শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সারা দেশে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট

১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ১৭ এপ্রিল, ২০১৯

পাটকল শ্রমিকদের পর এবার ১১ দফা দাবি আদায়ে ধর্মঘট করছে নৌযান শ্রমিকরা। সারা দেশে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটে বন্ধ হয়ে গেছে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর ও কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটে বন্ধ রয়েছে পণ্য ওঠানামা। একই চিত্র সারা দেশের নৌবন্দরে। এ অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা। তবে, ধর্মঘটের মধ্যেই সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং লঞ্চ মালিক সমিতির এক অংশ। গতকাল মঙ্গলবার ধর্মঘটের কারণে ভোর থেকে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি কোনো লঞ্চ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এমন আশায় অনেকেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন ঘাটে।
নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদ ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা সমাধনের চেষ্টা করছি।
সোমবার রাতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। তবে বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। নৌযান প্রমিক নেতাদের মধ্যে বিভেদের কারণেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আবারও নৌযান শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠকে করেছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। বৈঠকে বাংলাদেশ নৌযান ফেডারেশনের অন্য নেতাদের সঙ্গে গতকাল রাতের বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও অংশ নেবেন।
গতকাল ধর্মঘটের কারণে রাজধানীর সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি কোনো লঞ্চ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এমন আশায় অনেকেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন ঘাটে। ধর্মঘটের খবর পেয়ে সদরঘাট টার্মিনাল থেকেই ফিরে যান অনেকে। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন, নৌযান ও নৌপথে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ২০১৬ সালে ঘোষিত বেতন স্কেলের পূর্ণ বাস্তবায়ন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা করা ১১ দফা দাবিতেই এ কর্মসূচি। ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রামে পণ্য বোঝাই প্রায় ৩০০ লাইটার জাহাজ বিভিন্ন ঘাট ও নদীতে আটকা পড়েছে। একই অবস্থা বরিশাল, খুলনা, মোংলা, চাঁদপুর, লক্ষীপুর ও শরীয়তপুরের নৌ বন্দরে। ধর্মঘটের কারণে এসব এলাকার নদী বন্দর থেকে কোনো নৌযান ছেড়ে যায়নি। পণ্য পরিবহনেও চরম ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সারা দেশের ২০ হাজার নৌযানের প্রায় ২ লাখ শ্রমিক কর্মবিরতি পালন করছে বলে জানিয়েছে, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। নৌ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এই ধর্মঘটের বিষয়ে কিছুই করার নেই তাদের। কারণ, নৌপথে চাঁদাবাজির ঘটনা দেখার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আর শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখার কথা শ্রম মন্ত্রণালয়ের।
সারাদেশ থেকে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, বরিশাল ব্যুরো জানান, দেশব্যাপী নৌযান শ্রমিক-কর্মচারী ধর্মঘটে দক্ষিনাঞ্চলের অন্তত ৫০টি রুটে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে সোমবার মধ্য রাতে। তবে সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টার মধ্যে ঢাকা নদী বন্দর ছেড়ে আসা প্রায় অর্ধশত যাত্রীবাহী নৌযান গতকাল সকালে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা ও ঝালকাঠী নদী বন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘাটে যাত্রী নামিয়ে মাঝ নদীতে নোঙর করে রয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন নৌযানই ফিরতি ট্রিপে যাত্রী পারাপারের কথা বলছে না। নৌযান শ্রমিকরা তাদের ১১দফা দাবিতে এ ধর্মঘট শুরু করেছে।
ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত নদী বন্দর বরিশালসহ দক্ষিনাঞ্চল থেকে রাজধানীমুখী অর্ধশত নৌযানও বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন প্রায় ৪৫টি রুটেও কোন নৌযান চলছে না। ফলে হাজার হাজার যাত্রী দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আটকা পড়েছে। গতকাল বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুর থেকে বিআইডব্লিউটিসি’র কোন স্টিমার ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়নি। তবে সংস্থাটির ৫টি যাত্রীবাহী নৌযান সচল রয়েছে। খুলনা ব্যুরো জানায়, ১১ দফা দাবিতে খুলনায় অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন নৌযান শ্রমিকরা। শ্রমিকদের এ ধর্মঘটে খুলনা অঞ্চলে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সোমবার দিবাগত রাত ১২টা এক মিনিট থেকে এ নৌ ধর্মঘট চলছে। এতে খুলনা ও মোংলা বন্দরে পণ্যবাহী নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নৌপথে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ডাকাতি বন্ধ, ২০১৬ সালের ঘোষিত বেতন স্কেলের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস দেওয়া ও হয়রানি বন্ধ, নদীর নাব্যতা রক্ষা, নদীতে প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন। অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘটের ফলে গতকাল মঙ্গলবার খুলনার বিআইডব্লিউটিএ ৪, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ঘাট এবং রুজভেল্ট জেটিতে অবস্থানরত কোনো জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হয়নি। এমনকি মোংলা বন্দর থেকে যশোরের নওয়াপাড়া পর্যন্ত কোথাও কোনো নৌযান চলছে না। বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, কেন্দ্রের ডাকা ধর্মঘট খুলনা ও মোংলায় সর্বাত্মকভাবে পালিত হচ্ছে।
লক্ষীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, নৌ-পথে চাঁদাবাজি, শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ ও নৌ শ্রমিকদের বেতন ভাতা পুনঃনির্ধারণসহ ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছে নৌ শ্রমিকরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে এ কর্মসূচিটি পালন করছে লক্ষীপুরের নৌ শ্রমিকরা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কর্মবিরতির কারনে ভোর থেকে লক্ষীপুর সদর উপজেলায় মজুচৌধুরীর হাট ঘাট থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার কোন নৌযান ছেড়ে যায়নি। এতে দূর্ভোগে পড়েছেন এ নৌ-রুটে চলাচল করা দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সাধারণ মানুষ।
মজু চৌধুরীর হাট লঞ্চ ঘাটের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আই ডব্লিও টি’র পরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম জানান, সারাদেশেই আন্দোলন হচ্ছে। সকাল থেকে শ্রমিকরা কাজ না করলেও সরকারি তিনটি সী-ট্রাক নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে গেছে ভোলার উদ্দেশ্যে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সংবাদদাতা জানান, নৌপথে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও ডাকাতি বন্ধসহ ১১ দফা দাবিতে গত সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে নৌযান শ্রমিকদের অনিদিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছে শ্রমিকরা। কেন্দ্রীয় নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে এ কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। নৌযানগুলো নদীবন্দরে নোঙ্গর করে রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্য নিয়ে আসা প্রায় দু শতাধিক কার্গো জাহাজ আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আটকে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে আশুগঞ্জের সাথে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় ৬টি নৌ-রুটের ৫ জেলা সিলেট, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৪ উপজেলার লঞ্চ যোগাযোগ। চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে লঞ্চ যাত্রীদের। বন্ধ হয়ে গেছে নদীবন্দরের সকল প্রকার কার্যক্রম। বেকার হয়ে পড়েছে বন্দরের প্রায় ৫শতাধিক শ্রমিক।
পূর্বাঞ্চলীয় কার্গো মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. নাজমুল হোসাইন হামদু জানান, ধর্মঘটের কারনে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত জরুরি কাচাঁমাল নিয়ে জাহাজ আটকা পড়ায় মালামাল পরিবহণ ব্যাহত হচ্ছে। এ মুহুর্তে জাহাজ বন্ধ থাকলে আমরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো।
মংলা সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিকদের ১১ দফা দাবিতে সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিটে কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। ফলে সোমবার মধ্যরাত থেকে মংলা বন্দরে পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহনের কাজ বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তি ও ক্ষতির মুখে পড়েছেন আমদানি ও রফতানিকারকরা।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে বন্দরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি বানিজ্যিক জাহাজে মালামাল খালাস কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
নৌযান ধর্মঘট কর্ণফুলীতে অলস ১৫০ লাইটারেজ জাহাজ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নৌযান শ্রমিকদের ডাকা ঘর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য ওঠানামা বন্ধ রেখেছেন লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকরা। কর্ণফুলী নদীতে অলস বসে আছে প্রায় দেড়শ লাইটারেজ জাহাজ। একইভাবে পণ্য নেওয়া ও খালাসের অপেক্ষায়ও বন্দরের বহির্নোঙ্গরে বসে আছে বেশকিছু মাদার ভ্যাসেল। চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে স্বাভাবিক থাকলেও সার্বিকভাবে পণ্য পরিবহন ও উঠানামায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।
১১ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন সোমবার রাত ১২টা থেকে দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করেছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক লাইটারেজ জাহাজগুলোর কার্যক্রমে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ জানান, ধর্মঘটের কারণে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাট ও সংলগ্ন নদীতে প্রায় ১৫০ জাহাজ অলস বসে আছে। ৫০টি জাহাজ পণ্য খালাসের জন্য বহির্নোঙ্গরে গেলেও সেখানে কাজ করছেন না শ্রমিকরা। এতে সেই জাহাজগুলোও সেখানে অলস সময় পার করছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দরের ভেতরে জেটিতে পণ্য খালাসে কোনো সমস্যা নেই। এখানে তো লাইটারেজ শ্রমিকদের কোনো কাজ নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে বর্হিনোঙ্গরে। সেখানে পণ্য উঠানামা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে তো মাদার ভ্যাসেলগুলোর ওপর ওয়েটিং চার্জ আরোপ হবে। এখন পর্যন্ত সমস্যা নেই। তবে ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর পরিস্থিতি অবনতির দিকে দিকে যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন