বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

সংসদের প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া যায় না

প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবদুল হান্নান
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে পাস করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাই কোর্টের দেয়া রায়কে কেন্দ্র করে সংসদ কর্তৃক এক নজিরবিহীন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হলেন রায় দানকারী বিচারপতিরা। স্বয়ং আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত ৫ মে সংসদে এ ঘটনা ঘটে। ওইদিন দুপুরে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংবলিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলাটির শুনানির জন্য তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চে দীর্ঘ শুনানির পর সংখ্যাগরিষ্ঠেরভিত্তিতে বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংশোধনীটি হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষণা করলে বিকালেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে সংসদ। এই রায়ে তীব্র ক্রোধ ও সমালোচনায় ফেটে পড়েন মন্ত্রী এবং এমপিরা। তারা বিচারপতিদেরকে সংবিধান লঙ্ঘনকারী, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এবং অবিবেচক হিসেবে অভিহিত করেন। কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের বিচারের আওতায় আনারও দাবি জানান। সংসদ সদস্যদের সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পাননি প্রধান বিচারপতিও। সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সমালোচনার সূত্রপাত করেন জাতীয় পার্টির সংসদ ফখরুল ইমাম। এরপর একে একে জাতীয় পার্টি, জাসদ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা বিচারপতিদের রীতিমতো তুলোধুনো করেন। সমালোচনাকারীদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মতো সিনিয়র সংসদ সদস্যরাও। সমালোচনাকারীদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই ছিল বিচারপতিদের প্রতি প্রচ- রকমের ঘৃণা এবং অসহিষ্ণুতা। ৩০০ বিধিতে দেয়া বিবৃতিতে আইনমন্ত্রী হাই কোর্টের রায় কে সংবিধান পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করেন। এ ধরনের রায় দেয়ার এখতিয়ার হাই কোর্টের নেই বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র আমরা সহ্য করব না। আইনমন্ত্রী বলেন, ৭২- এর মূল সংবিধানের ৯৬ ধারায় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। ১৯৭৮ সালে সামরিক সরকার সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা বাতিল করে পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান করা হয়। আমরা সেটা পরিবর্তন করে আবার সংসদের হাতেই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু সেটা তারা বাতিল করে দিলেন। এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা বেআইনি। এর আগে আদলত অবমাননার একটি মামলায় সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দুই মন্ত্রীর সাজা দেয়ারও কঠোর সমালোচনা করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, এতে আমাদের সম্মান থাকে না। একই অধিবেশনে বিচারপতিদের বেতনভাতা বাড়ানো সংক্রান্ত বিল উত্থাপনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের বিরোধিতার জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিচারপতিরা অবিবেচক হতে পারেন আমরা সেটা পারি না। শেখ সেলিম বলেন, সংবিধান বলে দিয়েছে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। আমরা জনগণের প্রতিনিধি। বিচারপতিদের মনগড়া রায় দেখে অবাক হয়েছি। এ রায় সংসদকে অকার্যকর করার শামিল। ৭২- এর সংবিধানের দাড়ি, কমা বাতিলের অধিকার কারো নেই। বিচারপতিরা যদি ভাবেন তারা আইনের উর্ধ্বে তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এই বিচারপতিদেরও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আপনারা কে কোথা থেকে এসে ওখানে বসেছেন তা জানা আছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেন, আদালতের রায় শুনে আমি বিস্মিত ও হতবাক হয়েছি। হাই কোর্টের বিচারপতিদের কাছে আজ আমরা জিম্মি হয়ে পড়েছি। অথচ আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলেই অনেকে বিচারপতি হয়েছেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, লাখো মানুষ আত্মহুতি দিয়েছে। অথচ হাই কোর্টের রায়ে কিনা বলে দেয়া হলো ৭২- এর সংবিধানে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা ছিল, তা ছিল ইতিহাসের একটি দুর্ঘটনা। তোফায়েল আহমদ আলোচিত মামলায় এমিকাস কিউরি হিসেবে আদালতে দেয়া ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ৭২- এর মূল সংবিধান প্রণয়নের তার বড় ভূমিকা থাকলেও এখন তিনি তার বিরোধিতা করে স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ ছাড়াও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ, মুজিবুল হক চুন্নু, জাসদের মইনদ্দীন খান বাদলও বিচারপতিদের কঠোর সমালোচনা করে সংসদে বক্তৃতা করেন। আমাদের মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের যে বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো তাতে যে কোনো স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে একটি রায়কে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের হুমকি মিশ্রিত অসম্মানজনক বক্তব্য দেয়া যায় কি না, তাও স্বয়ং আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে। আমরা এ ধরনের বক্তব্য সাধারণত প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেই শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু বিচারপতি বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়ে প্রকাশ্যে এ ধরনের বিষোদগার আমাদের দেশে সম্ভব হলেও বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনা বিরল। আইনমন্ত্রী বলেছেন, হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। তার এই বক্তব্যটা ছিল যৌক্তিক এবং আইন সম্মত। হাই কোর্টের রায়ে তার অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করার মধ্যেও কোনো দোষ নেই। কারণ কোনো রায়ে কেউ সংক্ষুদ্ধ না হলে আপিলে যান না এটা আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু এই সংক্ষুদ্ধটা প্রকাশ করতে হবে আইনের ভাষায় রাজনৈতিক ভাষা কিংবা পেশিশক্তির ভাষায় নয়। মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও পাশাপাশি তাদের বক্তব্যে ভাষা প্রয়োগ এবং বাচনভঙ্গি ছিল পেশিশক্তি প্রদর্শনের মতই যা কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের বক্তব্যের পর ৩০০ বিধিতে আইনমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা তাদের বক্তব্যে বিচারপতিদের সম্পর্কে যে অশোভন ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ধারণা করা হয়েছিল আইনমন্ত্রী তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু তিনি তো করলেনই না বরং তিনিও তাদের কাতারে শামিল হলেন। তিনি রায়কে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করলেন এবং আলোচিত রায়ের আগে আদালত অবমাননার একটি মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক দুই মন্ত্রীর সাজা প্রদানের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনে তারও সমালোচনা করলেন। শুধু তাই নয় তিনি বিচারপতিদের অবিবেচকও বললেন। এছাড়া আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে সত্য আড়াল করার ঘটনাও ঘটেছে। স্বয়ং আইনমন্ত্রীই যদি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান দেখাতে না পারেন এতটা অসহিষ্ণু মনোভাব দেখান তাহলে আইনের শাসন থাকে কোথায়। আইনমন্ত্রী বলেছেন ৭২- এর সংবিধানে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল ৭৮- এ সামরিক ফরমানের মাধ্যমে তা পরিবর্তন করে ফেলা হয়। আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য কি সঠিক? অবশ্যই না। আইনমন্ত্রী এখানে একটি সত্য গোপন করে গেছেন। সেই সত্যটি হলো, ৭২- এর সংবিধানে সংসদের হাতে দেয়া বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা ৭৫- এ ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবই বাতিল করে দেন এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে এ ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে নিয়ে নেন। শুধু ওই একটি বিষয়ই নয় ওই সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২- এর সংবিধান এক অর্থে তছনছ করে ফেলা হয়। কাজেই জিয়াউর রহমান বা সামরিক সরকার নয় ৭২- এর সংবিধানের ওপর সরাসরি আঘাতটা আসে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকেই। বিচারপতিদের গালাগালি করার আগে আইনমন্ত্রীর উচিৎ ছিল ইতিহাসের এই সত্যটির প্রতি খেয়াল রাখা। বর্তমান আইনমন্ত্রীর পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকজন আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও সরকারের স্বার্থরক্ষায় এক বিন্দুও ছাড় দেননি। কিন্তু তার কথাবার্তায় কেউ কখনো বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হয় না। তবে তার একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার অতিকথনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন সবাই। দেশসেরা একজন আইনজীবীর (মরহুম সিরাজুল হক) পুত্র হয়ে, নিজেও একজন বরেণ্য আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান আইনমন্ত্রী কি সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রীর পর্যায় নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন কিনা এ প্রশ্ন অনেকের মনেই দেখা দিয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেছেন, এসব বিচারপতিদের আমরা চিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলেই তারা বিচারপতি হয়েছেন। তোফায়েল আহমদের এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে গত সাত বছর ধরে দলীয় বিবেচনায় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যে অভিযোগ রয়েছে তার স্বীকৃতি পাওয়া গেল। আর যেহেতু তাদের নিয়োগ দেয়া বিচারপতি, অতএব তোফায়েল আহমদরা মনে করেন বিচারপতিরা তাদের হুকুমের দাস, হুকুমদাতার পছন্দমত রায় দিতে তারা বাধ্য। আলোচিত রায়ে তোফায়েল সাহেবদের সে আশা পূরণ হয়নি বলেই তারা ক্ষেপে গিয়ে বিচারপতিদের মু-পাত করছেন। তোফায়েল সাহেব স্ববিরোধী ভূমিকার জন্য ড. কামাল হোসেনের কঠোর সমালোচনা করলেন। অথচ তিনি নিজেও যে একই দোষে দুষ্ট সেটা স্মরণে রাখেননি। ৭৫ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী এনে সংসদের ওপর থাকা বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে সে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর দেয়া হলো তোফায়েল সাহেব কিন্তু সংসদে ওই সংশোধনীর পক্ষেই ভোটদিয়ে ছিলেন। আর এখন আবার তিনি ওই ক্ষমতা সংসদের ওপর ফিরিয়ে আনার জন্য সাফাই গাইছেন। এটা কি তোফয়েল সাহেবের স্ববিরোধিতা নয়? শেখ সেলিম বলেছেন, ৭২- এর সংবিধানের একটি দাড়ি, কমাও পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই। শেখ সেলিমের এজন্য অন্যকারো দোষারোপ করার আগে উচিৎ ছিল শেখ মুজিবকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, রায় দানকারী বিচারপতিদের বিচার চাওয়ার আগে শেখ মুজিবের বিচার চাওয়া। কারণ আগেই বলেছি ৭২- এর সংবিধানের প্রথম ব্যবচ্ছেদ ঘটান শেখ মুজিব নিজেই এবং সেটা ঘটান বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই হলো আওয়ামী লীগ। সব কিছুকেই তারা কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চায়। নিজেদের অপকর্মের ইতিহাস তারা কখনই তলিয়ে দেখে না। কিন্তু নিজেদের অপকর্ম অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্টা করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আওয়ামী লীগ কখনই আইনের শাসনে বিশ্বাসী ছিল না- এখনো নেই। আদলতের কর্তৃত্বকে তারা সবসময় চ্যালেঞ্জ করে এসেছে যখনই আদালতের রায় তাদের বিপক্ষে গেছে। আদালতের রায় পক্ষে না গেলে তারা যে বরাবরই আদলতের ওপর চড়াও হয় এমন নজির বহু আছে। ৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ বিব্রত বোধ করলে এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীদের নেতৃত্বে তখন ঢাকার রাজপথে লাঠি মিছিল বের করা হয়েছিল এবং ওই মিছিল থেকে বিচারপতিদের লাঠি পেটা করার হুমকি দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ওই একই শাসনামলে ঢাকার বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত হাই কোর্টের একটি রায়ে ক্ষুদ্ধ একজন মন্ত্রীর প্ররোচণায় বস্তিবাসীদের হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে এনে বসানো হয়েছিল। ২০০৬ সালে ভোটার তালিকা সংক্রান্ত একটি মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতির দেয়া একটি আদেশে ক্ষুদ্ধ হয়ে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির এজলাসসহ সুপ্রিম কোর্টে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছিলেন। আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতিকে আমরা মানি না- তার কোনো আদেশও আমরা মানব না। ওই প্রতিবাদ সভা থেকেই প্রধান বিচারপতিকে শাররীকভাবে লাঞ্চিত করার হুমকিও দেয়া হয়েছিল। হাল আমলেও অনেক ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি যখন বললেন, অবসরে যেয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা অসাংবিধানিক- এ নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে সরকার দলীয়দের দ্বারা কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন তাকে হতে হয়। জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর আপিল শুনানিকালে প্রসিকিউশন পক্ষের মামলা পরিচালনার দুর্বলতা নিয়ে প্রধান বিচারপতির করা মন্তব্য নিয়েও সংসদের ভেতরে-বাইরে কঠোর সমালোচনা হয়। দু’জন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের জন্য তাকে মীর কাশেম আলীর মামলা থেকে বাদ দিয়ে আপিল মামলা পুনরায় শুনানির দাবি জানান। অতিসম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সংসদে আইন প্রণয়নের দুর্বলতা এবং আইন প্রণেতা তথা সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নের জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংসদের ভেতরে-বাইরে একইভাবে সরকার দলীয়দের রোষানলে পড়েন তিনি। এমন কী মন্ত্রিসভার বৈঠকেও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করা হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির প্রতি পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান আছে কিনা সেটাই সন্দেহ। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদে ঝড় তোলার পর তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও আইনমন্ত্রী তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি। বরং ৮ মে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন, সংসদে যা ঘটেছে তা আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এতে আদালত অবমাননা হয়নি। কারণ হিসেবে বললেন, সংসদে কোনো কথা বলার কারণে কারো বিরুদ্ধে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এটা সংবিধানে আছে। আইনমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন সংবিধানের ৭৮ ধারায় সংসদ সদস্যদের এ ধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী এটা বলেননি সংসদে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের আইনি প্রটেকশন যতই থাকুক না কেন উচ্চ আদালতের একটি রায় কে কেন্দ্র করে আবেগের এ ধরনের বহিঃপ্রকাশ উচিত হয়নি। আইনমন্ত্রী যদি সংবিধান অনুযায়ী তার অবস্থান বিবেচনায় নিতেন, বুঝতে পারতেন তিনি দলের নয় দেশের আইনমন্ত্রী তাহলে অবশ্যই ৫ মে সংসদে তার নেতৃত্বে যা হয়েছে সেজন্য ক্ষমা চাইতেন। সেটা না পারলে অন্তত দুঃখ প্রকাশ করতেন। কিন্তু তিনি কোনটাই করেননি। আইন ও বিচার বিভাগীয় মন্ত্রীই যদি আদালতের রায়ের প্রতি প্রকাশ্যে অসম্মান দেখান এবং তাকে অনুসরণ করে যদি দেশের সাধারণ মানুষও একই পন্থা অবলম্বন করে তাহলে বিচার বিভাগের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এ বিষয়টি আইনমন্ত্রীর ভাবনায় না আসলেও আমরা সেটা অনুভব করতে পারি। আইনমন্ত্রী হয়ত ধরেই নিয়েছেন তারা মন্ত্রী, এমপি অতএব বিচারপতিদের ধমকানোর অধিকার তাদের আছে। আইনমন্ত্রী এটা ভেবে থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ তারা তো কোনে ভোট ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বদন্যতায় এমপি হয়ে নিজেদের কে জনপ্রতিনিধি দাবি করছেন। যাদের প্রতিনিধি তারা দাবি করছেন সেই জনগণ তাদেরকে একটি ভোট দেয়ারও সুযোগ পায়নি। জনগণের ভোট ছাড়া স্বঘোষিত এই জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদেই কিন্তু পাস করা হয় সংসদের হাতে ক্ষমতা দেয়া বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। এটা জাতি এবং উচ্চ আদালতকে নিয়ে তামাশা ছাড়া আর কী বলা যায়। আসল কথা হচ্ছে হাইকোর্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সংসদের যে প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করলাম অন্যকিছু বিবেচনায় না এনেও শুধু এই কারণেই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া যায় না। এই প্রতিক্রিয়া স্পষ্ঠতই এই বার্তা দেয় যে, বিচারপতিদের দ্বারা ক্ষমতাসীনদের লালসা পূরণ করা সম্ভব না হলে তারা প্রতিহিংসার শিকার হবেন তা বলাই বাহুল্য। কাজেই সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়ার অর্থই হবে উচ্চ আদালতকে ক্ষমতাসীনদের কব্জায় বন্দি করে ফেলা। সঙ্গত কারণেই হাইকোর্ট বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়াকে ইতিহাসের দুর্ঘটনা বলে যে মন্তব্য করেছেন তার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করার সুযোগ নেই। একইভাবে সংবিধানের ৭০ ধারা সম্পর্কেও বিজ্ঞ আদালতের পর্যবেক্ষণ যথার্থ। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যদি সংসদে কোনো ইস্যুতে দলের তথা দলের হাই কমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে নিজস্ব মতামত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে না পারেন যেটা ৭০ ধারায় বারিত করা হয়েছে, তাহলে তিনি নিজেও যেমন সংসদে দায়িত্ব পালনে স্বাধীন নন- তেমনি দলের দ্বারা সম্পুর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত সংসদকেও স্বাধীন বলা যায় না। ৭০ ধারার কারণে আমাদের সংসদ সবসময় ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে। ক্ষমতাসীনদের সম্মতি ছাড়া আমাদের সংসদে কোনো কিছুই পাস করা সম্ভব নয়। সরকার পক্ষ হতে বলা হচ্ছে ইচ্ছা করলেই সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে না। কারণ এর জন্য প্রয়োজন হবে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সম্মতি। যা অর্জন করা সহজ হবে না। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সংসদগুলোর দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখব চলমান নবম সংসদসহ স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত সংসদগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ৯১ সালে গঠিত ৫ম সংসদ ছাড়া আর সব সংসদে ক্ষমতাসীনদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। যদিও চলামান ৯ম সংসদসহ অতীতের আরো বেশ করেকটি সংসদে ক্ষমতাসীনদের এই অর্জন নিয়ে জোরালো বির্তক রয়েছে। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার বর্তমানে যে হাল হয়েছে তাতে ভবিষ্যতেও যে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রিত বির্তকিত সংসদ গঠিত হবে না একথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না। হাইকোর্টের রায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে তা হলো সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো পক্ষে না থাকলে তখন কী হবে। এমতঃবস্থায় ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালোয়েশিয়ার উদাহরণ টেনে রায়ে বলা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে এসব দেশের সংসদে বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের জটিলতা ও অচলাবস্থা তৈরি হয়। রায়ের এই অভিমতটি বিচারপতিদের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও তারা সততা নিয়ে বিষয়টি যে রায়ে তুলে ধরেছেন এ জন্য তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাহলে সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকার প্রথম কুফল হচ্ছে- দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে বিচারপতিরা যেমন ক্ষমতাসীনদের প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন। দ্বিতীয় কুফল হচ্ছে- দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংসদ সক্ষম হবে না। কেননা আমাদের দেশে কোনো বিষয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সংসদে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার নজির নেই বললেই চলে শুধুমাত্র নিজেদের বেতন ভাতা বাড়ানোর বিষয়টি ছাড়া। আইনমন্ত্রী এবং এটর্নি জেনারেল বলেছেন ৯৬ ধারা ৭২- এর মূল সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই এই ধারা বাতিল করার এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। আইনমন্ত্রী ও এটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য আইনসম্মত নয়। কেননা মূল সংবিধান এবং মূল সংবিধানের কোনো একটি ধারাকে একই গুরুত্বে দেখা যাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের মূল সংবিধানটি গৃহীত হয়েছিল ৭২- এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদে এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। আর এই গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল ৭০- এ অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে নির্বাচিত সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে। ৭২- এর মূল সংবিধান কোনো সংসদে গৃহীত হয়নি। কাজেই পুরো সংবিধান পরিবর্তন করে ফেলার অধিকার কোনো সংসদের যেমন নেই তেমনি কোনো আদালতেরও নেই। তবে সংবিধানের কোনো ধারা পরিবর্তন, সংশোধন কিংবা নতুন কোনো ধারা সংযোজন করার ক্ষমতা সংসদের আছে। সংবিধান এ পর্যন্ত যে ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে তা সংসদেই হয়েছে। সংবিধানের ১৪২ ধারায় এই ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে। আর সংসদে প্রণীত যে কোনো আইন বা আইনের সংশোধনী যথার্থ কিনা সেটা দেখার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে। সংবিধানের ১০২ ধারা এই ক্ষমতা হাইকোর্টকে দিয়েছে। অতএব সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ওপর হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে এটা দেয়ার এখতিয়ার হাইকোর্টের আছে। তবে এ রায় যথার্থ হয়েছে কিনা তার চূড়ান্ত বিচার করবে আপিল বিভাগ। সুতরাং হাইকোর্টের রায় নিয়ে এত হইচই না করে আমাদেরকে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পরিশেষে যে কথাটা বলতে চাই তা হচ্ছে রাজনৈতিক দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংসদ কিংবা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির হাতে বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল তা কোনভাবেই যৌক্তিক এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সামরিক শাসক বলে যত গালি দেয়া হোক না কেন জিয়াউর রহমান কর্তৃক বিচারপতিদের অপসারণের জন্য প্রবর্তিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যে কোনো বিবেচনায় পূর্বোক্ত দু’টি পদ্ধতির চাইতে শ্রেয়তর তাতে বিন্দুমাত্র বিতর্কের অবকাশ নেই।
য় লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ফরিদপুর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন