মোবায়েদুর রহমান : আইন-শৃঙ্খলা এবং রাজনীতিতে কয়েকটি রক্ত হিম করা পরিভাষা। এগুলো হলো, বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, সাদা পোশাকে গ্রেফতার, রিমান্ড এবং একজন জলজ্যান্ত ব্যক্তির অকস্মাৎ অন্তর্ধান। পিতা-মাতার আদরের সন্তান এক টগবগে যুবক। সকাল বা দুপুর অথবা রাতে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। এরপরে আর সে ফিরল না। এই ধরনের ভয়ঙ্কর সব ঘটনা বন্ধ করার জন্যই ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ একটি ল্যান্ডমার্ক রায় দেয়। সেই রায়ের সাথে ওপরে উল্লেখিত অনাচার প্রতিরোধ করার জন্য ১৫ দফা গাইডলাইন বা দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। এই দিক নির্দেশনার পটভূমিতে ছিল একটি কাস্টডিয়াল ডেথ বা হাজতে থাকাকালীন মৃত্যু।
একটি ভয়াবহ হত্যাকা-
এই করুণ কিন্তু বীভৎস হত্যাকা-টি ঘটেছিল ১৯৯৮ সালে। যুবকটির নাম ছিল শামিম রেজা রুবেল। সে ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার মৃত্যু সম্পর্কে একটি করুণ কাহিনী ছাপিয়েছে ইংরেজী ‘ডেইলি স্টার’। ছাপা হয়েছে ২২ মে, ২০১৬। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক রুবেল তার পিতা-মাতার সাথে সিদ্ধেশ্বরীর একটি চিপা গলিতে বসবাস করত। এখন আমি যা কিছুই বলব সেটি ঐ রিপোর্টেরই বয়ান।
১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই তার পাড়ার একটি লুঙ্গির দোকানের সেলসম্যানের সাথে গল্প করছিল রুবেল। বেলা ৪.০০ টার দিকে একটি মাইক্রোবাস বোঝাই ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কয়েকজন সদস্য রুবেলের বাসায় আসে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা রুবেলকে ধরে ফেলে এবং তাকে নির্বিচারে প্রহার করতে থাকে। তারা অভিযোগ করে যে, রুবেলের কাছে নাকি অবৈধ অস্ত্র আছে। ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, তারা সকলেই সাদা পোশাকে এসেছিল। কিন্তু সকলেই জানত যে ওরা কারা। তারা তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যায় এবং প্রহার অব্যাহত রাখে। প্রহার থেকে বাঁচার জন্য রুবেল মিথ্যা কথা বলে যে তার কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে। তখন ডিবি’র সদস্যরা তাকে পুনরায় বাসায় ফেরৎ আনে। কিন্তু বাসায় কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। রুবেল স্বীকার করে যে, অমানুষিক প্রহারের হাত থেকে বাঁচার জন্যই সে মিথ্যা কথা বলেছে।
তখন ডিবি’র সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তার বাসাতেই তারা তাকে নির্দয়ভাবে প্রহার করতে থাকে। তার বুক ফাটা চিৎকার প্রতিবেশীরা শুনতে পায়। তারা তাকে লাথি মারে এবং সে বৈদ্যুতিক খাম্বায় গিয়ে বাড়ি খায়। তারপর তারা তাকে পুনরায় ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। পরদিন ডিবি অফিসে তার লাশ পাওয়া যায়। তার সারা শরীরে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে বলা হয় যে, ভয়াবহ প্রহারের ফলে যে রক্তক্ষরণ হয় তার ফলেই তার মৃত্যু ঘটেছে। ইংরেজী ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে বলা হয় যে, সেটি ছিল নরহত্যার একটি পরিষ্কার কেস।
রীট পিটিশন
১৯৯৮ সালে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা হাই কোর্টে একটি রীট পিটিশন দাখিল করেন। ঐ রীট পিটিশনে বাংলাদেশ ফৌজদারী দ-বিধির ৫৪ ধারার অধীনে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং একই দ-বিধির ১৬৭ ধারার অধীনে আসামীকে রিমান্ডে নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার চ্যালেঞ্জ করা হয়। দরখাস্তে সেই সময় পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন এবং অমানুষিক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে উদাহরণ হিসেবে ৫৪ ধারার অধীনে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে গ্রেফতার এবং নির্যাতনের পর পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়। দরখাস্তে দাবী করা হয় যে, সংবিধানের ৩২, ২৭, ৩১, ৩৩ এবং ৩৫ ধারা মোতাবেক জনগণের জীবন ও স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার যেন উচ্চ আদালত সুরক্ষা করে।
বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদের কোর্টে ২০০৩ সালের ২৪ ও ৩০ মার্চ এবং ২রা এপ্রিল মামলাটির শুনানি হয়। মরহুম রুবেলের পক্ষে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইদরিসুর রহমান, এমএ মান্নান খান, তানজিবুল আলম এবং আবু ওবায়দুর রহমান। ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট যে রায় দেয় সেটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগে ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
রায়ে বলা হয় যে, ফৌজদারী দ-বিধির ৫৪ এবং ১৬৭ ধারা সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আদালত পুলিশ আইন দ-বিধি এবং সাক্ষ্য আইনের সংশোধন করে কতিপয় সুপারিশ দেয়। আদালত নির্দেশ দেয় যে, পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে এসব সুপারিশ কার্যকর করতে হবে। গ্রেফতার এবং রিমান্ড সম্পর্কেও আদালত ১৫ টি নির্দেশনামা দেয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল
হাই কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল বিভাগে আপিল করে। কিন্তু আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায়ের কার্যকরিতা স্থগিত করেনি। অবশেষে গত ২৪ এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের আপিল খারিজ করে দেন এবং হাই কোর্টের ৭ এপ্রিলের রায়কে বহাল রাখেন। তবে বলা হয়েছে যে, হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণের কোনো কোনো অংশে কিছু কিছু পরিবর্তন করা হবে, যেটা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যাবে।
কাজীর গরু যেন শুধুই
কেতাবে না থাকে
১৩ বছর আগে প্রদত্ত হামিদুল হক ও সালমা মাসুদের রায়কে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ চার বিচারপতি সমুন্নত রেখেছেন। আপিল বিভাগের এই রায়কে আইনের শাসনে বিশ্বাসী সমস্ত মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছেন। গত ৩ দিনের পত্র-পত্রিকায় ২০০৩ সালের ১৫ দফা নির্দেশনা এবং আপিল বিভাগের রায়ের সপক্ষে অনুকূল প্রতিক্রিয়া মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। সে কারণেই আমি আর সেগুলোর বর্ণনায় গেলাম না। গেলে চর্বিত চর্বণ হয়ে যাবে।
ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে
মেঘ দেখলে ভয় পায়
তবে কথায় বলে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। ২০০৩ সালে হাই কোর্টের ঐ রায়কে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করেছিল। কিন্তু হাই কোর্টের রায় বা জনগণের অভিনন্দন সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর কোন আছর ফেলতে পারেনি। ২০০৩ থেকে ২০১৬। এই ১৩ বছরে শত শত ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয়েছে। অসংখ্য ব্যক্তিকে সাদা পোশাকের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অসংখ্য ব্যক্তিকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে এবং অসংখ্য ব্যক্তিকে রিমান্ডে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। ১৩ বছরের এই অনাচার, অবিচার ও জুলুমের কথা লিখলে একটি মহা কাব্য হয়ে যাবে।
কয়েকটি উদাহরণ
হাই কোর্টের এই ১৫ দফার প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা সরকার তথা প্রশাসনের উপেক্ষার কয়েকটি নজির তুলে ধরছি।
(১) ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে রিমান্ডে নেয়ার পর এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল একেএম জহিরুল হককে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছে হাই কোর্ট। হাই কোর্ট এটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আপনারা শুনানিতে সময় নেবেন আবার রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করবেন- এটা কোন ধরনের আচরণ? মানুষকে লিবার্টি দেওয়ার জন্য আমরা এখানে বসেছি। আপনি আজ রাষ্ট্রপক্ষে আছেন। কাল অন্য পক্ষেও থাকতে পারেন। আপনাকেও টর্চার করা হতে পারে। এটা ভালো নয়। আপনাদের ক্ষমতা আছে। আমাদেরকেও পেটান। এভাবে চালাতে চাইলে হাই কোর্ট উঠিয়ে দিন”।
(২) ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট ডেইলি স্টারে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে, অভিজিৎ হত্যার দায়ে তৌহিদুর রহমানকে ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়েছে বলে র্যাব দাবী করেছে। কিন্তু তৌহিদুর রহমানের বোন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বৃটিশ নাগরিক নাসেরা বেগম বলেছেন যে, সাদা পোশাক পরা ৪ ব্যক্তি তার ধানমন্ডি ৯/এ, ফ্ল্যাট থেকে ২৮ মে দুপুর ১.৪৫ মিনিটে তৌহিদুর রহমানকে উঠিয়ে নেয়। ঐ ৪ ব্যক্তি নিজেদেরকে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের সদস্য বলে পরিচয় দেয়। সেই দিনই অর্থাৎ ২৮ মে নাসেরা বেগম ঐ ৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় অপহরণের দায়ে জিডি করেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান নাসেরা বেগমের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন যে, এক মাস আগে এ সম্পর্কে তিনি ঐ মহিলার ফোন পেয়েছেন। অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলে যে, তারা তৌহিদুর রহমানকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের একটি গলি থেকে রাত সাড়ে ১২ টার সময় গ্রেফতার করেছে।
সুলতানা কামালের প্রশ্ন
আমরা কি ঘাতকের জাতি?
২০০৭ সালের ১৩ এপ্রিল ইংরেজী দৈনিক ‘নিউ এজে’ আট কলামব্যাপী একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। রিপোর্টটি লিখেছেন মুবীন এস খান। রিপোর্টে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সুলতানা কামাল প্রশ্ন রেখেছেন, “আজ আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। আমরা কি ঘাতকের জাতি হিসেবে পরিণত হব? একই দিনে নিউ এজের ঐ রিপোর্টার আরেকটি রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ২০০৪ সালের জুন মাস থেকে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই ২ বছর ১০ মাসে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ৮০০ ব্যক্তিকে জেল হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
আরো দু’টি উদাহরণ
আমি আগেই বলেছি যে, এই ধরনের উদাহরণ অসংখ্য দেয়া যায়। দিলে সেগুলো মহাকাব্য হয়ে যাবে। শেষ করার আগে আমরা মাত্র দুই জনের উদাহরণ দেবো। একজন হলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ এবং আরেক জন হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডাকসুর ২ বারের ভিপি, চাকসুর ১ বারের জিএস, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। জনাব মান্নাকে তার আত্মীয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করলেও প্রথমে তারা সেটি অস্বীকার করে। ২৪ ঘণ্টার মাথায় তারা স্বীকার করে বলে যে, মান্না সাহেবকে ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদকে উত্তরার একটি বাস ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর ২ মাস পর্যন্ত তিনি নিখোঁজ ছিলেন। ২ মাস পর তাকে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে পাওয়া যায়।
এসব লোমহর্ষক ঘটনা ২০০৩ সালে প্রদত্ত হাই কোর্টের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ১৩ বছর পর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের ঐ রায়কে সমুন্নত রেখেছেন। এবার কি আপিল বিভাগের এই রায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মেনে চলবে? সেটি দেখার জন্য জনগণ অপেক্ষা করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন