শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অপ্রস্তুত ছাত্রদলের ভরাডুবি

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ২৫টি পদ ও ১৮টি হল সংসদে ২৩৪টি পদের একটিতেও জিততে পারেনি ছাত্রদল। ২৮ বছর আগে ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পর ছাত্রসংগঠনটির এমন ভরাডুবিতে বিস্মিত নেতাকর্মীরা। এতোগুলো পদের মধ্যে একটিতেও জয়ী হতে পারবে না তা তাদের কাছে কল্পনাতীত মনে হচ্ছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য, দীর্ঘদিন ছাত্রদলের অনুপস্থিতি, হলে হলে নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব, জাতীয় নির্বাচনের আদলে আগের রাতে ভোট চুরির অভিযোগ করছে সংগঠনটি। তবে মূল নেতৃত্বের বাইরে থাকা নেতারা নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই বড় করে দেখছেন। তারা মনে করেন, শীর্ষ নেতাদের ছাত্রত্ব না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে অনীহা, বয়স্ক ও অছাত্রদের দিয়ে অনিয়মিত কমিটি গঠন, এক কমিটি দিয়েই বছরের পর বছর পার করাসহ নানারকম সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের ভরাডুবি হয়েছে। আর ছাত্রলীগ ও প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ সেটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সাধারণ ছাত্রদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের দীর্ঘদিন ধরে কোন যোগাযোগ না থাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে অনুপস্থিত, ছাত্র অধিকার ইস্যুতে মাঠে না থাকা, বয়স্ক ও আদু ভাইদের (ছাত্রদের কথা অনুযায়ি) দিয়ে কমিটি গঠন, নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি না থাকার কারণেই এই বিপর্যয় হয়েছে।
তরিকুল ইসলাম নামে ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রদল নামে কোন সংগঠন আছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তা বোঝার কোন সুযোগ নেই। দলটির নেতাকর্মীদের সাথে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন যোগাযোগ নেই, শিক্ষার্থীদের কোন ইস্যু নিয়েও তারা অ্যাক্টিভ না।
পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক যে বয়সের তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার কোন সুযোগ নেই। সংগঠনটির নেতাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বয়সের এতো পার্থক্য, আবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেও না।
ছাত্রদলের নেতারা মনে করেন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল অনেক বেশি। প্রার্থী দেয়ায় বিলম্ব, প্রার্থীদের পরিচিতি ও প্রচারণায় সময় কম পাওয়া, বেশিরভাগ নেতার ছাত্রত্ব না থাকা, শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে নির্বাচনের বিরোধিতার কারণে ছাত্রদল ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেনি।
ছাত্রদলের একজন সহ-সভাপতি বলেন, নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অনেকেই ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল অংশগ্রহণ করুক তা চায়নি। তাদের বারবার বিরোধিতার কারণে ছাত্রদলের প্রার্থী ও প্যানেল ঘোষণা করতে অনেক দেরি হয়েছে। অথচ তফসিল ঘোষণার পরপরই যদি তা করা যেতো বা এর আগে থেকেই যদি প্রস্তুতি থাকতো তাহলে ফলাফল আরও ভাল হতো। অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতারা মনে করেছে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রার্থী থাকলে বা কেউ বিজয়ী হলে তাদের কর্তৃত্ব থাকবে না। তাদের মূল্যায়ণ কমে যাবে। এজন্য তারা নিজেরাই চায়নি ছাত্রদল নির্বাচনে ভাল করুক। আবার কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শতভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশিরভাগ নেতার ছাত্রত্ব না থাকায় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারা অংশও নিতে পারেননি।
কেন্দ্রীয় একজন যুগ্ম সম্পাদক বলেন, যারা ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন তারা ছিলেন অছাত্র ও বয়স্ক নেতা। যারা এবার ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেবেন তাদের মধ্যে থেকেই হয়তো ভবিষ্যতে ছাত্রদলের কমিটিতে শীর্ষ পদে নেয়া হবে- এমন আশঙ্কা থেকে তারা বিরোধিতা করেছিলেন।
এ নিয়ে ছাত্রদলের সিনিয়র-জুনিয়র নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠকও করেছিলেন। ভিডিও কনফারেন্সে মাধ্যমে ছাত্রদল নেতাদের সঙ্গে ওই বৈঠকে ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছাত্রদল নেতাদের বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ধরনের কর্মকাÐ কেউ করতে চাইলে পদত্যাগ করে করতে হবে।
সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে ছাত্রদল নেতাদের বৈঠকের আগেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। নীতিনির্ধারকদের যুক্তি ছিল- ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেয়া জরুরি। বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে একেবারে শেষ দিনে ছাত্রদলের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেন।
ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকেই দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকেই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলমান ছিল। আর নির্বাচনের পর ডাকসু নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। তফসিল ঘোষণা করা হয় ১১ ফেব্রæয়ারি। ঘোষিত তফসিল অনুয়ায়ি নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন নির্ধারণ করা হয় ২৬ ফেব্রæয়ারি। তফসিল ঘোষণার পরপরই ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠন এমনকি কোটা সংস্কার আন্দোলকারীরাও তাদের প্রার্থীদের নাম এবং প্যানেল ঘোষণা করে। পক্ষান্তরে ছাত্রদল ২৬ ফেব্রæয়ারি প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে ২৬ ফেব্রæয়ারি বিকেল সাড়ে তিনটায়। যে ছাত্র সংগঠন দীর্ঘ গত দশ বছরে ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে না পারায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, প্যানেল গঠনে জটিলতা ও যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া ভোটে অংশ নেয়ার ফলে ডাকসু নির্বাচনে অকল্পনীয় বিপর্যয় হয়েছে।
তবে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের দাবি- ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কারণে তাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারেননি। ছাত্রদলের ভিপি ও জিএস পদে যে ভোট পড়েছে তাতে এ সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ভিপি পদে মাত্র ২৪৫ ভোট পড়েছে। তাহলে সংগঠনের নেতাকর্মীরা কি ভোট দেননি?
এর আগে ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জেরে ডাকসুতে বড় বিজয় পেয়েছিল। কিন্তু সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছাত্রদল ডাকসুর ২৫টি পদের একটিতেও জয় পায়নি। এমনকি প্রার্থীদের মধ্যে সম্পাদকীয় একটি পদ ছাড়া কেউ হাজারের ওপরে ভোট পাননি। ১২টি সম্পাদকীয় পদের মাত্র একটিতে ছাত্রদলের প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আসতে পেরেছেন। কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী কানেতা ইয়া লাম-লাম ৭ হাজার ১১৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন।
ভিপি পদে এই সংগঠনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ২৪৫ ভোট পেয়ে পঞ্চম হয়েছেন। জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার ৪৬২ ভোট পেয়ে ষষ্ঠ হয়েছেন। আর এজিএস প্রার্থী খোরশেদ আলম সোহেল পেয়েছেন মাত্র ২৯৪ ভোট। এ ছাড়া ১৮টি হল সংসদের কোনো পদেও ছাত্রদল জয় পায়নি। এমনকি প্রতিদ্ব›িদ্বতায়ও ছিল না। হল সংসদগুলোতে ২৩৪টি পদের বিপরীতে ছাত্রদলের প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৫৪ জন।
নির্বাচনে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের মতো ডাকসু নির্বাচনও ক্ষমতাসীনদের দখলদারিত্বে হয়েছে। রাতের আধারে সিল মারা হয়েছে, ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই এই নির্বাচনে প্রকৃত ফলাফল প্রতিফলিত হয়নি। প্রচারণার বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রদলের প্রার্থীরা সকল ভোটারের দ্বারে দ্বারে গেছে, ভোট চেয়েছে প্রচারণা করেছে। কিন্তু তারা ভোট দিতে পারেনি। অনেক হলে প্রার্থী দিতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, হলে যারা থাকে তাদেরকে ছাত্রলীগ ভয়ভীতি দেখিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি, যারা দিয়েছিল তাদেরকে প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়েছে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের একজন সহ-সভাপতি বলেন, সত্যিকার অর্থে আমাদের প্রার্থীরা প্রচারের সময়ও তেমন পাননি। তারপর আবার প্রচারে সমন্বয়হীনতাও ছিল। হল পর্যায়ের নেতাকে ডাকসুর প্রার্থী করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তারা অপরিচিত ছিলেন। ছাত্রদল প্রার্থীদের জয়ী করার ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের আন্তরিকতার অভাবও ছিল।
ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন না। সামগ্রিকভাবে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রতিফলন হয়েছে। কারণ ক্যাম্পাস ও হলগুলোকে ছাত্রলীগ তাদের দূর্গ হিসেবে গড়ে তুলেছে। ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত। অন্যদিকে প্রশাসনও ক্ষমতাসীনদের বিজয়ী করার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। এতোকিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ছাত্রদল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তবে নেতৃত্বের দুর্বলতার বিষয়টি তিনি উল্লেখ করে বলেন, নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করা হয়নি।করলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থান করতে পারতো, হলে থাকতে পারতো। না দিলে একটা যৌক্তিক লড়াই করতে পারতো। এই নির্বাচনে তরুণ শিক্ষার্থীরা বাকশালকে দেখেছে মন্তব্য করে খোকন বলেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য সুনাম ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। আর তরুণ শিক্ষার্থীরা দেখলো বাকশাল কেমন? আওয়ামী লীগের অধীনে যে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়না তাও তারা প্রমাণ পেল।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ডাকসুর নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের মতোই হয়েছে। এখানে ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন আলামতই পাওয়া যায়নি। একারণে ছাত্রলীগসহ সব ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তিনিও তাদের দাবি মেনে পুনঃনির্বাচন দিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহŸান জানান। ####

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Jahurul Hoq Zayed ১৫ মার্চ, ২০১৯, ১:৫৫ এএম says : 0
বাংলাদেশ সৎ, মেধাবী, মানবতাবাদী দেশপ্রেমিকদের জন্য এক জাহান্নামে পরিনত হয়েছে।
Total Reply(0)
Murad ১৫ মার্চ, ২০১৯, ২:৪৭ এএম says : 0
বিএনপিরই অবস্থা খারাপ সেখানে ছাত্রদল আর কি করবে ?
Total Reply(0)
তানবীর ১৫ মার্চ, ২০১৯, ২:৪৭ এএম says : 0
তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা অনেক
Total Reply(0)
সাহেদ শফি ১৫ মার্চ, ২০১৯, ২:৪৮ এএম says : 0
বুড়োদের দিয়ে দল চালালে এমন হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন