সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্ষণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সচেতন মানুষেরা বিচলিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সামাজিক এ অপরাধটি যেন সংক্রামক ব্যাধির মতোই ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় এক বা একাধিক ধর্ষণের খবর থাকছেই। সড়ক দুর্ঘটনার মতোই নারী লাঞ্ছনার এ অপরাধটিও যেন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটি দিন পাওয়া যাচ্ছে না, যেদিন পত্রিকা পাঠ করে ‘আজ ধর্ষণের খবর পড়তে হয়নি’- বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়। এক শ্রেণির মানুষের মানসিক বিকৃতি এতটাই ঘটেছে যে, তারা বিচার-বিবেচনাবোধ হারিয়ে পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। অবশ্য ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য সামজিক অপরাধ নতুন নয়। তবে, সাম্প্রতিককালে এটি আমাদের সমাজ জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক ভীতিকর পরিবেশ। মা-বাবারা এখন তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠিত। মেয়ে যতক্ষণ ঘরে না ফেরে ততক্ষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করতে হয় তাদের।
অতিসম্প্রতি ফেনীর সোনগাজীতে একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ কর্তৃক ওই মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন উৎপীড়ন এবং পরবর্তীতে তাকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা এখনো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি। ঘটনা এখন সবারই জানা বিধায় পুনঃবিবরণ নিষ্প্রয়োজন। তবে ঘটনাটির পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে আমাদের সমাজের কতিপয় মানুষের মূল্যবোধের অধঃপতনে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় বাবার বয়সী একজন শিক্ষকের কাছে কন্যাসম ছাত্রীর নিরাপদ না থাকার বিষয়টি জেনে। ঘটনা পরবর্তী ফলোআপ খবরে আমরা জেনেছি, সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ- দৌলার চারিত্রিক অধঃপতনের বিষয়টি নতুন নয়। এ ধরনের অপকর্ম সে আগেও করেছে। তারপরও সে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে টিকে থাকতে পেরেছে ‘কৌশল’ অবলম্বন করেই। সে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে সখ্য গড়েছিল, সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে। তাই আমরা দেখি- নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা অভিযানে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে। আর পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিটিকে দেখা গেল ঘটনাটিকে ‘ছাত্রী কর্তৃক আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাতে। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজদেহে ঘূণপোঁকা যে বেশ ভালোভাবেই বাসা বেঁধেছে এ থেকে তা আবারো পরিষ্কার হয়ে গেল।
কী অপরাধ ছিল নুসরাত জাহান নামের কিশোরীটির? তার অপরাধ সে এক নারীলোভেীর লালসার শিকার হতে চায়নি। সে একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে রাষ্ট্রের কাছে ন্যায় বিচার চেয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের যারা প্রতিনিধি তারাই উল্টো তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে শামিল হলো। অধক্ষের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নুসরাতের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেছিলেন। সে মামলা প্রথমে নিতেই চায়নি ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। পরবর্তীতে অভিযোগ গ্রহণ করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে সে নুসরাতের সাথে যে আচরণ করেছে সেটাকে দ্বিতীয়বার যৌন নিপীড়ন বলা যায়। ওসি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছেন নিজেরই জালে। জিজ্ঞাসাবাদের সে ভিডিও ইন্টানেটে ছড়িয়ে দিয়ে এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার আসামী তিনি। সিরাজ মাওলানার অপরাধের সহযোগী হিসেবে ইন্সপেক্টর মোয়াজ্জেমের কী বিচার বা শাস্তি হবে আমরা জানিনা। তবে, তাকে বাঁচাননোর একটি প্রক্রিয়া যে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। গত ১৮ এপ্রিলের পত্রিকার খবরেই বলা হয়েছে, ঘটনা সম্পর্কে ফেনীর এসপি জাহাঙ্গীর আলম পুলিশ হেড কোয়ার্টারে যে পত্র পাঠিয়েছেন, তাতে ওসি মোয়াজ্জেমকে বাঁচানোর প্রয়াস স্পষ্ট। ঘটনার জন্য উল্টো নুসরাতের পরিবারকেই দায়ী করা হয়েছে ওই চিঠিতে। ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ বলে যে প্রবাদটি বাংলা ভাষায় চালু আছে সে কথা আমাদের ভুললে চলবে না।
নুসরাত হত্যাকান্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রাশসনিক মহল যে সংঘবদ্ধ চেষ্টা চালিয়েছে সেটা এখন আর গোপন নেই। গত ১৭ এপ্রিল একটি দৈনিকে ‘আষাঢ়ে গল্প বানানোর চেষ্টা হয়েছিল’ শিরোনামে এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নুসরাত জাহান রাফির হত্যার পরিকল্পনাকারীরা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে শুরু থেকেই ঘটনাটি ভিন্নভাবে প্রচার করার চেষ্টা চালায়। শুধু সোনাগাজীর ওসি নন, ফেনীর প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ঘটনাটি আকারে- ইঙ্গিতে আত্মহত্যা বলে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় নুসরাত যখন বারবার খুনিদের সম্পর্কে নানা তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তখনও প্রভাবশালীদের কেউ কেউ তার গায়ে কলঙ্কচিহ্ন লেপ্টে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রাখে। নানা ‘আষাঢ়ে’ গল্প বানানোর চেষ্টা করে চক্রান্তকারীরা। স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদেরও ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছে। ভুল তথ্য পরিবেশন করে তারা ফাঁদ পাতে।’ পত্রিকাটি লিখেছে-‘স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ফেনীর পুলিশ সুপার, সোনাগাজীর সংশ্লিষ্ট মাদরাসার গভর্নিং বডির সভাপতি ফেনীর অতিরিক্ত জেলা ম্যজিষ্ট্রেট (রাজস্ব) এবং কমিটির অন্য সদস্যরা কেন ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হলেন? নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকদের ভাষ্য, মাদ্রাসিাটিকে ঘিরে যে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে উঠেছিল, তাদের প্রভাবের কারণে স্থানীয় প্রশাসন ঘটনার সঠিক তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সোনাগাজী থানার ওসি বা ফেনীর এসপি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ওই পত্রিকার সাথেই এক সাক্ষাতকারে বলেছেন,‘সংকটাপন্ন অবস্থায় নুসরাতের দেয়া বক্তব্য এবং এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহরের মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়েছিল। পিবিআই প্রধানের এ কথা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, ঘটনার সত্যতাকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছিল স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। এদের মধ্যে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুল আলম রয়েছেন প্রথম সারিতে। আর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার মিশনে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছাত্রলীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা। এদের মধ্যে একজন নুসরাতের গায়ে আগুন লাগানোর পর মোবাইল ফোনে তা জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনকে। বোঝা যাচ্ছে, একটি সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তচক্র এ নির্মম হত্যাকাÐটি ঘটিয়েছে। এ চক্রের কেউ মাদ্রাস শিক্ষক, কেউ রাজনৈতিক নেতা, কেউ সরকারি প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা। একটি জনপদের এসব বিশিষ্ট মানুষ যদি একটি পাশবিক ঘটনা ঘটাতে সংঘবদ্ধ হয়, তাহলে সে এলাকাটি নীরিহ মানুষদের জন্য কতটা নিরাপদ থাকে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।
নুসরাত হত্যার বিষয়টি সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকার কলামে এবং টিভি টক শো’তে আলোচনা হচ্ছে। সেসব আলোচনা পর্যালোচনায় স্থান পাচ্ছে সমাজে এর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি। তবে, আমার কাছে যে দু’টি বিষয় অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হয়েছে তাহলো: এক. একজন বয়স্ক শিক্ষকের রুচি বিকৃতি, দুই. একটি অপরাধ সংঘটনে রাজনীতির মানুষ ও প্রশাসনের সহযোগিতা। কী স্বার্থে তারা সিরাজ মৌলভীকে অপকর্মে সহযোগিতা করেছিল? বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, সিরাজ তার অপকর্মগুলো জায়েজ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। সে সিÐিকেটের সহযোগীরা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারে যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছে। কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ। সংবাদমাধ্যমে খবরটি দ্রæত ছড়িয়ে পড়ায় তার আর বাঁচার পথ খোলা রইল না।
যে বিষয়টি সচেতন ব্যক্তিদের অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, তাহলো, শিক্ষকদের একটি অংশের এ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা। ক্রমেই যেন শিক্ষালয়গুলোও ভীতিকর স্থানের তালিকায় নাম লেখাতে শুরু করেছে। স্কুল-মাদরাসা থেকে শুরু করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কোনোটাই এ অশুভ ভাইরাস থেকে যেন মুক্ত থাকতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নোট দেয়ার নাম করে অথবা বেশি নম্বর পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ছাত্রীদেরকে যৌন হয়রানির অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষক পরিমল আর সোনাগাজীর মাদরাসার সিরাজ মাওলানার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ নিবন্ধ যেদিন লিখছি সেদিনের পত্রিকায়ও দেশের বিভিন্নস্থানে চার-পাঁচটি ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন, আছেন মন্দিরের পুরোহিতও।
আসলে আমাদের সমাজে মূল্যবোধের যে মারাত্মক অবক্ষয় ঘটেছে এটা তারই প্রতিচ্ছবি। নইলে যার কাছ থেকে নুসরাতের পাবার কথা পিতৃ¯েœহ, যিনি হতে পারতেন অন্যকোনো মানুষরূপী হায়েনার হাত থেকে তার বাঁচার নিরাপদ আশ্রয়, তিনিই কিনা উদ্যত করেছিলেন লালসার হিংস্্র থাবা! যে পুলিশ তার জীবন্-সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য ত্রাতা হিসেবে পাশে দাঁড়ানোর কথা, সে পুলিশের কর্তাব্যক্তিটি হয়ে উঠল অপরাধীর পৃষ্ঠপোষক! এখানে নুসরাতের দুই বান্ধবী পপি ও মনির প্রসঙ্গটিও এসে যায়। ওদের কী স্বার্থ ছিল নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার মধ্যে? যে বন্ধুটির সাথে এতদিন পড়াশোনা করেছে, কথা বলেছে, হেসেছে, তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে কেন ওরা শরিক হলো? এসব প্রশ্নের সোজাসাপ্টা কোনো জবাব আছে কিনা জানিনা। তবে, ওই যে বললাম অবক্ষয়। সে অবক্ষয় ব্যাধিটিই গ্রাস করেছে আমাদের সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশের সব বিবেক, বিবেচনা আর নৈতিকতাকে। আর তাই খুন, গুম, ধর্ষণে বাংলাদেশ আজ নরকতুল্য হয়ে উঠেছে। মানুষ আজ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে দিনাতিপাত করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নুসরাত হত্যায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। তার ওপর শতভাগ আস্থা রেখেই বলছি-নুসরাত হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দ্রæত ব্যবস্থা করে দুর্বৃত্তদের জানিয়ে দিতে হবে অপরাধ করে পার পাবার দিন শেষ হয়ে গেছে। অপরাধের সংক্রামক ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে হলে এর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন