বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জাতীয় পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে, নদীভাঙন রোধে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকার প্রধান অংশীদার ভারত ও চীন। ভারত ৬৪ শতাংশ এবং চীন ১৮ শতাংশ। বাকী ১৮ শতাংশের অংশীদার নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটান। নেপাল ৮ শতাংশ, বাংলাদেশ ৭ শতাংশ এবং ভুটান ৩ শতাংশ। দেশগুলোর মোট আয়তনের দিক দিয়ে এই অববাহিকায় পড়েছে ভারতের ৩৩ শতাংশ, চীনের ৩ শতাংশ। নেপালের ১০০ শতাংশ বাংলাদেশের ৮৩ শতাংশ এবং ভুটানের ১০০ শতাংশ এলাকা। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এই তিন অববাহিকার সবচেয়ে কম অংশীদার নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটান প্রায় শতভাগ এদের পানির ওপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে এই তিন অববাহিকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ও পানি নিয়ে কোনো সংকট দেখা দিলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটানের। তিন দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। সঙ্গতকারণেই অন্য দু’ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষতি হওয়ার কথা বেশি। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যেই আমরা সেটা লক্ষ করেছি। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী সরাসরি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারত এসব অভিন্ন নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন ও অন্যান্য প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশের নদীগুলো ভরাট ও পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। শুকনো মওসুমে এ সব নদী মরা খালে পরিণত হয়। বছরের পর বছর এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় অনেক নদী মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। বাকী নদীগুলোর অস্তিত্ব কোনো রকমে টিকে আছে। কতদিন টিকে থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনবিধি অনুযায়ী, উজানের কোনো দেশ অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করতে পারে না। কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইনবিধির তোয়াক্কা না করে অভিন্ন নদীর পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের ন্যায্য দাবি ও অধিকারের প্রতি কর্ণপাত করছে না। ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, উৎপাদনব্যবস্থা ও নাগরিকজীবনধারা চরম বিপর্যয়ের শিকার। দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুবিস্তার ঘটছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘটছে লবণাক্ততার বিস্তার। সেচব্যবস্থা অচল হয়ে যাচ্ছে। মাটির প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। গাছাপালা মরে যাচ্ছে। শিল্প উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে।
শুকনো মওসুমে পানির অভাবে যখন এই সব বিপর্যয় ঘটছে, তখন বর্ষা মওসুমে ঘটছে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। বন্যায় জনপদ, ক্ষেতখামার ডুবে যাচ্ছে। প্রবল নদীভাঙনে বাড়িঘর, ফসলী জমি ও স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বর্ষা মওসুমেই ভারত অভিন্ন নদীতে দেয়া বাঁধগুলো খুলে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পানি ঠেলে দিচ্ছে। এতে বন্যা ব্যাপক বিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহ করছে। শুকনো মওসুমে ভারত পানি না দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে এবং বর্ষায় পানি ছেড়ে ডুবিয়ে মারার নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা, ন্যায়সঙ্গত পানিবণ্টন চুক্তি এবং অববাহিকাভিত্তিক পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপর বরাবরই গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। ভারত এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র গরজ দেখাচ্ছে না। গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। বারবার আশ্বাস দেয়া সত্তে¡ও তিস্তার পানি চুক্তি থেকে সরে গেছে ভারত। এমতাবস্থায়, চুক্তির কোনো আশা নেই। অন্যান্য নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারেও কোনো সুখবর নেই। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিসের’ এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড়র হুমকি তৈরি হয়েছে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন নিয়ে। এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। নদীতীরের ক্ষয়, বন্যা, পানিপ্রবাহ হ্রাস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার মতো সংকট মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। বলা অনাবশ্যক, সংস্থাটি যাকে সম্ভাব্য সংকট বলছে, বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই সে সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনার পানির ওপর প্রায় শতভাগ নির্ভরশীল এবং উজানের দেশ ভারতের ‘পানি রাজনীতির’ ভয়াবহ শিকার, সুতরাং আগামীতে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন ও দুরূহ হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে বাংলাদশেকে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে এবং আশংকিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের মামলা চালিয়ে যেতে হবে। ভারতের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে তুলতে হবে। পাশাপাশি জাতীয়ভাবে পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীগুলো নাব্য করার ব্যবস্থা নিতে হবে। খনন, পুনর্খনন, ড্রেজিং চালাতে হবে। নদী, খাল-বিল ও জলাশয়কে পানি সংরক্ষণাগারে পরিণত করতে হবে। বর্ষা-বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। বহুল আলোচিত গঙ্গা ব্যরোজ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে নদীভাঙন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ক্ষেত-খামার রক্ষা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। উপকূলীয় এলকাজুড়ে দেয়া বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সেগুলো মেরামত ও টেকসই করতে হবে। বড় নদীগুলোর ভাঙনপ্রবণ এলাকা শনাক্ত করে ভাঙন রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস’ ১৩টি জেলায় প্রবাহিত পদ্মা ও মেঘনার ২২টি ভাঙনপ্রবণ স্থান শনাক্ত করেছে। বলেছে, আগামী বর্ষায় এসব স্থানে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিতে পারে। সংস্থাটির সমীক্ষা মতে, এই ভাঙনে ৫শ’ হেক্টর বাড়িঘরসহ ২৮৬০ হেক্টর ভূমি, ৪২০ মিটার বাঁধ, ৮০০ মিটার রাস্তা, ৩৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫টি মার্কেট, ৩৩টি মসজিদ ও ৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় রকমের আশঙ্কার ব্যাপার। সংস্থার তরফে দাবি করা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে সংস্থাটি নদীভাঙনের ব্যাপারে সমীক্ষা করে আসছে, যার ৭৫ শতাংশই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এ রকম আগাম তথ্য প্রদান ও ভবিষ্যদ্বাণী করার পরও নদীভাঙন ভয়ংকর ধ্বংসের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত স্থানগুলোসহ অন্যান্য নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকায় ভাঙন রোধে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন