বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

কিশোর নজরুলের নবীবন্দনা

প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা

কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে ইসলামী ভাবধারা সম্পন্ন মুসলিম পরিবারে প্রতিপালিত হয়েছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই তার মনে ইসলামী চিন্তা-চেতনা স্বচ্ছন্দ্যে আসন করে নিয়েছিল। ইসলামী উদারতা তার ভেতরে আজন্ম কাজ করেছে। কবির নিজস্ব খান্দানী ইসলামী ঐতিহ্যের যে টান সেটার মধ্যেও তিনি স্বার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করেন সেই শৈশবকাল থেকেই।
তবে এটাই তার একমাত্র বৈশিষ্ট্য ছিল নাÑ বাল্যে ‘লেটোর নাচ’-এ যোগ দেবার ফলে তার মধ্যে অনৈসলামিক সংস্কৃতিও স্থান করে নেয়। এই দু’য়ের সমন্বয়ে নজরুল অসাধারণ এবং অগাতানুগতিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তবু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে ইসলামিক মূল্যবোধÑ নবী রাসূলগণের মহিমান্বিত জীবন, মহান আল্লাহতালার অপার লীলা শৈশব-কৈশোর থেকেই নজরুলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এক্ষেত্রে পারিবারিক পরিবেশ অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করেছেÑ একথা বলাই বাহুল্য। ‘কিশোর নজরুল’ গ্রন্থের প্রণেতা এম. আব্দুর রহমান লিখেছেনÑ
“নজরুলের পিতা মুন্সি ফকির আহমদ জীবনের শেষের দিকে পীর হাজী পাহলোয়ানের মাজারের খাদেম বা সেবাইত ছিলেন। চুরুলিয়ার পীর পুকুরের পাড়ে আছে এই মহান দরবেশের দরগাহ। পশ্চিম পাড়ে আছে মসজিদ। মসজিদের ‘ইমামতী’ও তিনি করতেন। ফকির আহমদ সাহেব ঐ মাজারে প্রত্যহ নিয়মিতভাবে সাঁঝ-ঝাড় দিতেন। সেখানে নির্জন-নিরালায় বসে করতেন বিশ্বপতির এবাদত-আরাধনা। পিতার এই ধ্যান-মশগুল সমাহিত অবস্থা দেখেছেন বালক নজরুল বহুদিন। তখন দুরন্ত নজরুলের আর কোন চাঞ্চল্য থাকতো না, শান্তশিষ্ট বালকের মত কি যেন ভাবতেন দূরে বসে। ”
“মসজিদে গিয়ে পিতার সাথে নামাজ পড়তেন, ‘সিজদা’ করতেন পরম প্রভুর উদ্দেশ্যে ‘পাক্কা নামাজী’র মত। এইভাবে কাজী নজরুল ছোট হতেই নামাজ-রোজার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। মাজারের খাদেম এবং মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হবার পর তার এই ভক্তিভাব আরো বেড়ে গিয়েছিল।”
কাজী নজরুল ইসলাম যখন মসজিদে ‘ইমামতী’র ভার পেলেন, তখন তার বয়স কম-বেশি এগারো বছরের মতো। মুসলিম-জাহানের ইতিহাসে এ বয়সের কোন কিশোর মসজিদের ইমামতী করেছেন, এরূপ ঘটনা কদাচিৎ দেখা যায়। ইমামতী করতে হলে যে যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, নজরুলের তা পুরাপুরি ছিল না। তথাপি দুঃসাহসী হয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। তার দূরসম্পর্কীয় ফকির আহমদের চাচাত ভাই চাচা মুন্সী বজলে করিম তাকে উৎসাহ দিলেন। ইমামতী করার প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানের তালিম দিলেন তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে। নজরুলের আবার নতুন করে আরবি-ফার্সি-উর্দু পড়া শুরু হলো।
মুন্সী চাচার কাছে ইসলামের ধর্মীয় ভাষার ‘সবক’ (পাঠ) নিতে গিয়ে নজরুল লক্ষ্য করলেন যে, তার চাচা বাংলা গান ও উর্দু গজল লেখেন, আর গুনগুন করে গেয়ে তাতে সুর দেন। এই সুরের ঝংকার নজরুলের মনের পর্দায় ধাক্কা দিল। তার কবি প্রতিভার মোড়কে জাগলো স্পন্দনÑ দীল পাপিয়ার কণ্ঠে জাগলো সুরের চাঞ্চল্য।... বিধিদত্ত কবি প্রতিভা এবং সুরের চাঞ্চল্যে নজরুল রচনা করতে লাগলেন ইসলামী বিষয় নিয়ে গান ও গজল। লিখলেন নবী বন্দনা। তার সে সময়ে লেখা গান-গজল-ফার্সি রুবাই বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পারিবারিক পরিবেশ এবং ধর্মীয় অনুভব তার ওপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এ দুনিয়ায় ‘বন্দেগী’ না করলে ‘জেন্দেগী’ খোয়া যাবে, হাশরের ময়দানে আল্লাহর সামনে ‘শরমেন্দেগী’ হতে হবে এসব গূঢ় তত্ত্ব নিয়েও কিশোর বয়সেই লেখালেখি করেছেন নজরুল ইসলাম। ‘জামায়েতে’ নামাজ পড়লে অধিক নেকি পাওয়া যাবেÑ একজনের সাথে আরেকজনের চেনা-পরিচয়ের মধ্যমে পর ‘খেশী’ হবে ইত্যাদি বিষয়েও লিখেছেন। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো বোধগম্য হবেÑ
(১)
কর ভাই ‘বন্দেগী’
খেয়াইও না আর অবহেলায় ‘জেন্দেগী’
‘শরমেন্দেগী’ হবে ‘হাশরের’ মাঝে...।
(২)
নামাজ পর মিঞা, ওগো নামাজ পড় মিঞা,
সবার সাথে ‘জমায়েতে’ মসজিদেতে গিয়া,
তাতে ‘নেকী’ পাবে বেশী
পর সে হবে ‘খেশী’
থাকবে নাকো ‘কীনা’ প্রেমে পূর্ণ হবে হিয়া।
নামাজ, রোজার ফজিলত সম্বন্ধে যেমন লিখেছেন তেমনি এইসব বিধি-বিধানের যিনি প্রচারক সেই বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর গুণ-মাহাত্ম্য গেয়ে নবী বন্দনাও করেছেন।
পরিণত বয়সে ইসলামী সঙ্গীত রচনা করে নজরুল ঝিমিয়ে থাকা-পিছিয়ে পড়া মুসলমান জাতিকে যে জাগালেনÑ তার ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল তার কৈশোরে লোটে নাচের দলে যোগদানের পর। শৈশব-কৈশোরের নজরুলের মধ্যে যে প্রবল ধর্মভাব ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় সে সময়ে রচিত বিভিন্ন রচনায়। কৈশোরে নবী বন্দনায় তিনি ছিলেন পঞ্চমুখ। এবারও উদাহরণ দিয়ে নজরুলের কৃতিত্ব তুলে ধরতে চাইÑ
১.
মোহাম্মদ নাম কেবা প্রথম ডাকিলো।
কার নামের ঐ মোহন বাঁশি জগত ভোলালো ॥
বাঁশি যখন ভোরে বাজে
মনের লোকের দিলে লাগে,
ঘুমের মরা অমনি জাগে, নামাজেতে দাঁড়ালো ॥
মদিনাতে উঠল সে সুর;
বাঁশীর সুরে জগতবাসী পাগল হইলো ॥
হায়রে কোরেশ গণ,
করিল কত জ্বালাতন,
আর না আসিবে ফিরে জনম কাঁদিল ॥
না চিনিলি অমূল ধন
হারাইলি দো জাহান,
মক্কাতে উঠিল রবি, মদিনায় আলো দিল ॥
(২)
কাবা আমার, কেবলা আমার; তোমারি এই গলি
হে প্রিয় মোহাম্মদ (দঃ) তোমায় সাল্লে আলা বলি ॥
যে দেখেছে তোমার তরে
সেই আল্লাকে চিনতে পারে
তুমিই থাক দুনিয়ার পরে কাবাঘরে কাম্বলী ॥
বুকে তোমার কোরান আঁকা
তুমিই খোদার হৃদয় গাঁথা
তুমিই আমার ত্রাণদাতা, আমি কি তোমায় ভুলি ॥
তোমার বাঁকা নয়ন দুটি,
উদ্ধারিবে তামাম পাপী,
তুমিই দয়াল জগতব্যাপী তোমায় মানে সব অলি ॥
জান্নাৎ এই দুনিয়া পরে,
তোমারই এই কুঞ্জ দ্বারেÑ
তোমারে দেখিবার তরে গাহে ও নাম বুলবুলি ॥
৩.
আজ নতুন ঈদের চাঁদ উঠেছে নীল আকাশের গায়।
তোরা দেখবি কারা, ভাই বোনেরা, আয়রে ছুটে আয় ॥
আহা, কত সুন্দর এ চাঁদের মুখ,
চক্ষু জুড়ায়, জুড়ায়রে বুক,
সারা জাহান আলোকিত শিশু নবীর হাসির আভায় ॥
বেহেস্ত হতে এলো সওগাত,
নূর জ্যোতিতে কাটিল রাত।
ইমানেরি শিরনী এলো ধরবে হৃদয় পেয়ালায় ॥
৪.
মদিনা চলে গেলরে ভাই, হেরা গুহার আলো।
মক্কা আলো হলো না ভাই, মদিনা আলো হলো ॥
আল্লার নবীর ইশারাতে
চাঁদ দু’খ- আকাশেতে,
যাদু যাদু বলে কোরেশ মুখ ফিরায়ে নিল ॥
মাটির ঘরে আজ নেমেছে চাঁদরে আজ নেমেছে চাঁদ।
কিবা তাঁর রূপের বাহার, ঐ রূপে পাগল সারা জাহান ॥
এক বুড়ী আটার গেটরী লয়ে...
যাইতে ছিলো পথটি বেয়ে,
বুড়ীর দ্বারে হলো দেখা, এ তো আল্লার দান ॥
ইহুদী বুড়ী দেখে বলে,
দেখেছি তৌরিত কিতাব খুলে
তুমিই আমার আল্লার রসূল, চিহ্ন আছে তোমার কাঁধ ॥
ইহুদী নারীর কথা শুনে
মুসলমান হয়ে ঈমান এনে
জান্নাতে যদি যাবি তোরা কদম তবে পড়ে কাঁদ ॥
সে যে নবীর নবী, বিশ্ব নবী
নত শিরে তাঁর কদম সেবি,
নূরে নূরে নূরের ছবি, সে যে ইসলামের বুনিয়াদ ॥
বেহেস্তে নাম আহামদ (দঃ)
দুনিয়ায় নাম মোহাম্মদ (দঃ)
খোদার দোস্ত মহামহিম, তাঁর কলেমায় জীবন বাঁধ ॥
৬.
আমি কোন পথে যাই সোনার মদিনা গো আমি কোন পথে যাই সোনার মদিনা।
নবী বিনে পাগোল দিওয়ানা।
আমার নবী যখন নামাজ পড়তেন
কাফের গণ ঢিল ছুঁড়তো গো;
আমার নবী ইহু করলেন না, চাইলেন খোদার কাছে উম্মতের পানা।
নবী যদি মনে করতেন,
ধন দৌলত বাদশা হতেন গো,
আমার নবী ধন চাইলেন না, চাইলেন খোদার কাছে উম্মতের পানা ॥
আমার মন যেতে চায় সোনার মদিনায়।
যেথায় নবী ঘুমিয়ে আছেন পাক রওযায় ॥
লাখো হাজার হাজী গিয়ে,
আসে তাকে সালাম দিয়ে
তার স্মৃতি বক্ষে নিয়ে ফিরেন গো সবাই ॥
পাখী হলে যেতাম উড়ে
হোকনা রওজা যতই দূরে,
এ দিল আমার যাচ্ছে পুড়ে, সেই না বেদনায় ॥
খোদার রসুল কতই কষ্ট পেলেন এই না ধরায় ॥
রোজ হাশরে সুপারিশের আশে
আমি কেমনে যাইবো নবীর পাশে,
ঐ দৃশ্য মোর চক্ষে ভাসে, সদায় কাঁদি নিরালায় ॥

খোদার আলো যার নূরে ছিল, সে কেন কেঁদে বেড়ায় বনে বনে
আমার দয়াল নবী ভিখারী সাজিল কেনে ॥
নবী না খাইয়া বন্দেগী করি থাকিত ভুবনে,
এ দুনিয়ার দানাপানি খান নাই নবী জীবনে,
নবীর যখন ক্ষুধা লাগতো
পেটে তখন পাথর বাঁধতো
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যেতো উম্মতের কারণে ॥
নবী বাদশাহী চাইলে বাদশাহী পেতেন, বাস করতেন দালানে
পূর্ণ করতেন আল্লা তার রসুলকে ধনে জনে
নবী কাফেরের ডরে
থাকতেন গুহার ভিতরে
ইহুদিরা মারতো ঢেলা, নামাজ পড়তেন যখনে ॥
পেয়েছি ভাই দয়াল নবী সাল্লে আলা মোহাম্মদ
ফুটেছে মরুর হ্রদে অপরূপ এক কোকনদ ॥
সে ফুলের এ সুবাসেতে,
ভ্রমর অলি উঠল মেতে,
গুঞ্জরে সব তার কাছেতে, আল্লাহ এক মহা মাবদ ॥
সে নবীজী সুম্মে আমীন,
রহমতুল লিল আল আমীন,
দিয়েছে সে ইমানের চিন, জপিতে নাম সে আহাদ ॥
দয়াল সে দেখাইবে দয়া
রোজ হাশরে দিবে ছায়া
জ্যোতির্ময় যে তাহার কায়া, বেহেস্তে নাম আহম্মদ ॥
ইসলামের ঐ নূর আলোকে,
কাটল আঁধার এই ভূলোকে,
দ্বীন পেল সব বেদ্বীন লোকে, শুদ্ধ হলো যত বদ॥
কালিমা যা যেথায় ছিল,
কলেমায় সব মুছে গেল,
জান্নাতের বাগ সবাই পেল, নরক তাদের হল রদ ॥
গায় নজরুল এসলাম,
নবীজীর কদমে সালাম, আমার রসুল মোহাম্মদ (দ:)।
বাল্য-কৈশোরের এসব রচনা থেকে নজরুল মানসের ধর্মীয় অনুরাগ, নব রাসুলের প্রতি প্রসার শ্রদ্ধার যে চিত্র পাওয়া যায় তা অনন্য সাধারণ অতুলনীয়। বাক্য বিন্যাস, রচনাশৈলী, ছন্দ, চাতুর্য, উপমা-প্রয়োগের দক্ষতায় এত উচ্চস্থানীয় রচনা হয়েছে যে, মনেই হয় না এগুলো কোন কবির কৈশোরের লেখা। কবি প্রতিভার সোনার পরশে কাঁচা হাতের লেখা ও ছাড়িয়ে গেছে দক্ষ অভিজ্ঞ-লেখাকে।
বিশ্বনবীর মহিমা বর্ণিত গানগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো ইসলামের ইতিহাস সম্বন্ধে কিশোর কবি নজরুলের জ্ঞানের পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং পরিপক্ক ছিল। ইসলাম প্রচারের অপরাধে নবীকে তার স্বগোত্রীয় কোরেশগণ যে অত্যাচার নির্যাতন করেছে সে ঘটনার উল্লেখ করে কবি মহানবীর জন্য হৃদয়ে অপার বেদনা অনুভব করেছেন। অত্যাচার সইতে না পেরে নবীজী মদিনায় হিজরত করতে বাধ হয়েছেনÑ গানের মধ্যে স্মরণ করেছেন সে কথাওÑ
হায়রে কোরেশগণ,
করিল কত জ্বালাতন
................................
মক্কাতে উঠিল রবি, মদিনায় আলো দিল ॥
ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থ তৌরাত কেতাবে আছে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) আসবেন, তার কোন ছায়া থাকবে না আকাশের মেঘ তাকে ছায়া দেবেÑ তার কাঁধে থাকবে নবুওতের সীলমোহর। নজরুল একটি গানে এই তথ্যেরও উল্লেখ করেছেনÑ
ইহুদী বুড়ী দেখে বলে,
দেখেছি তৌরিত কিতাব খুলে
তুমিই আমার আল্লাহর রাসুল, চিহ্ন আছে তোমার কাঁধ ॥’
নবীজীর জীবনযাত্রা ছিল অতিসাধারণ। ‘নবী না খাইয়া বন্দেগী’ করতেন। আরব দেশে এক ধরনের পাথর পাওয়া যায় যা বেশ ঠা-া। সে পাথর পেটের সাথে বেঁধে রাখলে পেট ঠা-া থাকেÑ ক্ষুধা কম লাগে। নজরুল লিখেছেনÑ
নবীর যখন ক্ষুধা লাগতো
পেটে তখন পাথর বাঁধতো
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে যেতো উম্মতের কারণে।
১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করলে মহাকাশযান অ্যাপোলোর পাইলট মাইকেল কলিন্স বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন যে চাঁদকে আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে অখ- অবস্থায় দেখি তা মূলত দ্বি খ-িত। মুসলমানগণ বিশ্বাস করে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র তর্জনীর ইশারায় চাঁদ দুই খ-ে বিভক্ত হয়ে আছে। কিশোর নজরুল এই কাহিনী জানতেনÑ তিনি উল্লেখ করেছেন-
আল্লার নবীর ইশারাতে।
চাঁদ দু’খ- আকাশেতে।
শুধু ঘটনা বা কাহিনী বর্ণনাতেই নয়, নজরুল সেই কিশোর বয়সেই বাক্যে অনুপ্রাস সৃষ্টিতে কেমন দক্ষ ছিলেন তার পরিচয়ও বহন করছে এসব গানÑ
১) কালিমা যা যেখায় ছিল,
কলেমায় সব মুছে গেল-
... ... ...
গায় নজরুল এসলাম
নবীজীর কদমে সালাম
২) সে যে নবীর নবী, বিশ্ব নবীÑ
নত শিরে তার কদম সেবি
নূরে নূরে নূরের ছবি, যে যে ইসলামের বুনিয়াদ।
বিশ্বনবীর রূপকে তুলনা করেছেন দূরাকাশের চাঁদের সাথে গুণের তুলনা করেছেন ভুবন ভোলানো মোহন বাঁশির সাথে, তার মহিমার তুলনায় এসেছে রবি, যা সারা দুনিয়ার আলোর ভান্ডার। নজরুল মনে করেন ‘দয়াল নবী সাল্লেআলা মোহাম্মদ’ যেন ‘মরুর হ্রদে অপরূপ এক কোকনদ।’ তার বেহেস্তে নাম আহমদ (সা:) দুনিয়ায় নাম মোহাম্মদ (সা.) খোদার দোস্ত মহামহিম।
আচার নিষ্ঠ, ধর্মভীরু মুসলিম পরিবার এবং মসজিদ, মাজার মক্তবের সংস্পর্শে থাকার ফলেই বালক নজরুল ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। চাচা বজলে করিম যখন তাকে মসজিদের ইমামতীর জন্য তালিম দান করেন তখনও নিশ্চয়ই ধর্মের বিবিধ প্রসঙ্গ সম্বন্ধে এবং নবীজীর জীবনের নানা অধ্যায় সুচারুরূপে তার কাছে বর্ণনা করেছেন। পরিবারের এবং সমাজের অন্যানদের কাছ থেকে ও ইসলাম এবং এর প্রচারক বিশ্বনবী সম্বন্ধে শুনে থাকতে পারেন অথবা প্রতিভাধর ও অনুসন্ধ্যিসু বালক হিসেবে নিজেও পড়া শোনা করে জেনেছেন ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধে, জেনেছেন নবীজী সম্বন্ধে যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই নাত-এ-রসুল জাতীয় রচনায়।
কিশোর নজরুল এতই প্রতিভাবান ছিলেন যে, ঐ বয়সে তিনি ফার্সি রুবাই পর্যন্ত লিখেছেনÑ
মেরে দিল বেতাব কিয়া
তেরে আব্রুয়ে কামান
জ্বলা যাতা হ্যায়,
ইশ্ক্ মে জান পেরেশান।
আগেই উল্লেখ করেছি, লেটোর নাচে যোগদানের ফলে তার মধ্যে অনৈসলামিক সংস্কৃতি স্থান করে নেয়। তাই লেটো কবি নজরুল এক দিকে যেমন ইসলাম ধর্মের নানা দিক, নবী রাসুলের বন্দনা করেছেন, ঠিক তেমনি শ্যামাগীতি কীর্তন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট নাটিকাও লিখেছেন।
মসজিদ মাজারের ইমাম ও খাদেম থাকা কালে ইসলাম ধর্মের আচার অনুষ্ঠান এবং নবীজী সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা লাভ করে ছিলেন বলেই পরবর্তী কালে লিখতে পেরেছিলেন কালজয়ী ইসলামী গান, লিখেছিলেন হামদ-নাত এবং মরুভাস্কর-এর মত অমর কাব্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন