মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দুর্দশায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম | আপডেট : ১২:২৬ এএম, ৬ এপ্রিল, ২০১৯

০ অধিকাংশই ভাঙাচোরা ও বিপজ্জনক
০ চাহিদার বিপরীতে আছে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ
০ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুম আসন
০ বুক কাঁপে ৫ কোটি উপক‚লবাসীর

ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুম ঘনিয়ে এসেছে। সর্বনাশা গর্কির বিপদ আপদ যখন ঘাঁড়ে নিঃশ্বাস ফেলে তখনই বুক কাঁপে দেশের ২১টি উপক‚লীয় জেলার বঙ্গোপসাগরের কিনারের কমপক্ষে ৫ কোটি বাসিন্দার। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের সময়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে ছুটে গিয়ে জীবন রক্ষার জন্য চাই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার। যা উপক‚লবাসীর কাছে তাৎক্ষণিক এবং সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
অথচ বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বর্তমানে চরম দুর্দশায় রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের আশ্রয় নেয়াও অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ-শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ-উখিয়া, কক্সবাজার সদর-মহেশখালী-কুতুবদিয়া থেকে শুরু করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঁশখালী-আনোয়ারা-স›দ্বীপ, বন্দরনগরীর পতেঙ্গা-হালিশহর-কাট্টলী, সীতাকুন্ড-মীরসরাই হয়ে ফেনী-নোয়াখালী, ভোলা-পটুয়াখালী-বরিশাল, খুলনা অঞ্চল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের কোলে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, এই বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপক‚লভাগে, চর ও দ্বীপাঞ্চলের অন্তত ৫ কোটি মানুষের জীবন সুরক্ষায় যথাযথ মানসম্মত এবং বহুমুখী ব্যবহারের সুবিধাসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন কমপক্ষে ৮ হাজার। অথচ সেক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৫শ’। অর্থাৎ আশ্রয়কেন্দ্রের ন্যুনতম চাহিদার তুলনায় ছোট-বড় মিলিয়ে বাস্তবে রয়েছে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগেরও কম। তাছাড়া অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রই ভাঙাচোরা, পুরনো ও জরাজীর্ণ।
বিগত ১৯৭০, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১ সালের সালের ভয়াল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের পর নির্মিত হয়। এরমধ্যে কিছু কিছু সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুল এবং বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্মিত হয়। তবে অনেকগুলো গতানুগতিক আদলে যেনতেন প্রকারে তৈরি করা হয়। জরাজীর্ণ অনেক আশ্রয়কেন্দ্র মানুষের পক্ষে আশ্রয় নেয়ারও উপযোগী নয়। বরং ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রায় সারাবছর সেগুলো প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকছে। অনেক স্থানেই ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর নিয়মিত সংস্কার, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এতে করে নাজুক দশায় গিয়ে ঠেকেছে। দেশের সমুদ্র উপক‚লজুড়ে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর বিরাজমান নাজুক অবস্থা যাচাই ও সংস্কার, পুনঃনির্মাণের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নেই। অনেক স্থানে কোনো কোনো এনজিও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকাজে ‘নয়-ছয়’ অনিয়ম করে পার পেয়ে গেছে। তাছাড়া নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্র বা শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেই। এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের মৌসুমে অরক্ষিত অবস্থায় এবং দুর্যোগের আতঙ্কে দিনাতিপাত করে থাকেন কোটি কোটি উপক‚লবাসী।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ এজে এম গোলাম রাব্বানী এ প্রসঙ্গে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দেশের সমুদ্র উপক‚লভাগে বিশেষত চর ও দ্বীপ জনপদে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজনের তুলনায় আছে মাত্র এক তৃতীয়াংশ। তাও অনেকগুলোই পুরনো, জরাজীর্ণ ও ভাঙাচোরা। পুরনো অনেক সাইক্লোন শেল্টার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নোয়াখালীর হতিয়া দ্বীপ, চট্টগ্রামের সদ্বীপ, ভোলা, বরিশাল ও কক্সবাজারের বিভিন্ন প্রত্যন্ত উপক‚লীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে দুর্যোগকালীন মানুষ কীভাবে আশ্রয় নেবেন? তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের সময়ে সমুদ্র উপক‚লের জনগণ তাদের জীবনটুকু বাঁচানোর তাগিদে বিপদ সঙ্কেত পেয়ে প্রথমেই সাইক্লোন শেল্টারে ছুটে গিয়ে আশ্রয় খোঁজেন। তাই তাদের জন্য পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে দেশের উপক‚লবাসীর জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন জড়িত।
বিগত ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের পর তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল হকের নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ শেষে ১৭ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা পেশ করে। এরমধ্যে শীর্ষে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল দেশের সমুদ্র উপক‚লভাগ, চর ও দ্বীপাঞ্চল, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ সুরক্ষায় উঁচু ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং প্রতিটি উপক‚লীয় এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বা বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন করতে হবে। একই বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মহল এবং দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোও তাগিদ দিয়ে আসছে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের কিনারভাগে ও হিমালয় পাদদেশে ভৌগোলিক বিশেষ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের নানাবিধ ধকল পোহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ধারা এবং বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করছে। বিগত ৪৭ বছরে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসসহ প্রায় ২৫০ দফা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। এরজন্য পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারসহ উপক‚লে টেকসই ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।
চলতি এপ্রিল (চৈত্র-বৈশাখ) ও আগামী মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, এই দুই মাসে বঙ্গোপসাগরে ২ থেকে ৪টি নি¤œচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে ঘনীভূত হয়ে এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আবহাওয়া নেটওয়ার্ক ও বিশ্লেষকদের কাছে ‘এল নিনো’ অবস্থার আলামত স্পষ্ট হয়েছে। যা বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশসমূহ এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস, হঠাৎ বন্যা, টর্নেডো, বজ্র-ঝড় বা বজ্রপাত আঘাত হানার এবং বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এহেন বৈরী আবহাওয়া-প্রকৃতি চলতে পারে আগামী জুন মাস পর্যন্ত। এতে করে আবহাওয়া-জলবায়ু, প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বিশৃঙ্খল এবং এলোমেলো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন