বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতীয় বাহিনীর সেকেলে সরঞ্জাম নিয়ে প্রশ্ন

পাকিস্তানের সাথে ডগফাইটে পরাজয়

নিউ ইয়র্ক টাইমস | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:৪৮ এএম


সম্প্রসারণশীল চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যার উপর ভরসা করছে সেই ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য এ এক অশুভ মুহূর্ত। পাকিস্তানের সাথে ডগফাইটে পরাজয় তার ‘ভিন্টেজ’ (সেকেলে) সামরিক বাহিনী সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
গত সপ্তাহে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একজন পাইলট পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি জঙ্গি বিমানের সাথে ডগফাইটে লিপ্ত হন এবং তার বিমানটি ভ‚পাতিত হওয়ায় তিনি আটক হয়ে স্বল্প সময় পাকিস্তান ভূখণ্ডে বন্দি অবস্থায় কাটান। আঘাতের চিহ্ন ও মানসিক চাপ নিয়ে পাইলট অভিনন্দন একা দেশে ফিরেছেন, তার সঙ্গী সোভিয়েত আমলের পুরনো মিগ-২১-এর সে সৌভাগ্য হয়নি।
দক্ষিণ এশিয়ার পরস্পর বৈরী এ দু’দেশের মধ্যে গত ৫০ বছরে এটাই প্রথম বিমান যুদ্ধ। এটা ছিল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য এক বিরল পরীক্ষা, আর তারা পর্যবেক্ষকদের হতবাক করেছে। যেখানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন সেগুলো গোপন কিছু নয়, সেখানে তাদের আকারের অর্ধেক সামরিক বাহিনীর অধিকারী একটি দেশের কাছে একটি জঙ্গি বিমান হারানোর ঘটনা এখনো আলোচনার বিষয়।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বিপজ্জনক আকারে আছে।
সরকারি হিসেব মতে, যদি আগামীকাল প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে ভারত তার সৈন্যদের মাত্র ১০ দিন গোলবারুদ সরবরাহ করতে পারবে। আর সেনাবাহিনীর সরঞ্জামের ৬৮ শতাংশই পুরনো, সেসবকে ‘ভিন্টেজ’ বলে বিবেচনা করা হয়।
সংসদ সদস্য ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গৌরব গোগোই বলেন, আমাদের সৈন্যদের আধুনিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, কিন্তু তাদের একুশ শতকের সামরিক অভিযান চালাতে হয়।
জোট জোরদার করার দায়িত্বে নিয়োজিত আমেরিকান কর্মকর্তারা তাদের মিশনের ব্যাপারে হতাশার সাথে কথা বলেনঃ স্ফীতকায় আমলাতন্ত্র অস্ত্র ক্রয় এবং যৌথ প্রশিক্ষণ মহড়া কঠিন করে রেখেছে; ভারতীয় বাহিনী মারাত্মক অর্থসংকটের শিকার, আর দেশের নৌ, সেনা ও বিমান বাহিনীর মধ্যে একসাথে কাজ করার চেয়ে প্রতিযোগিতার প্রবণতা দেখা যায়।
সমস্যা যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছরগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষা ঠেকাতে ভারতকে এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে তৈরী করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গত বছর মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস জিম ম্যাটিস ঘোষণা করেন যে পেন্টাগন তার প্যাসিফিক কমাণ্ডকে ইন্দো-প্যাসিফিক কমাণ্ডে পুনঃনামকরণ করছে। এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তিনি পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের গুরুত্বের নউপর জোর দেন।
ম্যাটিস বলেন, এটা আমাদের প্রধান যোদ্ধা কমাণ্ড। এটা হলিউড থেকে বলিউড পর্যন্ত বিশে্ব অর্ধেকেরও বেশি স্থলভাগ ও নানামুখী জনসংখ্যা পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
গত দু দশক ধরে পাকিস্তানের সাথে ঘনিন্ঠ সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে আমেরিকার সামরিক বাহিনী ভারতের সাথে জোট গড়ার ব্যাপারটিতে অগ্রাধিকার প্রদান শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য যে পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট করছে না। পাকিস্তান এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মাত্র এক দশকে ভারতে মার্কিন অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ শূন্য থেকে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, গত সপ্তাহে ভারতের মিগ-২১ জঙ্গি বিমানটি ভ‚পাতিত করতে পাকিস্তান তার একটি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান ব্যবহার করেছে। ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। কিন্তু ৩ মার্চ ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস বলে যে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। যাহোক, নিজ সামরিক বাহিনী নিয়ে সমস্যা কবলিত হলেও অবস্থান ও আকারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার কৌশলগত আবেদন রয়েছে।
ভারত শিগগিরই বিশে^র সর্বাপেক্ষা জনবহুল দেশ হবে। ২০২৪ সালেই দেশটি জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। দক্ষিণ ও পশ্চিম চীনের সাথে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। আরো আছে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক পানিসীমা যা সমুদ্র বাণিজ্য পথ হিসেবে চীনেরও প্রয়োজন। এ সবই প্রতিদ্ব›দ্বী চীনকে কোণঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন।
ওয়াশিংটনে হেরিটেজ ফাউণ্ডেশনে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষণা ফেলো ও ‘কোল্ড পিস: চায়না-ইণ্ডিয়া রাইভালরি ইন দি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ গ্রন্থের লেখক জেফ স্মিথ বলেন, ভারতের বিপুল জনসংখ্যা, তার দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সম্ভাবনা, তার ভৌগোলিক বিস্তার তাকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে।
তিনি বলেন, চীনের যখন উত্থান ঘটছে ও যুক্তরাষ্ট্র তার প্রাধান্য বজায় রাখতে চাইছে , একুশ শতকে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে তার একটি সুইং (দোল খাওয়া) রাষ্ট্র্র দরকার হবে। আর এ সুইং রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র তা জানে এবং ধৈর্য্য ধরতে আগ্রহী। ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য অর্থ বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ।
২০১৮ সালে ভারত ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করে। সে বছর চীনের সামরিক বাজেট ছিল ১৭৫ বিলিয়ন ডলার। গত মাসে ভারত আরো ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘোষণা করেছে।
ভারত তার সামরিক বাহিনীর জন্য কত ব্যয় করে সেটা প্রশ্ন নয়, কিভাবে ব্যয় করে সেটাই বিষয়।
এই অর্থের অধিকাংশই চলে যায় ১২ লাখ নিয়মিত সৈন্যের পেনশনসহ বেতন পরিশোধে। মাত্র ১৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে নতুন অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনতে।
সংসদ সদস্য গোগোই বলেন, যে সময় আধুনিক সেনাবাহিনীগুলো তাদের গোয়েন্দা ও কারিগরি সক্ষমতা লাভে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে তখন আমাদেরও তা করতে হবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামরিক ক্রয় বিষয়ক সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অমিত কৌশিস বলেন, সরকারের মনোযোগের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। চীন এটাই করেছে। তারা আগে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়েছে, তারপর তাদের বর্তমান সামরিক অবস্থান অবস্থানে পৌঁছনোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। তারা আমাদের চেয়ে ২০ বা ৩০ বছর বআগে শুরু করেছে।
নয়াদিল্লির সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা নাগরিকদের মৌলিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে জীবনমান উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে উচ্চ সাক্ষরতা হার ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন। চীন যখন ভারতের পশ্চাৎ অংশে স্থল ও সাগরে অনুপ্রবেশমূলক হামলা চালাচ্ছে তখন এসব দিকে অর্থ ঢালরার পর সামরিক বাহিনীর জন্য অর্থ সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
চীন একটি বলিষ্ঠ ও করপ্রদানযোগ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাকে আগ্রাসী ভাবে সেরা সামরিক অস্ত্র কেনা ও দেশে তৈরি করার সুযোগ দিয়েছে।
বিশে^ যুদ্ধের চারিত্র বদলে গেছে। এখন যুদ্ধ হচ্ছে অতীতের মত বিশাল হামলাকারী সেনাবাহিনী নিয়ে নয়, সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে। এখানেও ভারত পিছিয়ে আছে। বিশে^র পঞ্চম বৃহত্তম সামরিক ব্যয়কারী দেশ হওয়া সত্তে¡ও এ বছর সামরিক খাতে বরাদ্দ বাজেটের মাত্র এক-চতুর্থাংশ দিয়ে নতুন সরঞ্জাম কেনা হবে। যদিও বিশে^র অধিকাংশ দেশেই সামরিক ক্রয় একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া, স্ফীত আমলাতন্ত্রের কারণে ভারতে তা আরো বেশি এক ধীরগতির প্রক্রিয়া। দুর্নীতি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফায়েল জঙ্গি বিমান ক্রয়ের ৮.৯ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি নিয়ে মোদি সরকার বর্তমানে বিরোধী দলের বিরাট সমালোচনার মুখে পড়েছে। তারা একে দুর্নীতি চুক্তি বলে আখ্যায়িত করে নির্বাচনের আগে তার সম্মান ভুলুন্ঠিত করতে চাইছে।
রাফায়েল বিমান ক্রয় ভারতকে তার পুরনো মিগ-২১ জঙ্গি বিমান বহর ও অন্যান্য জেটগুলোর জায়গায় এ বিমানকে প্রতিস্থাপনে সাহায্য করবে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী সমালোচনাকারী বিরোধীদের উপর দায় চাপানোর চেষ্টায় বলেছেন, ভারতের হাতে যদি রাফায়েল জঙ্গি বিমানগুলো থাকত তাহলে গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সাথে সংঘর্ষে আনেক ভালো করতে পারত। তিনি বলেন, দেশ রাফায়েলের অভাব উপলব্ধি করেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন