স্টাইল মেনটেইনের নীতিমালা গ্রহণ এবং শরীর স্বাস্থ্য, ওজন ও খাদ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও বিশ্বাস অবলম্বন করে কার্যকর পদক্ষেপ নির্ধারণ করা।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও নির্বাহী সদস্য, ডায়াবেটিক এসেসিয়েশন, সিলেট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন