দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এক কথায় বলা যায়, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মোতাবেক রাজনীতি চলছে না। ভিন্ন মতাবলন্বী, বিরোধী পক্ষের মতামত কিংবা তাদের রাজনৈতিক অধিকারের পথ ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। রাজনীতি এখন অনেকটাই অনুমতি নির্ভর। অনুমতি নির্ভর রাজনীতি গণতান্ত্রিক রাজনীতি নয়, হতে পারে না। এ বিবেচনায় বলতে হয়, কার্যত দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে যেটুকু আছে কিংবা চলছে তা হলো, এক তরফা কতৃত্ববাদী ব্যবস্থা। সন্দেহ, অবিশ্বাস, শঙ্কা-হতাশা ইত্যাদি নানা রকম নেতিবাচকতা রাজনীতিকে ঘিরে ক্রমপুষ্ট হচ্ছে। যতই উন্নতি-অগ্রগতির কথা বলা হোক না কেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির যদি বিকাশ না ঘটে, এর পথ যদি রুদ্ধ থাকে, তাহলে কোনো কিছুই টেকসই হবে না, হবে না অর্থবহও। রাজনীতির যে চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে, চূড়ান্ত অর্থে তা মঙ্গলজনক নয়। রাজনীতিতে কৌশল থাকবেই। কিন্তু অপকৌশল কোনভাবে কাম্য নয়, হতে পারে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের পথ যদি সংকুচিত হয় কিংবা হতে থাকে, তাহলে বিপদাশঙ্কা প্রকট হতে বাধ্য। বিরোধী দল ও মত দমনের চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অকল্যাণই ডেকে আনে। কারারুদ্ধ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেক দিন ধরে অসুস্থ। তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে আসছে বিএনপি। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে বারবারই তার প্যারোলে মুক্তির প্রসঙ্গ নানাভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি চাইলে এমনটি খতিয়ে দেখা হবে কিংবা পরবর্তীতে ভাবনা-চিন্তা করা হবে। বিএনপির নেতারা স্পষ্ট করেই বলে আসছেন, তারা সরকারের অনুকম্পা চান না, আইনি প্রক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি চান। এ লক্ষ্যে ৭ এপ্রিল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপি নেতারা গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেন। এই অনশনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই জোট- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। বিএনপি নেতারা যেহেতু খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি দাবি কখনও করেননি সেহেতু এ প্রসঙ্গটি সরকারের দায়িত্বশীল কেউ কেউ ঘুরে ফিরে কেন আনছেন, তা বোধগম্য নয়। এটা কি এক ধরনের অপকৌশল, নাকি বিভ্রান্তি ছড়ানো’ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা একটু পিছনে ফিরে তাকালে দখতে পাই, আইয়ূবের শাসনামলে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার কিংবা এই পন্থায় মুক্তি দাবির বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় শাসক মহলের পক্ষ থেকে। কিন্তু দলের নেতারা অটল ছিলেন আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহারের বিষয়ে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর তখনকার ভূমিকা স্মরণযোগ্য। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান আরো সুসংহত হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সেই রকম আন্দোলন এখন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে। আইয়ূবের পরে আসে ইয়াহিয়া খান। এর পরবর্তী ইতিহাস সচেতন মানুষ মাত্রেই জানে। রাজনীতিতে কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে; কিন্তু কূটকৌশল অবলন্বন করা বৈরিতার পথটিই প্রশস্ত করে। আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে নীতি-নৈতিকতার পাঠ ক্রমে চুকে যাচ্ছে। সুলতান মুহাম্মদ মুনছুর আর মোকাব্বির খানের শপথ নেওয়ার বিষয় যদি পর্যালোচনা করা হয় তাহলে এটি স্পষ্ট হয়ে যায়। দুজনই নির্বাচন করেছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তৃব্যানারে। সুলতান মুহাম্মদ মুনছুর ধানের র্শীষ নিয়ে আর মোকাব্বির খান দলীয় প্রতীক নিয়ে। তারা দু’জন জোটভুক্ত রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিতে দেখা গেল। তারা যে বৈরী পরিবেশে নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন, তা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। তাদের ভোটাররা নির্বাচিত করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু তারা স্বার্থের টানে সব নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে পিছনের কথা সব ভুলে গেছেন। তারা এখন নিজেদের গাঁ বাঁচাতে নির্বাচক মন্ডলির চাপের কথা বলছেন। কিন্তু কেউ যদি বলেন, নির্বাচক মন্ডলির চাপের চেয়েও সংসদ সদস্য হিসেবে সুযোগ-সুবিধা ও প্রভাবের আকষর্ণ তাদের সংসদে যাওয়ার পথে টেনেছে, তাহলে কি ভুল হবে?
আমরা যদি আরো পিছনের দিকে তাকাই, ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারির কথা স্মরণ করি তাহলে দেখব, সেদিন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অঙ্গীকার করেছিলেন বাংলার অধিকারের প্রশ্নে আপস নয়। দলীয় এমন অঙ্গীকার এবং সবার দলের প্রতি আনুগত্যের কারণেই ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন অধ্যায়। এমন নজিরের ইতিহাস আছে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনেও। রাজনীতি যদি নীতির রাজা হয়, তাহলে তৎসংশ্লিষ্ট অনেক কিছু আমলে রাখা কিংবা নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। রাজনীতিতে দলীয় কিংবা জোটের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে, অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে আর যাইহোক রাজনীতির অঙ্গনে বেশিদিন বিচরণ করা যায় না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জোটবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস নতুন নয়, অন্য দেশেও এমন নজির আছে। সুলতান মোহাম্মদ মুনছুর ও মোকাব্বির খানের শপথ নেওয়ার পর রাজনীতে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার অংশগ্রহণে হোক, এ দাবি দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে উঠেছিল। নানা রকম অনিশ্চয়তা কাটিয়ে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক হলেও নির্বাচনের পূর্ব ও নির্বাচনকালীন কর্মকান্ড নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। সম্প্রতি চার ধাপে সম্পন্ন হলো উপজেলা নির্বাচন। বাকী রয়েছে আরো একধাপ, যা ঈদুল ফিতরের পরে হবে। এই নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। নিজেরা নিজেদের প্রতিপক্ষ। নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব-সংঘাত-কলহ-বিপদের জের ধরে রক্তপাত হয়েছে। ঘটেছে প্রাণহানিও। রাজনীতি ও নির্বাচন যেন খেলায় পরিণত হয়েছে। এসব গণতন্ত্রের জন্য কোনো শুভবার্তা বহন করে না ।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডির্পাটমেন্টের বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি মূল্যায়নে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগ গত ডিসেন্বর মাসে অকল্পনীয় একপেশে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য টানা তৃতীয়বার নির্বাচিত হয়েছে। ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু বিবেচিত হয়নি। বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, জাল ভোট প্রদানসহ অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনের আগে প্রচারের সময় হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার ও সহিংসতার কারণে বিরোধী অনেক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মিছিল সমাবেশ এবং স্বাধীনভাবে প্রচার কঠিন হয়ে পড়ার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বেরিয়েছে।
বলা বাহুল্য, দেশের ভিতর থেকে যারা নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা দেখছেন এবং অনুভব করেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক বেশি প্রত্যক্ষ এবং হতাশা ব্যঞ্জক। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ইলেকশান ওর্য়াকিং গ্রুপের ২২টি এনজিওর মধ্যে মাত্র ৭টিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যেসব মানবাধিকার লংঘিত হয় তারও একটা তালিকা দেয়া হয়েছে। তালিকায় উল্লেখ রয়েছে, বেআইনি বা বিনা বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন, সরকার বা তার পক্ষে বেআইনি পরোয়ানা ছাড়া আটক, কঠোর ও জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ, কারাগার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বন্দি, ব্যক্তিগত বিষয়ে বেআইনি হস্তক্ষেপ সেন্সরশিপ, সাইট ব্লক ও আপত্তিকর বিবৃতি এবং এনজিওর কর্মকান্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া ও সংগঠন করার অধিকারের ওপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিধি নিষেধ, অবাধ ও সুষ্ঠু এবং প্রকৃত নির্বাচন না হওয়া, দুর্নীতি ও মানব পাচার। এই যে চিত্র বিদেশি পর্যবেক্ষণে ফুটে উঠেছে, তা আমাদের জন্য গৌরবের নয়।
গত ৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘সুশাসন ও গণতন্ত্র, বাংলাদেশের করণীয়’, শীর্ষক এক সেমিনারে যুক্তরাজ্যের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর বিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেছেন, ‘নির্বাচন ও গণতন্ত্র মানে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে এবং নির্বাচনে ভোটাররা স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি পছন্দ করবেন। বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে বলতে এটা আনন্দ পাই না যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচন সেই মান অর্জন করতে পারেনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘যে কোনো সুসংহত গণতন্ত্রের পছন্দমত মত প্রকাশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জবাবদিহিকে শক্তিশালী করতে হলে গণমাধ্যমকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত।’ এই যে পর্যবেক্ষণগুলি উঠে আসছে, প্রকাশ পাচ্ছে, তা কতটা আমলে নেওয়া হচ্ছে? দেশের নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজনীতি ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ফলে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ঔজ্জ্বল্য হারাচ্ছে।
নির্বাচন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত। কিন্তু এ শর্ত যদি এভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে, তাহলে রাজনীতি সঙ্গতকারণে বিপথে যাবে। নির্বাচন, গণতন্ত্র, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে, তা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে, জাতীয় সংসদে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকাটা রাজনীতি, গণতান্ত্রিক, সর্বোপরি দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্য, এখানে বিরোধী পক্ষকে দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের পথ কণ্ঠকাকীর্ণ। এই বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ ক্ষীণ। পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলেও বর্তমান বাংলাদেশে এর অনুপস্থিতি রয়েছে। ১৯৯০ সালের শেষ লগ্নে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে। এর পটভূমি ছিল ভিন্ন। আজকের প্রেক্ষাপটে চলতে পারে বিতর্ক। তত্ত¡কথা বলতে চাই না, তারপরও বলব, গণতন্ত্র এক ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা। গণতন্ত্র এমন এক পদ্ধতি, যা সবার আশা আকাক্সক্ষা ধারণ করে। এই ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরু যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘুও। একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন, এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি হয় স্বতন্ত্র। এখানে সংখ্যাগুরু সংখ্যলঘু একত্রে কাজ করে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা কি সেই সাক্ষ্য বহন করে? বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য তাই প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন।
লেখক: সাংবাদিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন