শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডির বাস্তবতা এবং উন্নয়নের দ্বৈরথ

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীর গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম মাইল ফলক। এই মাসে আমরা হৃদয়ের আবেগ ও ভালবাসা নিঙড়ে ভাষাশহীদদের স্মরণ করি। বাংলাভাষার চর্চা ও প্রচলন বৃদ্ধির তাগিদ অনুভব করি। একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ার কারণে এই মাসে আমরা বিশ্বের বিপন্নপ্রায় সব ভাষাভাষি মানুষের প্রতি আন্তরিক মমত্ব অনুভব করি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সালাম-বরকত, রফিক-জব্বারের আত্মাহুতি দানের স্মৃতি বিজড়িত এই মাসে কেন একের পর এক নতুন ট্রাজেডির জন্ম হচ্ছে? ২০০৯ সালের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারীতে পিলখানায় বিডিআর হেডকোয়ার্টারে তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের ছদ্মাবরণে জাতির নিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ ৫৭জন সেনা কর্মকর্তার নির্মম হত্যাকান্ডের পর ভাষা আন্দোলনের শহীদদের পাশাপাশি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা মানুষের মধ্যে একটি দগদগে ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি করেছে। তবে এই ঘটনা নিয়ে কেমন যেন একটা লুকোচুরি হচ্ছে, বায়ান্ন সালে পরাধীন বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে ৫-৬জন তরুনের প্রাণহানির ঘটনাকে আমরা যেভাবে মহিমান্বিত করেছি, যেভাবে তাদের স্মরণ করছি, ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও শুদ্ধভাবে বাংলাভাষা র্চ্চার শপথ নিচ্ছি, নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা ও অসন্তোষ প্রকাশ করছি, তা ভাবতেও ভাল লাগে। ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৬০ বছর পরেও যখন এ দেশের তরুনরা সুদুর কানাডা থেকে ভাষা শহীদদের কথা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবী জানিয়ে ইউনেস্কোর কাছ থেকে তা আদায় করে নিতে সক্ষম হল তখন আমার মনে হয়, ওই যে বলা হয়, বাঙ্গালী আত্মভোলা জাতি, ইতিহাস সম্পর্কে অসচেতন ইত্যাদি অপবাদগুলো মিথ্যা। পরক্ষণে যখন দেখি ৫-১০জন নয়, ৫৭জন সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় এক ধরণের মৌণতা, আলোচনায় অনীহা ও লুকোচুরির ধারাবাহিক প্রবণতা লক্ষ্য করি তখন আর হিসাব মিলাতে পারি না। বিডিআর গণহত্যার পর থেকে এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে লক্ষ্যনীয় ছিল। কোনো বিষয়ে অতিরঞ্জণ অথবা মিথ্যা আরোপ যেমন কাম্য নয়, কোনো সত্যকে আড়াল করার প্রয়াসও সমর্থনযোগ্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ে কোথায় যেন একটা সেন্সরশিপ চালু হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হওয়ার পর থেকে নানাক্ষেত্রে সেই সেল্ফ সেন্সরশিপের মাত্রাটা যেন আরো বেড়ে গেছে। মানুষ অনেক কিছু বলতে বলতে চায়, অনেক কিছু দেখতে চায়, অনেক কিছু করতে চায়, তবে রাজনৈতিক কারণে সে পথ অনেকটাই রুদ্ধ। যখন তখন যে কেউ গুম হয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর থানা পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব প্রথমে তা অস্বীকার করেছে, অত:পর স্বীকার করে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়েছে অথবা দূরবর্তি কোনো স্থানে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কারা এসব করছে? নারায়নগঞ্জের ৭ খুনের ঘটনা দিয়ে সব ঘটনাকে জাস্টিফাই করা যাচ্ছে না। তারা কি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিপথগামী অংশ. নাকি রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির এজেন্ট তাও স্পষ্ট নয়। যে কারণেই এসব ঘটুক বিষয়টি সামগ্রিকভাবে জননিরাপত্তার। অতএব মানুষ তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশার কথা, অভিযোগ অনুযোগ, ক্ষোভের কথা, অধিকারের বলাও নিরাপদ মনে করে না। অতএব মৌনতাকে নিরাপদ পন্থা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।
মানুষ শুধু উন্নয়নের কথা শুনছে, উন্নয়নের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। উন্নয়নের মহাসরনীতে অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না। উন্নয়ন কি শুধু ইট-পাথরের শহরে জৌলুস বাড়ানো ? রাস্তায় উড়াল পথ নির্মান, নদীর উপর সেতু নির্মান, আর পরীসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে মানুষের গড় আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন? কিছু মানুষ কি সত্যিই উন্নয়নের বিরোধী? গণতন্ত্রের সাথে কি উন্নয়নের কোনো বিরোধ আছে? সাম্প্রতিক সময়ে যে টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তার সাথে গতানুগতিক উন্নয়ন ধারণার তফাৎ কি? এই উন্নয়ন কি শান্তি ও নিরাপত্তার অন্তরায় বা সাংর্ঘষিক? এসব উন্নয়ন কি উন্নয়নের প্রকৃত লক্ষ্যকে বিভ্রান্ত করছে? আমরা কি উন্নয়নের পথে আছি নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি? এসব প্রশ্ন হঠাৎ করেই উদিত হয়নি। বিদ্যমান বাস্তবতায় দীর্ঘদিন ধরেই সচেতন মানুষের মধ্যে এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। একুশের প্রথম প্রহরে পুরো জাতির চোখ যখন ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে, ঠিক সে সময় পুরনো ঢাকায় চকবাজারের চুরিহাট্টায় ভয়াবহ, হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক অগ্নিবিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে, শহীদ মিনারে ভিআইপিদের আগমন ও যাতায়াত নিরাপদ করতে আশপাশের রাস্তাগুলো সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেয়ায় অন্যান্য রাস্তায় যানজট লেগে যায়। এতে চুড়িহাট্টার অগ্নিকান্ডের আগুন নিভাতে ও উদ্ধার কাজ পরিচালনায় ফায়ার ব্রিগেডসহ সাধারণ উদ্ধারকর্মীরা সেখানে পৌঁছতে অনেক বেশী সময় লেগে যাওয়ার কারণে অনেক বেশী সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশী হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য এবং চকবাজারের ব্যবসায়ীদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন মন্তব্য করেছেন। রাত ১০ টায় আগুন লাগার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয়। ঘটনার চারদিন পর ২৫ ফেব্রয়ারী একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালন করা হলেও ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে শহীদ মিনারকে ঘিরে ভিআইপি প্রটৌকল কিন্তু স্থগিত করা হয়নি। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন বন্ধ করতে কেউ বলছে না, শুধুমাত্র ভিআইপি প্রটোকল স্থগিত করে শহীদ মিনারসহ পুরান ঢাকার সব রাস্তা সাধারণের জন্য খুলে দেয়া হলে অগ্নি নির্বাপন ও উদ্ধার কাজ এবং সাধারণ মানুষের যাতায়াত সহজ হত। প্রায় ১৫ দিন পরে অনুষ্ঠিতব্য ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কারণে গত বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ স্থগিত করা হয়েছিল। এ নিয়ে কোনো আলোচনা সমালোচনা হয়নি। কেউ মাইন্ড করেছে বলেও মনে হয়নি। তবে ২০ ফেব্রুয়ারী চকবাজার চুরিহাট্টা অগ্নিকান্ডে শত শত মানুষ হতাহত হওয়ার পর এ নিয়ে নির্লজ্জ রাজনৈতিক ব্লেইম গেম দেখা গেছে। ইতিপূর্বে ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরনো ঢাকার নিমতলিতে প্রায় একই ধরনের অগ্নিকান্ডে অন্তত ১২৪জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। অগ্নিকান্ড ভয়াবহ রূপ নেয়ার জন্য অবৈধভাবে উচ্চমাত্রার দাহ্য কেমিকেল গুদাম গড়ে তোলা এবং পুরনো ঢাকার অনিরাপদ পরিবেশকে দায়ী করা হয়েছিল। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াসহ ঘটনার কারণ উৎঘাটন এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে তাৎক্ষনিক তদন্ত কমিটি গঠন এবং নিমতলি অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বহুমাত্রিক আলোচনা ও মিডিয়া কভারেজ দেখা গিয়েছিল। সরকারের সংশ্লিষ্টদের নানা রকম প্রতিশ্রুতি, তদন্ত কমিটির সুপারিশ, স্থানীয় ও বিশেষজ্ঞ মতামতের অন্যতম একটি দাবী ও প্রয়োজনীয়তা ছিল, পুরনো ঢাকা থেকে কেমিকেল গুদাম সরিয়ে চামড়া শিল্প নগরীর মত একটি স্বতন্ত্র, নিরাপদ রাসায়নিক পল্লী গড়ে তোলা। ২০১০ সালের ৩রা জুন নিমতলির অগ্নিকান্ডের পর রাসায়নিক পল্লী গড়ে তোলার প্রকল্প গ্রহণে সরকার খুব বেশী সময় ব্যয় না করলেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব বেশী আগ্রহ ছিল বলে মনে হয়না। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ২০১০ সালের পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু প্রকল্পসহ দেশে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও মাত্র ২০০ কোটি টাকার রাসায়নিক পল্লী প্রতিষ্ঠার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার।
প্রায় এক দশক আগে ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সাতান্ন জন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যু পুরো জাতিকে স্তম্ভিবত করেছিল। এই ঘটনার পেছনের কাহিনী নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ নানাবিধ ব্লেইম গেমও কম হয়নি। এর দেড় বছরের মাথায় নিমতলি অগ্নিকান্ডে শতাধিক মানুষের করুণ মৃত্যু পুরো জাতিকে মর্মাহত করেছিল। জাতির এই আবেগকে মূল্য দিয়ে সরকার তাৎক্ষনিকভাবেই পুরনো ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিক পর্দাথের গুদাম সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ জারি করে। সেই সাথে বিশেষজ্ঞ পরামর্শে ঢাকার অদূরে কোনো একটি নিরাপদ স্থানে পরিকল্পিতভাবে একটি রাসায়নিক পল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রথমে কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা এলাকায় একটি বহুতল রাসায়নিক পল্লী গড়ে তোলার সম্ভাব্য প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। মূলত ব্যবসাসায়ীদের উপর এই প্রকল্প ব্যয় বহনের ভার চাপিয়ে দেয়া এবং দাহ্য রাসায়নিক পণ্যের গুদাম ও কারখানার জন্য বহুতল ভবন নির্মানের পরিকল্পনায় দ্বিমত পোষণের কারণে সেই প্রকল্প নাকচ হয়ে যায়। অবশেষে গত বছরের অক্টোবরে একনেকে এই প্রকল্পের জন্য ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও চলতি অর্থবছরের জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে এই প্রকল্পের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি বলে জানা যায়। এ প্রসঙ্গে আমরা বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ, বায়োলজিক্যাল মৃত্যু, পরিবেশবাদি আন্দোলন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং হাজারিবাগ থেকে টেনারিশিল্প স্থানান্তরে ১৫ বছরের গড়িমসি ও শম্বুক গতির কথা স্মরণ করতে পারি। নিমতলিতে রান্নার স্টোভ থেকে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকান্ডে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর পুরনো ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরিয়ে নেয়ার দাবী ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই একটি স্বতন্ত্র রাসায়নিক পল্লী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আরেকটি ভয়াবহ মমার্ন্তিক ট্রাজেডি সংঘটিত হওয়ার আগপর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তাবায়নে সরকারের তেমন কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। বিশ ফেব্রুয়ারী চকবাজার ট্রাজেডির পর এই রাসায়নিক পল্লী বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে কিছুটা তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে, তবে এই ত্রস্ত অবস্থা কয়দিন থাকে তাই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে মানুষের নজর ভিন্নদিকে প্রবাহিত হয়েছে। বিডিআর গণহত্যা ট্রাজেডির কারণে ২৫ ফেব্রুয়ারী তারিখটি এমনিতেই শোকাবহ। সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারী চকবাজার ট্রাজেডির জন্য জাতীয় শোক ঘোষনা করেছিল। এর আগের দিন ঘটে গেল আরেক নাটকীয় ঘটনা। বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিজি-১৪৭ ফ্লাইটে একজন অস্ত্রধারি যুবকের অবস্থান এবং কথিত হাইজ্যাক চেষ্টার রোমাঞ্চর ঘটনাটি শেষ হয়েছে চট্টগ্রামে জরুরী অবতরণ, কমান্ডো অভিযান এবং অস্ত্রধারি যুবকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। যুবকের মৃত্যুর পর জানা গেছে উক্ত যুবকের কাছে থাকা কথিত অস্ত্রটি আসলে খেলনা পিস্তল। কথিত সন্ত্রাসী পলাশের(‘মাহাদি’!) মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উক্ত যুবকের এই হাইজ্যাক প্রচেষ্টার নেপথ্যের আসল কাহিনীটি জানার সুযোগ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেল। তবে পুরো জাতির মনোযোগ এই শ্বাসরুদ্ধকর বিমান হাইজ্যাক এবং কম্যান্ডো অভিযানের ঘটনার সাথে চাঞ্চল্যকরভাবে যুক্ত হয়ে পড়ায় ২৫ তারিখের সব গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম ছিল এটি। সেখানে পিলখানা ট্রাজেডির স্মৃতি তর্পণ অথবা সদ্য ঘটে যাওয়া চকবাজার ট্রাজেডির আলোচনায় ছেদ টানতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। মাত্র দু’ ঘন্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ! অভিযান পরিচালনাকারী বাহিনীর সদস্যরা তো বাহবা পেতেই পারে। তবে খেলনা পিস্তলধারি একজন যুবককে জীবিত ধরে ঘটনার রহস্য উৎঘাটন করার মত দক্ষতা আমাদের এইসব বাহিনীর সদস্যদের নেই, এমনটা আমরা বিশ্বাস করতে পারিনা।
সোমবার ২৫ ফেব্রুয়ারী বিমান হাইজ্যাক ঘটনাটি ছিল সংবাদপত্রের মূল শিরোনাম এবং দেশব্যাপী আলোচনার বিষয় ছিল। সেই সাথে বিশেষ গুরুত্বের সাথে শিরোনাম হয়েছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল বা সুরঙ্গপথ নির্মান এবং লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের সংবাদ। প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের সুধি সমাবেশে বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী ফ্লাইটে অস্ত্রধারী যুবকের অভ্যুদয় এবং চট্ট্রগ্রামে জরুরী অবতরণ ও যৌথবাহিনীর অভিযানে বিমান ছিনতাই নাটকের সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হওয়ার আবারো বিশ্ববাসি অবাক তাকিয়ে দেখল বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রী একের পর এক মেগা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করছেন, আর জাতি একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ব্যাপারে আশান্বিত-উদ্বেলিত হচ্ছে , এমনটাও মনে হচ্ছে না। নির্বাচনের নামে তামাশা, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় সিলমারার সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা, বৈষম্যবৃদ্ধি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকের অপ্রতিরোধ্য বিস্তার, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সংকট, উন্নয়ন প্রকল্প ও ব্যাংকিং খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠণ ও পাচার হওয়ার ঘটনা, দখল ও দূষণে নদ-নদীর অপমৃত্যু, একের পর এক দুর্ঘটনাজনিত গণমৃত্যুর ভয়াবহ ট্রাজেডি ইত্যাদি বিষয়গুলো নাগরিক সমাজকে বেশী উদ্বিগ্ন বিক্ষুব্ধ করে তোলছে। এসব কারণে সরকারের প্রশংসনীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ণের সুফল জনমনে প্রত্যাশা জাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। দূষণ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা শহর যখন ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে, তখন আমাদের সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ঢাকা শহরকে লস এঞ্জেলেস শহরের সাথে তুলনা করে হাস্যরসের সৃষ্টি করছেন। যেনতেন প্রকারে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে মানুষের নিরাপত্তা, সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ স্বভাবতই বন্দিশালায় রাজকীয় আরাম-আয়েশের চেয়ে মুক্ত বাতাসে পর্ণক’টীরে নিরাপদে স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতে ভালবাসে। টেকসই উন্নয়নের মানে বুঝতে হবে। মানুষ বাড়ির পাশের নদীতে, খালে সাঁতার কেটে, মাছ ধরে ভাটিয়ালি গান গেয়ে নদীর স্বচ্ছ পানি পান করে, নির্মল বায়ুতে বুক ভরে নি:শ্বাস নিয়ে, অর্গানিক বিষমুক্ত, ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করে নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চায়। বিনাবিচারে আটকের সংস্কৃতি, বিনাবিচারে হত্যার সংস্কৃতি, উন্নয়নের নামে শহরকে কংক্রীটের জঙ্গল বা মৃত্যুপুরিতে পরিনত হতে দিতে চায় না। দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চার-পাঁচগুন কয়েদি মানবেতরভাবে অবস্থান করছে। এদের বেশীরভাগই রাজনৈতিক কারণে আটক আছেন। রাজনৈতিক কারণে দেশের মানুষকে স্পষ্টত বিভাজিত করে জাতিকে দুর্বল করার হীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করে সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈষম্যহীনভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রধান শর্ত। অবকাঠামো উন্নয়নের আগে এসব ক্ষেত্রে উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন