শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা রাখবেন তো?

প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৬ পিএম, ২৪ মে, ২০১৬

স্টালিন সরকার : মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আপনাকে অগ্রিম অভিনন্দন। আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়–ক। কথা রাখতে পারবেন তো? দেশের নাগরিকরা গ্রেফতার আতঙ্ক ও ভয়ভীতিমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে তো? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটবে তো? অযথা হয়রানি আর গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার হবে না তো? নাকি সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার মতো ৩৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে?
‘বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না’ বলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা ব্যবহারে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে তা কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে কাউকে গ্রেপ্তারের সময় ‘পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে’ নির্দেশনা দেয়া হয়। ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণার পর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, জনগণের উপকারে প্রয়োজনে ফৌজদারি কার্যবিধি আবার সংশোধন করা হবে। এ রায় ঘোষণার পরপরই বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় মেনে চলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। একই সঙ্গে ৫৪ ধারার অপব্যবহার করলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালন করা হবে।
পৃথিবীর সব দেশে পুলিশ আছে। পুলিশ বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্র অচল। যার কারণে স্বরাষ্ট্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। আর গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় মন্ত্রণালয়টি স্পর্শকাতর বটে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকেন কারণে-অকারণে তাদের দুর্নামের ভাগীদার হতে হয়; সমালোচনায় পড়তে হয়। ‘পান থেকে চুন খসলে’ই মন্ত্রীকে কথার ক্ষেপণাস্ত্রে বিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকানোয় পুলিশের দায়িত্ব পালনে একটু হেরফের হলেই সর্বত্র নিন্দার ঝড় ওঠে। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তুলোধুনো করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সফলতা-ব্যর্থতার দায় তাকে বহন করতে হয়। বর্তমানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল খুবই সজ্জন, ধীরস্থির, সুস্থির ও মৃদুভাষী মানুষ। তার চিন্তাশীল কথাবার্তায় মানুষ বিমোহিত। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান সরকারে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। অতপর মেধা-প্রজ্ঞা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েই হন পূর্ণমন্ত্রী। এ সরকারে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়ে সফলতা দেখানোয় পূর্ণমন্ত্রিত্ব পান। ফলে তার কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এমনকি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী তার এক লেখায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তুলে ধরে যেভাবে তার প্রশংসা করেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু তার অধীনস্থ বাহিনীর সুনাম-দুর্নাম দুটোই আছে। সুনামের চেয়ে দুর্নামের পাল্লা ভারী। এখনো বিপদে পড়লেই মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হয়। অথচ পুলিশ বাহিনীকে আস্থায় রাখতে পারছেন না। পুলিশ দেখলেই মানুষ ভীত-আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে গ্রেফতার বাণিজ্য, মানুষকে হয়রানী এবং কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার অতি তৎপরতায় দেশের মানুষ চরম ভীতিকর অবস্থায় দিনযাপন করছেন। এর আগে হাইকোর্ট অবজার্ভেশন দিয়েছেন যে, ‘সাদা পোশাকের পুলিশ অপরাধ ভয়াবহ।’
জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত পুলিশ বাহিনীকে দেশের মানুষের ‘বন্ধু’ হিসেবেই গ্রহণ করার কথা। এখনো সেটা হয়নি। বাহিনীর কিছু সদস্যের কারণে গোটা পুলিশ বাহিনীর দুর্নাম হচ্ছে। কিছু কর্মকর্তার অসাধুতা-অপকর্মের দায় গোটা বাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। বাস্তবতা হলো আমাদের সুধীজনেরা তাই করতে অভ্যস্ত। রাস্তার ধারে, মহল্লার পাশে এবং মার্কেটের কোনায় কোথাও মাইক্রো দাঁড়ানো দেখলেই পথচারীরা আতকে উঠেন ‘ওরে বাবা পুলিশ’। সাদা পোশাকে পুলিশ দেখলেই ভরকে যান ‘হায় আল্লাহ! কোন বিপদে পড়লাম রে বাবা! অসংখ্য নিরীহ মানুষ শুধু গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার হয়ে পুলিশ দেখে আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা ৯২ দিন অবরোধের পর পুলিশ দেখলেই মানুষ ভয় পায়। অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকে পুলিশ নিরীহ মানুষকে তুলে নিয়ে গেছে। পরে গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করে। আবার প্রতারক চক্র সাদা পোশাকে ভুয়া পুলিশ সেজেও অপকর্ম করছে; পুলিশ তাদের পাকড়াও করছে এমন ঘটনা আছে। সাদা পোশাকে পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন মামলার আসামী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে গোয়েন্দা নজরদারী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি নাগরিকের কাছে এতোই ভীতিকর হয়েছে যে, প্রবাদ চালু হয়েছে ‘কোনো বিল্ডিং থেকে একটি ইট নিচে পড়লে তা গোয়েন্দাদের গায়ে পড়ে’ বলছে মানুষ। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলাদেশে আইএস রয়েছে এটা প্রমাণের জন্য স¤্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশে বিদেশীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। বেশ কয়েকটি হত্যাকা-, গুম নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের পুলিশ বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জঙ্গী তৎপরতা উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছেন। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যারা অসাধু এবং অপরাধজনিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ হেডকোয়াটার্সের হিসেবমতে প্রায় দশ হাজার সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আমাদের পুলিশ বাহিনী নিয়ে গর্ব করার অনেক কিছুই আছে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে রাজার বাগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সাহসের সঙ্গে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেটা এখন গৌরবের ইতিহাস। পুলিশ বাহিনী অনেক সূর্যসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সাফল্যের খাতা খুঁজে পুলিশ বাহিনীর সাফল্য লিখলে হয়তো মহাকাব্য রচনা হবে। রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে ভিজে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন; মানুষের নিরাপত্তা দেন। এতে সাধারণ মানুষ পুলিশ বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তারপরও পুলিশ বাহিনী নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক কাটছে না। কি রাজনৈতিক কর্মী কি সাধারণ মানুষ সবার মধ্যে ভয় কখন কি হয়! কয়েক মাসের পত্রিকা ঘাটলে দেখা যাবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আসামী ধরতে গিয়ে এবং পথেঘাটে মানুষকে নানাভাবে হয়রানি করছে। থানায় মামলা করতে গিয়ে দু’দিন আগেও ফেনিতে এক বিধবা ধর্ষণের শিকার হন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য এখন বন্দী। পুলিশ বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে নিরীহ মানুষকে এমন অনেক ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে। আবার অর্থ দিতে না পারলে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে চালান দিয়েছে এমন ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। অতএব পুলিশ বাহিনীর কর্মকা- নিয়ে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও ভীতি কাটছে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করছেন; এমনকি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যের কয়েকজন প্রাণও হারিয়েছেন। আবার ইনকিলাব অফিসে তল্লাশির নামে পুলিশের যে ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখেছি; তেমনি বিএনপির অফিস থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অর্ধশত নেতাকে গ্রেফতারের পর সারিবদ্ধ করে যেভাবে গাড়িতে ওঠানো হয় সে দৃশ্য টিভিতে সরাসরি মানুষ দেখেছে। এ দুটি ঘটনা কারো জন্যই সুখকর নয়। কাজ করতে গেলে ভুল হতেই পারে; এবং আমাদের পুলিশ বাহিনীর সুনাম-দুর্নাম দুটোই রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে অযথা হয়রানি, গ্রেফতার আতঙ্ক কাটছে না। মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে; এমনকি অনেক মানুষ এখন ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশবাসীকে যে আশার বাণী শুনিয়েছেন; তাতে মানুষ আশ্বস্ত হতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক, বীর, সজ্জন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও চিন্তাশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা রক্ষা করবেন, সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় ‘--তেত্রিশ বছর কাটলো-কেউ কথা রাখেনি /ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি... /... / পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি/... মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর/ তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো/... / নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো?’ অতীতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের দিকে তাকালে দেখি ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার প্রতিধ্বনি। ৪৮ ঘণ্টায় সাগর-রুনির খুনিদের ধরার ঘোষণা দিয়ে কত বছর কেটে গেল সেই ৪৮ ঘণ্টা শেষ হয় না। বর্তমানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন সে কথা রাখবেন এ প্রত্যাশা সবার। সুনীলের কবিতা কেউ বাস্তবে দেখতে চায় না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন