পৃথিবীতে যেমন অনেক জাতির উত্থান হয়েছে, তেমনি অনেক জাতির পতনও হয়েছে। রোমান সা¤্রাজ্য ও সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আজ কোথায়? উত্থান ও পতনের এই জোয়ার-ভাটায় পৃথিবীতে ইসলামী খেলাফতের ভাটা চলেছে প্রায় ২০০ বছর। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যারাই অন্যায় জুলুম করে নিপীড়িত মানুষের অধিকার ভুলন্ঠিত করার চেষ্টা করেছে তারা অধিকাংশ সময় কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ক্যান্সারের ন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এমন একটি দেশও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দেশ ও দেশের নাগরিকরা সন্ত্রাসের ভয়ে আতংকিত নয়, এক কথায়, সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল সন্ত্রাসের কারণে পদে পদে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে সভ্যতা। একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় মারা যাচ্ছে মানুষ। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। বিশ্বের যেখানেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে পাশ্চাত্য মুসলমানদের যোগসূত্র আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। যদি কোনো মুসলিম এ ধরনের কাজ করে তবে তা করে ইসলামের সীমা লংঘন করে। এ ধরনের কাজ মুসলিম উম্মাহ সমর্থন করে না। অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ সন্ত্রাসের সাথে মুসলমানদের দূরতম সম্পর্ক নেই। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিকার আদায়ের জন্য যারা লড়াই করে তাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা সমীচীন নয়। যেমন কাশ্মীরে ও ফিলিস্তিনের মুসলিম জনগণ যা করছে তা করার অধিকার তাদের আছে, এটা সন্ত্রাস নয়। বিশে^র যে কোনো ভূখন্ডে মুসলমানরা যদি তাদের ন্যায্য স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন সংগ্রাম করে, তাহলে তাদেরকে উগ্র, সন্ত্রাসী বা মৌলবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অথচ ইসরাইল, আমেরিকা, রাশিয়া কিংবা মিয়ানমারের মতো দেশ যখন স্বাধীন ভূখন্ড দখল ও নিরপরাধ মানুষের রক্তের খেলায় মেতে উঠে, তখন তাদের কেউ সন্ত্রাসী কিংবা উগ্রবাদী বা মৌলবাদী বলে না।
শোকে স্তব্ধ নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। ১৫ মার্চ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টার্চে আল নূর মসজিদ ও লিনউড মসজিদে হামলায় ৫০ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা বিশ্বের বিবেকমান মানুষের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া মুসলমানের পক্ষে এসেছে তা সত্যিই ইতিবাচক। একজন অমুসলিম ফুটবলার খেলার মাঠে সিজদা দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছে। হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্টের মনে কতটা বিদ্বেষ জমা হয়েছিল তা অর্ধশত মুসলমানকে হত্যার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়েছে। সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ও সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। ওই নরঘাতককে হত্যার অভিযোগে যখন গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করা হলো, তখনো তার মনের মধ্যে কোনো অনুশোচনার ছাপ দেখা যায়নি। শে্বতাঙ্গ আধিপত্যবাদের ধারণা নতুন নয়! বরং বহু পুরাতন। তারই ধারাবাহিকতায় আমেরিকায় কু ক্লাক্স ক্ল্যানের (কেকেকে) মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক হিংস্র গোষ্ঠির সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মসজিদে হামলা করে মুসলমান হত্যার এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা দেখা যায়নি। হত্যাকারী ঠান্ডা মাথায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হামলা চালানোর আগে ট্যারেন্ট তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ৭৪ পৃষ্ঠার কথিত একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। আর নিজের ফেসবুক পেজে সরাসরি হামলার ঘটনা সম্প্রচার করে। হামলার পর ফেসবুক ও টুইটার কর্তৃপক্ষ তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়। এরা নাকি শান্তিপ্রিয় মানুষ! সাদা চামড়ার মানুষেরা মানুষকে হত্যা করলে সন্ত্রাসী হয় না। অথচ মুসলিম হলেই সন্ত্রাসী তকমা পেতে হয়। সন্ত্রাসী ট্যারেন্টের গুলিতে যেসব মানুষ নিহত হয়েছে তাদের মাঝে অনেক শরণার্থীও ছিল, যারা নিজ দেশে বাঁচতে না পেরে ওই দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা হৃদয়ের সমস্ত ঘৃণা দিয়ে এ হত্যার নিন্দা জানাচ্ছি।
নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু সন্ত্রাসী ঘটনার তথ্য দিলেই অনুধান করা যাবে পৃথিবীকে কারা নরকে পরিণত করছে। এর আগেও একশ্রেণির সাদা উগ্রবাদী মসজিদে হামলা করেছে। ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেক সিটি মসজিদে গুলি করে ৬ জনকে হত্যা করে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামে এক উগ্রবাদী। ২০১১ সালে নরওয়ের অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করে। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত ঘটনা ২০১৬ সালের জুনে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোর সমকামীদের নাইটক্লাবে ঘটেছিল। ওই ঘটনায় ৪৯ জন মানুষ নিহত হয়েছিল। টুইন টাওয়ারের ন্যাক্কারজনক হামলার পর সম্ভবত এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতম ও ভয়াবহ হামলা। হামলাকারী স্টিফেন প্যাডক খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরও দায়টা তার সম্প্রদায়কে নিতে হয়নি। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার নগরীর এরিনা কনসার্ট হলে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে শিশুসহ ২২ জন নিহত এবং ৫৯ জন আহত হয়। ২০০৪ সালে মাদ্রিদে ট্রেনে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় ১৯১ জন। এক অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মাত্র ২% ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৫২টি সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে মাত্র ১% ও ২০১২ সালের ২১৯টি হামলার মধ্যে মাত্র ৩% হামলা ধর্মীয় উগ্রবাদের ফসল। ওই সময়ের সংগঠিত আক্রমণগুলোর সিংহভাগই উগ্র জাতীয়তাবাদী অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ৫৫% হামলার কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ২০১২ সালের অধিকাংশ হামলা অর্থাৎ ৭৬% হামলার কারণ জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সন্ত্রাসের বীজ প্রথম ইহুদি-খ্রিস্টান-বৌদ্ধরাই পৃথিবীতে রোপণ করেছে। হিটলার ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। অথচ মিডিয়া তাকে খ্রিস্টান টেররিস্ট কিংবা জঙ্গী বলেনি। জোসেফ স্ট্যালিন ২০ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছে এবং তার কারণে ১৪.৫ মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয়ে ধুকে ধুকে মারা গেছে। মাও সে তুং ১৪ থেকে ২০ বিলিয়মন মানুষ হত্যা করেছে। মুসলিনী ইটালীর ৪ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। অশোক (কালিঙ্গা বেটল) লাখ মানুষ হত্যা করেছে। অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য ২০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। যারা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল তারা কি মুসলিম ছিল? যারা আমেরিকা আবিষ্কারের পর নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য উত্তর আমেরিকাতে ১০০ মিলিয়ন এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে ৫০ মিলিয়ন রেড-ইন্ডিয়ানকে হত্যা করেছিল তারা কি মুসলমান ছিল? যারা ১৮০ মিলিয়ন আফ্রিকান কালো মানুষকে কৃতদাস বানিয়ে আমেরিকা নিয়ে গিয়েছিল, যাদের ৮৮ ভাগ সমুদ্রেই মারা গিয়েছিল এবং তাদের মৃতদেহকে আটলান্টিক মহাসাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তারা কি মুসলমান ছিল? জজ বুশ ইরাকে, আফগানিস্থানে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ হত্যা করেছে। এখনো মায়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গাদের খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আমেরিকায় ইসলামি সন্ত্রাসীদের হাতে যত মানুষ নিহত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি নিহত হয়েছে ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গদের হাতে। একই তথ্য পাওয়া গেছে ২০১৭ সালের জুনে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগ্যাটিভ রিপোর্টিং কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণায়।
শ্বেতাঙ্গরা সবাই সন্ত্রাসী তা আমরা বলছি না। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের নির্মম হত্যাকাণ্ডে ক্ষত শুকাতে না শুকাতে পূর্ব লন্ডনের একটি মসজিদের বাইরে একজন মুসল্লীকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার দৃশ্য বিশ^বাসী অবলোকন করেছে। ব্রেন্টন ট্যারান্ট মসজিদে হামলা চালিয়ে মুসলমানদের হত্যা করে গর্ববোধ করেছে। অথচ তাকে পশ্চিমা বিশে^র মোড়লরা সন্ত্রাসী বলতে নারাজ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন পৈশাচিক ঘটনা এখন যেন নিয়মিত হয়ে উঠেছে। পরিশেষে বলতে চাই, সন্ত্রাসের জন্য কোনো বিশেষ রং বা বিশেষ কোনো ধর্ম দায়ী নয়। সন্ত্রাসীরা নানা কারণে উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়ে যায় এবং ছোট বড় সন্ত্রাসের ব্যাপার ঘটায়। এব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, কালোর উপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নাই, সাদার উপর কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নাই, আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নাই এবং অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নাই। যারা সন্ত্রাসের জন্য কোনো ধর্মকে দায়ী করেন বা কোনো রংকে দায়ী করেন এবং কোনো নির্দিষ্ট জাতিকে দায়ী করেন- তারা ভুল করেন। পাশ্চাত্যে যে মুসলিমদের সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়াবার চেষ্টা করা হয় তা নৈতিকতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, যারাই এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকুক তাদেরকে শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক যাতে করে সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষ চিরতরে উৎসাদিত হয়- এটাই শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন