রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

শল্য চিকিৎসায় রোবট : বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থাইল্যান্ড

ডা. জহুরুল হক | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৯, ৮:২৬ পিএম

ইনকিলাব পরিবারের সাথে পূর্ব পরিচিতি এবং সখ্যতার কারনে আবারও বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল থাইল্যান্ড তাদের দ্রæত জনপ্রিয় হয়ে উঠা রোবটিক সার্জারির কিছু কার্যক্রম শেয়ার করার জন্য এই পরিবারকে তাদের হাসপালে আমন্ত্রন জানায়। এতে সাড়া দিয়ে জাতীয় দৈনিকটির ডিরেক্টর এডমিন ও মার্কেটিংয়ের জনাব মোহাম্মদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি দল সম্প্রতি হাসপাতালটি ভ্রমনে যায়। বিকাল ৫ টায় আমরা সুবর্ণভুমি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরন করলাম। এখান থেকেই তাদের আতিথেয়তার শুরু। বিমান বন্দরেরই আছে আগত রুগী এবং অতিথিদের জন্য তাদের নিজস্ব অভ্যর্থনা কক্ষ। এখানে হাজির হওয়ার পর ওরাই পরবর্তী করনীয় ঠিক করে দিল। আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেয়ার জন্য দ্রতই হাসপাতালটির গাড়ি এসে হাজির। দেখতে পেলাম, আমাদের সাথে আগত বেশীর ভাগ রুগী হাসপাতালটির নিজস্ব হোটেলেই স্থান নিচ্ছে। আর আমাদের মত অনেকে আবার হাসপাতাল লাগোয়া কোন হোটেলে স্থান পেয়েছে। বিমান বন্দর কাউন্টারের স্টাফরা কাগজপত্র দেখে হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্টের স্থান ও তারিখ, থাকার হোটেল, খাবার জায়গা সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে দিলেন। বাহিরে অপেক্ষমান গাড়ি পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে এলেন এখানকারই এক স্টাফ। জানতে পারলাম খুবই অসুস্থ রোগীদের জন্য আরও দ্রæত জরুরি বিভাগে পৌঁছাতে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আছে ভিআইপি ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা। আর দিনরাত সবসময়ই হাসপাতালের মত এই সেন্টারটিও বিমান বন্দরে আগত বামরুনগ্রাদের রোগীদের সেবা দিয়ে থাকে।
পরদিন সকালে প্রথমেই আমরা গেলাম হাসপাতালের জনপ্রিয় হেল্থ চেকআপের ১১তম ফ্লোর। রেজিস্ট্রেশনের পর এখানকার স্টাফরাই আমাদের একটার পর একটা কেন্দ্র ঘুরিয়ে শেষকেন্দ্রে আজকের প্রাপ্ত সব রিপোর্টসহ ডাক্তারের মুখোমুখি করল। আমাদের শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত, এক্সরে, আল্ট্রাসনো ইত্যাদি রিপোর্টে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে সরাসরি এবার আলোচনা। প্রাপ্ত অসুবিধার জন্য আবার কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাও তারা বাতলে দিলেন।
জানতে পারলাম প্রতিটা ফ্লোরে এভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ২৭৫টি এক্সামিনেশন স্যুট। কোন ফ্লোরে উইমেনস্ সেন্টার, কোনটায় হার্ট, কোনটায় কিডনি, কোথাও এন্ডোক্রাইন, আবার কোনটায় পাকস্থলি অন্ত্রের ডায়জেস্টিভ সেন্টার। বেশিরভাগ ফেøারই তার নিজ নিজ রোগীদের জন্য একই ফ্লোরে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছে। তাই রোগীকে অন্য কোন ফ্লোরেও সাধারণত যেতে হয় না।
আরও জানলাম এখানে প্রতিদিন প্রায় ৫৫০০ রোগীকে আউট প্যাসেন্ট হিসাবেই চিকিৎসা দেয়া হয়। সারা বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ রোগীর সেবা পায়, যার প্রায় অর্ধেকই আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ এয়ার এবং ল্যান্ড এম্বুলেন্স এই হাসপাতালে আসছে। এই হাসপাতালে থাই রোগীদের জন্য খরচ একটু বেশি আর বিদেশি রোগীদের জন্য খরচ কম হয়, কারণ এখানে সবার জন্য ‘একই সেবা এবং একই খরচ’ পলিসি অনুসরণ করা হয়। বেসরকারি খাতে থাইল্যান্ডে এই হাসপাতালই প্রথম থাইল্যান্ড হসপিটাল আক্রিডিটেশন পায় ১৯৯৯ সালে, এশিয়ায় সর্বপ্রথম আমেরিকা বেস্ড ‘জেসিআই’ আক্রিডিটেশন পায় ২০০২ সালে।
এরপর আমারা হাজির হলাম এই বিল্ডিংয়ের ইউরোলজি বিভাগে। এখানে আমাদের স্বাগত জানালেন রিজিওনাল মার্কেটিংয়ের সিনিয়র ম্যানেজার জনাব সারওয়ান সিরিবুনপান এবং তার দল। “বড় কোন কিডনি টিউমার অপসারন করতে হলে, কিডনিটাই ফেলে দিতে হবে। এটাই ছিল এযাবৎ প্রচলিত অপারেশন। কিডনিটার ভাল অংশ রেখে দেয়ার মত কোন অপশন ছিল না। কারন ‘ওপেন টাইপ’ অপারেশন অর্থাৎ পেট কেটে সার্জনের পক্ষে টিউমার আলাদা করা মোটেও সম্ভব ছিল না। এখন এটা সম্ভব হয়েছে রোবটিক সার্জারির কল্যানে।” এমনটাই বলছিলেন বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের বিশিষ্ট ইউরোলজিস্ট ডা. তিরাপন আমনভেসুকিত। কিডনি অপারেশনের কথাটা একাটা উদাহরন মাত্র। এই রোবটিক সার্জারির সুবিধা আমার অন্যান্য ফ্যাকাল্টির সহকর্মিরাও নিচ্ছে। শিশু সার্জারি, গাইনি সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, ইএনটি সার্জারি, ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি, কার্ডিয়াক সার্জারি সহ অন্য অনেক জটিল কাজেও এখন রোবট ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় দুই যুগেরও বেশী লেপারোস্কোপি, এন্ডোসার্জারি, লেজার প্রোস্টেটেকটমির মত কাজের সাথে জড়িত থাকার পর ইউরোলজির এই সার্জন এখন ইউরো অনকোলজি ও রোবটিক ইউরোলজিতেই বেশী মনোযোগি হয়েছেন।
প্রোষ্টেট ক্যান্সার হলে আমরা সবসমই চাই এর খারাপ অংশের পুরটাই ফেলে দিতে। আমরা খারাপ আর ভাল অংশের মাঝে যেখানে কাটি তাকে বলি মার্জিন। এই মার্জিন ঠিক করার জন্য বেষ্ট হচ্ছে রোবট। এসময় একটাই সমস্যা, তা হল প্র¯্রাবের থলি এবং প্র¯্রার ধরে রাখার স্ফিংটারটার কতটা রক্ষা করা যায় তার দিকে খেয়াল রাখা। আরও চেষ্টা করতে হয় পুরুষাঙ্গের ইরেক্টাইল ফাংশনটাও ঠিক রাখতে। অর্থাৎ পুরুষাঙ্গের স্বাভাবিক কার্যকলাপও যাতে ঠিক থাকে তা ধরে রাখার সর্বাত্তক চেষ্টাই আমরা করি। যত ভাল মত ক্যান্সার অপসারন করা যায়, রোগীর ভবিষ্যতও ততই ভাল। তাই আবারও বলছি, আমরা এখানে রোবটিক সার্জারীরই পরামর্শ দেই। একারনেই আমেরিকায় এই ক্যান্সার অপারেশনের প্রায় শতভাগই এখন রোবট দিয়ে হচ্ছে। তবে আশার কথা, আমরাও এশিয়ায় এটা শুরু করেছি। ফলও ভাল পাচ্ছি। এই সার্জারি আগের মিনিমালি ইনভেসিভ সার্জারির যে অসুবিধাগুলি ছিল তা দুর করেছে এবং সার্জনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারছে। হাসতে হাসতে বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন “অভিজ্ঞ হতে হতে আমার বয়স হয়ে গেল, এখন ফ্যাটিগ হয়ে যাই, হাত কাপতেও শুরু করে অনেক্ষন কাজ করার পর। কিন্তু দেখেন রোবট কিন্তু টায়ার্ড হয় না, ভুল করে না, একই গতিতে কাজ করতে পারে, তাড়াতাড়ি কাজ হয় বলে রুগীকেও কিন্তু কম সময় এনেস্থেসিয়ার নীচে থাকতে হচ্ছে, এর থ্রিডি ক্যামেরায় ৩৬০ ডিগ্রি পর্যন্ত সব পরিষ্কার দেখা যায়। পজিটিভ মার্জিন, অর্থাৎ ক্যান্সার ফ্রি অংশ অবলিলায়ই কেটে আনতে পারছে, যা আমাদের কব্জি ঘুরিয়ে করা সম্ভব ছিল না। তবে রোবটের পিছনে কিন্তু একে কন্ট্রোল করছে, ডিসিশন দিচ্ছে একজন অভিজ্ঞ সার্জন।”
খরচ একটু বেশী হলেও আমরা শুরু করেছি আগের কনভেনশনাল অপারেশনের কাছাকাছি খরচেই। শুনে খুশি হবেন যে, আমরা কিন্তু এই অঞ্চলের রুগীদের জন্য সাশ্রয়ি প্যাকেজও ঘোষনা করেছি। আন্তর্জাতিক মান আইএসও পাওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যদিও এটা আমাদের হাতে নাই। আরও বেশী রুগীর উপর ভাল সেবা প্রদান করতে পারলেই এটা পাওয়া যাবে। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমারা তা পেয়ে যাব বলে আমি আশাবাদি। ইউরোলজিতে আমরা প্রোষ্টেট, কিডনির বিভিন্ন অপারেশন, ইউরিনারি বøাডার, ইউরেটারের মেরামত এই রোবটিত সার্জারির মাধ্যমে করতে পারি। তবে যেই অপারেশন গুলির ভবিষ্যৎ রোবট ও কনভেনশনালে একই ফল দেয় তাদের আমরা বেশী খরচ করে রোবটিক সার্জারী করার জন্য উৎসাহ দেই না, তবে কেউ করতে চাইলে করতে পারে।
খরচ একটু বেশী ছাড়া রোবটিক অপারেশনের সুবিধাই কিন্তু বেশী। রুগী দ্রæতই আরোগ্য লাভ করে কাজে ফিরে যেতে পারে, ব্যথা কষ্ট কম, হাসপাতালে কম দিন থাকতে হয়, ছোট জায়গা কাটতে হয় বলে ইনফেকশনের সম্ভবনা কম, রক্তক্ষরন কম হয়, দ্রæত করা যায় বলে ইশ্চিমিক টাইম, অর্থাৎ যে অঙ্গটা নিয়ে আমরা কাজ করি তাকে বেশীক্ষণ রক্তস্বল্পতায় থাকতে হয় না, আর সভাবতই সেরে যাওয়ার পর অপারেশনের দাগও অনেক অনেক কম দেখা যায়। এরপর তিনি কম্পিউটার স্ক্রিনে রোবটিক সার্জারীর সুবিধাগুলিযে সারা বিশ্বেই শক্ত ভিক্তি পেয়েছে তার কিছু রিসার্চ ও সাইটেশন দেখালেন।
এরপর জনাব মোহাম্মদ আব্দুল কাদের আমাদের দেশের রুগীদের জন্য খরচ কিছু কমাতে অনুরোধ করেন। এর জবাবে তিনি জানালেন, আগে একটা কোম্পানীই এই রোবট সরবরাহ করত। তাদের প্যাটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন অনেকেই তৈরী করছে, তাই দামও আস্তে আস্তে কমে আসছে। আর আপনাদের জন্যত আমাদের কম মুল্যের প্যাকেজত আছেই। ভবিষ্যতেও সকল প্রশ্নোত্তরের জন্য আমার দরজা খোলা আছে জানিয়ে আমাদের বিদায় জানান।
বাংলাদেশি রোগীদের বিনামূল্যে এই হাসপাতালের জন্য পরামর্শ ও সেবা দিয়ে সাহায্য করছেন অফিসটির প্রধান কর্মকর্তা জনাব কামালুর রহমান এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা, বিশেষ করে জনাব শাহ মোঃ রোকনুজ্জামান। হাসিমুখে সেবা পেতে তাদের পরিচালিত রেফারেল সেন্টারে যোগাযোগ করুন : স্যুট : ৩, লেভেল : ১১, ইউটিসি বিল্ডিং ৮, পান্থপথ, ঢাকা-১২১৫, ফোন-০১৭১৩০২৭৬২৮, ০১৭৫৫৫৫৯৬৩১, ই-মেইল : bumrungrad@dhaka.net|

ই-মেইল : zhsagar@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন