বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সিদ্দিকী যুগে লেখা কোরআন উদ্ধার

প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কে. এস সিদ্দিকী : যুগে যুগে মুসলিম বিজ্ঞানী গবেষক ও মনীষী প-িতদের নানা ক্ষেত্রে উদ্ভাবন-আবিষ্কার অমুসলিম বিজ্ঞানী লেখকদেরকেও দারুণভাবে বিস্মিত এমন কি ঈর্ষান্বিতও করেছে। অনেকে মুসলমানদের সেসব আবিষ্কার-কীর্তিকে উদার দৃষ্টিকোণ ও নিরপক্ষভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হলেও অনেকে সেগুলোকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আবার কেউ কেউ মুসলমানদের  আবিষ্কারকে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টাও কম করেননি। এসবই সত্য, ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা লেখক-গবেষকগণের অনেকে নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান-আবিষ্কারকে খ-িত বা বিকৃতভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
কোরআনুল কারিম সম্পর্কেও বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা ওদের মজ্জাগত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। নুজূলে কোরআনকে সংশয়যুক্ত করা, বিকৃত করা এবং কোরআন সংকলনের ইতিহাসকে বিতর্কিত করা বিশেষত: হযরত উসমান (রা.) কর্তৃক কোরআন সংগ্রহ করে তা প্রচার ও প্রকাশ করার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রবণতা এখনো লক্ষ্য করা যায়। সত্য ঘটনাকে আড়াল করে হযরত উসমান (রা.) কে মূল সংকলক আখ্যায়িত করে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি কোরআনে নিজের কথার ও মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এর ফলে এক শ্রেণীর মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। অথচ হযরত উসমান (রা.) ছিলেন জামেউল কোরআন বা কোরআন একত্রিতকারী।
আনন্দের বিষয় যে, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে হযরত আবু বকর (রা.)’র লেখা কোরআন পাওয়া যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবর সঠিক হলে কোরআন সংকলন সংক্রান্ত বিরুদ্ধবাদীদের সকল বিতর্ক-বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের অবসান ঘটবে। গত ২৫ ডিসেম্বর (২০১৫) দৈনিক ইনকিলাবে এ আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবরটি প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই কোরআনের কিছু অংশের শীর্ষভাগের আলোক চিত্রও প্রদত্ত হয়েছে এবং ক্যাপশনে বলা হয়েছে : গত জুলাইয়ে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্রগ্রন্থ আল কোরআনের কিছু অংশ খুঁজে পাওয়ার দাবি করে।
সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দদায়ক নতুন খবর, যা সবচেয়ে বড় মুসলিম অবিষ্কার যার সুদূরপ্রসারি সুপ্রভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হবে। ইসলামের প্রথম খলিফা, প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী এবং মহানবী (সা.)-এর অন্তরঙ্গ সঙ্গী হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) হুযুর (সা.)-এর সমগ্র নবুওয়াত-রেসালত জীবনে অবতীর্ণ এবং বিক্ষিপ্ত ও নানাভাবে সংরক্ষিত সমস্ত আয়াত সুরাগুলোকে একাট্টাও একত্রিত করে যে, সংকলন বিন্যস্ত করেছিলেন তারই আবিষ্কার এ যুগের এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিস্ময়কর ঘটনা। কোরআন সম্পর্কে নানাভাবে যারা ধুম্রজাল বিস্তার করতে চেয়েছিল, এ ঐতিহাসিক আবিষ্কারের ফলে তাদের মুখে ছাই পড়েছে।
ইনকিলাবে প্রকাশিত এ খবরে বলা হয়েছে এক হাজার ৩৭০ বছরের পুরোনা কোরআনের একটি কপির সন্ধান পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পবিত্র কোরআনের এ কপিটি মহানবী (সা.)-এর অন্যতম সাহাবি হযরত আবু বকরের (রা.) লেখা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কোরআনের এ কপিটিকেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দি ইনডিপেনডেন্টের খবরে এতথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক স্টাডিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দামাল বিন হুয়াব্বি কোরআনটিকে হযরত আবু বকরের (রা.) মনে করছেন। তার মতে, এ ধরনের একটি নথি খুব কম সংখ্যক লোকের কাছেই সংরক্ষিত থাকতে পারে। সে হিসেবে হযরত আবু বকরের কপিটি থাকার সম্ভাবনা বেশি। হুয়াব্বি বিবিসিকে বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এই কোরআন আবু বকরের (রা.)। এটি এখন পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বলেন হুয়াব্বি। আমিরাতের এ গবেষকের মতে, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাওয়া কোরআনে ব্যবহৃত চামড়ার কাগজ এবং হাতের লেখাগুলো দেখে মনে হয়, ২০০ পাতার মূল কপিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির জন্য তৈরি করা হয়। মহানবীর (সা.) পরিবারের বাইরে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে সুপরিচিত হযরত আবু বকর (রা.)। তিনি মহানবী (সা.) বিশ্বস্ত সাহাবি ছিলেন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন আবু বকর (রা.)। ৬৩৪ মৃত্যুর আগে তিনি ২৭ মাস ক্ষমতায় ছিলেন।
আমিরাতের গবেষক হুয়াব্বির বক্তব্য হতে জানা যায় যে, ২০০ পাতার মূল কপিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তির তৈরি করা হয় এবং এ কোরআনে ব্যবহৃত চামড়ার কাগজ এবং তা হাতে লিখিত। আলোক চিত্র দেখলে মনে হয় এটি সুদক্ষ লিপিকারের নিপুণ কাজ। তখন সাহাবিদের মধ্যে দক্ষ লিপিকারও ছিলেন। চামড়ার কাগজে এতো নিপুণভাবে কোরআন লেখার ঘটনাও বিস্ময়ের ব্যাপার। উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (স:)-এর সময়ে সাহাবিগণ অর্থাৎ ওহি লেখকগণ খেজুরের পাতা, চামড়া, পাথর ইত্যাদিতে কোরআনের বিক্ষিপ্ত আয়াতগুলো হাতে লিখে সংরক্ষণ করে রাখতেন। আবার অনেকে মুখস্থ করে রাখতেন বলে লিখিত প্রমাণাদি রয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত জায়দ বিন সাবেত (রা.) তাদের মধ্যে অন্যতম। এরূপ ওহি লেখকদের সংখ্যা চল্লিশজন পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এখানে আরো স্মর্তব্য যে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, আল্লাহ তালার পক্ষ হতে কোরআনে নাজেল হওয়ার দুটি পদ্ধতি ছিল। প্রথমত : আল্লাহতালার জাতসত্তার পক্ষ হতে একই দফায় লৌহ মাহফুজে নাজেল করা হয়। দ্বিতীয়ত : ক্রমান্বয়ে জিবরাইল (আ.)-এর নিকট প্রেরণ করা হয়। দুনিয়াতেও কোরআন দুই পদ্ধতিতে অবতীর্ণ হয়। প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সা:) জিবরাইল (আ.) হতে গ্রহণ করেন। আর তা হচ্ছে, যখন আল্লাহতালা কোনো ঘটনা প্রসঙ্গে ওহি নাজেল করার ইচ্ছা করতেন তখন তৎসম্পর্কিত আয়াত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত জিবরাইল (আ.)-এর কাছ থেকে লাভ করতেন। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিছিল এই যে, প্রত্যেক বছর রমজান শরীফে হযরত জিবরাইল (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনতেন যাকে ‘দওর’ বলা হয়। আর যে বছর তার ওফাত হয় সে বছর দুইবার শোনেন।
উল্লেখিত বিবরণের আলোকে বিশেজ্ঞগণ বলে থাকেন যে, কোরআন নাজেল করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কলব অর্থাৎ অন্তরে-মনে স্থির করে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রচার-প্রকাশের নির্দেশ ছিল না বরং প্রচারের জন্য যা অবর্তীণ হয়েছিল তা ক্রমে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচার করা হয়। এ সূক্ষ্ম ব্যাখ্যাটি কোনো কোনো  তফসীরে বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কালামে এলাহী রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর মনে জমা হয়েছিল কিন্তু প্রচারের জন্য পর্যায়ক্রমে নাজেল করা হয়।  সংক্ষেপে বলা যায়, নুজূলে কালবী অর্থ্যাৎ অন্তরে এলকা হওয়া এবং লৌহ মাহফুজের লিখন আর যখনই হুজুর (সা.) প্রচার করেছেন, সাহাবাগণ তা মুখস্থ করেছেন।
কোরআনের আয়াত নাজেল হওয়ার বিষয়টি সাহাবাগণ দুইভাবে অবগত হতে পারতেন। এক প্রকার হচ্ছে, যখন কোনো আয়াত হতো তখন হুজুর (সা.) বলে দিতেন যে, আয়াতটি অমুক সূরার অমুক আয়েতের পর রাখতে হবে এবং সেখানে স্থাপিত হতো। আর অপর নিয়মটি ছিল এই যে, খোদ হুজুর (সা.) তেলাওয়াত করতেন। বিশেষত: নামাজে তিনি সূরাগুলো পাঠ করতেন, যাতে জানা যেতো যে, কোনো সুরার কত আয়াত এবং কোন আয়াতের পর কোন আয়াত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও সাহাবাদের কাছ থেকে কোরআন শ্রবণ করতেন। এ কারণে তারা পূর্ণভাবে জেনে যেতেন, যা তারা পাঠ করতেন তা সঠিক সুবিন্যস্ত ধারাবাহিক কি-না। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজ পড়ার সময় সূরাগুলো ধারাবাহিক পড়তেন।
এবার দেখা যাক কোরআন কি পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করা হলো। একথা ঠিক যে, সাহাবাগণের অধিকাংশের কোরআন মুখস্থ ছিল। তাদের তা লেখার বা লিপিবদ্ধ করে রাখার প্রয়োজন ছিল না। তা সত্ত্বেও তাদের যুগে কেতাবত বা কোনো কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখার নিয়ম প্রচলিত ছিল। সেদিক বিবেচনা করে তারা কোরআন লিপিবদ্ধ করেন। সে যুগে কাগজ ছিল দুর্লভ, চীন ও ভারতবর্ষ হতে আরবে কাগজ আসতো। যৎ সামান্য কাগজ পাওয়া যেতো তাতে কোরআন লিপিবদ্ধ করা হয় এবং আরবরা হাড়ের ওপরও লিখতো, চামড়া এবং পাথরের ওপরও লিখতো। তাই কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাথারের ওপরও লেখা হয়েছে, কাঠের তক্তায়ও লেখার প্রচলন ছিল, তাতে কোরআন লেখা হয়েছে, গাছের পাতায়, গাছের ছালেও লেখা হয়েছে। মোটকথা, লিপিবদ্ধ করার যত রকমের পদ্ধতি-উপায় হুজুর (সা.)-এর সময়ে প্রচলিত ছিল, সবই কাজে লাগানো হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-ই ছিলেন কোরআনের আসল সংকলক যার কিছুটা বর্ণনা প্রদত্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে আরো বলা হয়ে থাকে যে, তিনি জীবদ্দাশাতেই তাঁর তরযীব অর্থ্যাৎ বিন্যাস সাধন করেছিলেন। বর্ণিত আছে যে, যখন কোন আয়াত নাযীল হতো, তখন কিবাতে ওহি অর্থ্যাৎ ওহি লেখক কোনো সাহাবীকে তা লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন যে অমুক সূরায় তা লিখে রাখো। (মিশকাত) এতে প্রমাণিত হয় যে, সূরাগুলো যথাস্থানে বিন্যস্ত করার এবং সেগুলোর নামকরণ খোদ হুজুর (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তখন আয়াত-ওয়াত্তাকু ইয়াওমান তোরজাউনা ফিহি ইলাল্লাহ নাজেল হয়, তখন হযরত জিবরাইল (সা.) বললেন, এটি সূরা বাকারার ২৮০নং আয়াতের পর লিখিয়ে দিন। (খাজেন) এতে আরো প্রমাণিত যে, আয়াতগুলোর ক্রমিক নং এবং প্রতি সুরার বিদ্যমান স্থান হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। অর্থ্যাৎ সুরাগুলোর নাম ও স্থান হুজুর (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত।
একটি বর্ণনা অনুযায়ী বিভিন্ন ওহি লেখক নিজেরাই কোরআনের বিভিন্ন অংশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এসব বিশিষ্ট সাহাবার মধ্যে হযরত আলী (রা.) হযরত মোয়াজ  ইবনে জাবাল (রা.), হযরত ওবাই ইবনে কাব (রা.), হযরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কোনো কোনো বর্ণানায় ওহি লেখকদের সংখ্যা চল্লিশ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। তারা সবাই নিজেদের লিখিত অংশগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.)কে পড়ে শুনাতেন। হযরত জায়দ ইবনে সাবেত (রা.) কোরআন হাকীমের বহু অংশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং সেগুলো হুজুর (সা.)কে পাঠ করে শুনাতেন এবং সেই মোতাবেক তিনি নামাজে তেলাওয়াত করতেন। সুতরাং অকাট্যরূপে প্রমাণিত যে, বর্তমান কোরআনের প্রকৃত সংকলক খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) তবে এ কথা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন দুনিয়া ত্যাগ করেন তখন কোরআন বর্তমান কিতাব আকারে লিখিত ছিল না, তার আয়াতসমূহ এবং সুরাগুলো বর্তমানের ন্যায় ক্রমানুসারে বিন্যস্ত ছিল, ব্যতিক্রম ছিল এই যে, কোরআনের অংশ বা খ-গুলো কাপড়ের টুকরায়, খেজুরের পাতায়, গাছের ছাল এবং উট ও বকরির কাঁদের হাড়ে লিখিত ছিল এবং তার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন লোকের নিকট সংরক্ষিত ছিল। এসব বিক্ষিপ্ত অংশ বা খ-কে কিরূপে কিতাব আকারে লিখিত ও বিন্যস্ত করা হয় তা এক ভিন্ন কাহিনী। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন