বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সন্ত্রাসবাদ বিশ্বমানবতার কলঙ্ক

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্সের মসজিদে জুম্মার নামাজে আগত ৫০ জন মুসলমান হত্যার পরই ২১ এপ্রিল শ্রীলংকার কলম্বোতে ইস্টার সানডের প্রার্থনা চলার সময় তিনটি গীর্জা ও তিনটি হোটেলে সিরিজ বোমা হামলায় তিন শতাধিক নিহত ও পাঁচ শতাধিক মানুষ গুরুত্বর আহত হয়েছে। হামলায় আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করীম সেলিমের নাতি নিষ্পাপ শিশু জায়ান চৌধুরীও নিহত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এ বিষয়ে শ্রীলংকার সরকারের তীব্র মতবিরোধ আছে বলেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম প্রচার করেছে। শ্রীলংকার সিরিজ বোমা হামলার পর দেশটি পুত্তালুম জেলার একটি মসজিদে পেট্রোল বোমা হামলা চালানো হয়। একই সঙ্গে বান্দারাগামা এলাকায় মুসলিম মালিকানাধীন দুটি দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সিংহলি বৌদ্ধরা শ্রীলংকার পূর্বাঞ্চলে এ হামলা চালিয়েছে। তবে তাদের কাউকে এখন পর্যন্ত আটক করা হয়নি।
সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদ বা Terrorism পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ বছরের পুরাতন। ল্যটিন শব্দ 'Terrere' থেকে Terrorism শব্দের উৎপত্তি যা ১৭৯৩-১৭৯৪ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে চলমান ছিল। রোমান সম্রাট ক্রসবিদ্ধ করে গণহত্যার মাধ্যমে Terrorism করেন। ফ্রান্স বিপ্লবের সময় কয়েক মাসে বিশ হাজারের বেশি মানুষকে গিলোটিন (Guillotine)-এর মাধ্যমে হত্যা করা হয়। জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন ও গণহত্যার মাধ্যমে জিউ (TUTSI)-দের নির্মূল করা হয়। রুয়ান্ডা প্রেসিডেন্ট বিমান হামলায় নিহত হওয়ার সাথে সাথেই হুটুরা (UTUH) টুসসিদের (TUTSI) হত্যার মাধ্যমে নির্মূল করে। পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করলে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়। দেশে দেশে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাহীনদের প্রতি সন্ত্রাস করা হয়েছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার জন্য সন্ত্রাসবাদের অনেক ঘটনা ঘটেছে।
নিউইয়র্ক ভিত্তিক সংগঠনAnti-Defamation League-এর জরিপ মতে, ‘২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠিত ৭১% সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপাত্যবাদীরা এবং ২৬% সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে মুসলিম চরম পন্থীরা।’ Institute for Economic and Peace of Australia মতে, ‘সন্ত্রাসী হামলা দিন দিন বেরেই চলেছে।’
শ্রীলংকার ইতিহাস অনেক রক্তঝরা ইতিহাস। তামিল টাইগাররা ১৯৮৩ সালে ১৩ জন শ্রীলংকান সৈনিককে হত্যা করে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। ঐ গৃহ যুদ্ধ ২৬ বছর চলার পর ২০০৯ সালে তামিল টাইগারদের হত্যার পর গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলেও একটি পৃথক রাজ্য অর্জনের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম পুনরায় শুরু করার ঘোষণা তখনই তামিলরা দিয়েছিল।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ৫৪৩-৫০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলংকার প্রথম রাজা ছিলেন রাজুমার বিজয় সিংহ, যিনি ভারতের সিংহপুর থেকে বিতাড়িত হয়ে শ্রীলংকা জয় করে সেখানে রাজত্ব শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ২১ মে দক্ষিণ ভারতের তামিল নাড়– রাজ্যের শ্রীপেবামবুদ্যুর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীসহ ১৫ জন নিহত হওয়ার পিছনে শ্রীলংকায় ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ঘটনা জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৯৯৩ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানা সিংহে প্রেমাদাসাকে তামিল টাইগাররা হত্যা করে। ১৯৯৫ সালে নৌবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে বিদ্রোহীরা শুরু করে ‘তৃতীয় ইলম যুদ্ধ’। তখন থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে সেখানে গৃহযুদ্ধ। ৫৪ বছর বয়সী তামিল টাইগার প্রতিষ্ঠাতা প্রভাকরণকে হত্যার মাধ্যমে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করলেও শ্রীলংকার গৃহ বিবাদের এখনো অবসান হয় নাই। এ গৃহ বিবাদ বর্তমানে চরমে। মাত্র ৬ মাস পূর্বে রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। এ নিয়েও চরম উত্তেজনা বিরাজমান।
জঙ্গী বা সন্ত্রাসবাদের উপর বিশেষ গবেষণা করে DAVID RAPOPORT আন্তর্জাতিক Terrorism-কে চারটি স্তরে ভাগ করেছেন। তার মতে, এক নায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৮৮০ সালে রাশিয়াতে প্রথম স্তরের সন্ত্রাসবাদ শুরু হয়, যা ১৯২০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় সন্ত্রাসবাদ শুরু হয় ঔপনিবেশবাদের (Anti Colonial) বিরুদ্ধে, যা ১৯২০ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত চলে। বামপন্থী চিন্তাধারার রাষ্ট্র পরিচালনার ভাবধারা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় সন্ত্রাসবাদ অব্যাহত থাকে। উক্ত সময়ে পশ্চিম জার্মানির জবফ অৎসু Faction, ইতালির Red Brigades, ফ্রান্সের French Action Directe প্রভৃতি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন গড়ে উঠে। উধারফ David Rapoport এর মতে, ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লব, সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগানিস্তান দখলের কারণে ইসলামী চরমপন্থী যুগের সূচনা হয়। ১৯৮৩ সালে ‘হিজবুল্লাহ’ নামক শিয়া সংগঠন গঠন এবং ২০০১ সালের ১ নভেম্বর আমেরিকার ডড়ৎষফ ঞৎধফব ঈবহঃবৎ আক্রমণের মধ্যে দিয়ে চরমপন্থী ইসলামী সংগঠনের ব্যাপক আত্মপ্রকাশ ঘটে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বে মানবতা বা নৈতিকতার কোনো স্থান নাই। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব একটি মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বার্থের ফলে সংঘাত (Conflict) অথবা আপোস(Compromise)এর মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক চলমান রয়েছে। মূলত ভারত কাগজে-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ধর্মীয় সংঘাত অর্থাৎ মুসলিম নিধন ভারতেই বেশি হয়েছে। মোদি সরকার নিজেই মুসলিম বিদ্বেষী। অন্যদিকে মোদিকে ঠেকাতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা মুসলমানদের পক্ষাবলম্বন করেছে। এগুলি সবই নিজ স্বার্থ ভিত্তিক নাটক মাত্র।
বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি হচ্ছে ‘জীব হত্যা মহা পাপ’। অথচ মিয়ানমারে মুসলমানদের হত্যা করতে বৌদ্ধদের পাপ হয় না(!) মিয়ানমারে রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম গণহত্যা হচ্ছে, যার সমর্থন দিচ্ছে চীন ও ভারত। এখানেও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত। মানবতা ও নৈতিকতার স্থান নাই। সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপ দখলকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সূত্রপাত হতে পারে। এই প্রবাল দ¦ীপটির নাম ছিল জাজিরা। অধিকমাত্রায় নারিকেল গাছ থাকায় পরবর্তীতে দ্বীপটি নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অবহিত হয়। ব্রিটিশ পর্যটক সেন্ট মার্টিন এখানে আগমনের পর থেকেই দ্বীপটি তার নাম অনুসারে পরিচিত হতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা উক্ত পর্যটক একজন সাধু ছিলেন। দ্বীপটি লম্বা ৮ মাইল, পাশে কোথাও ১, কোথাও দেড় মাইল। প্রশাসনিক স্তর হিসাবে দ্বীপটি একটি ইউনিয়ন এবং টেকনাফ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে টানপোড়ন শুরু হয়েছে, যার উসকানি মিয়ানমার সরকার দিচ্ছে। ২৮১ কিলোমিটার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মধ্যে ৬৩ কিলোমিটারই পানি সীমান্ত এলাকা, যার জন্য মিয়ানমার লোলুপ দৃষ্টি দ্বীপটির প্রতি রয়েছে। মিয়ানমার এখন দ্বীপটি নিজের বলে দাবি করার পর থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পাহারা জোরদার করেছে। ভৌগোলিক অবস্থান থেকে দ্বীপটি অর্থনৈতিক ও সমারিক দৃষ্টি কোণ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও এর অপূর্ব পর্যটন গুরুত্ব রয়েছে। দ্বীপটির একটি অংশ ‘ছেড়া’ দ্বীপে এখনো কোনো জনপদ গড়ে উঠে নাই। দ্বীপটি রক্ষণাবেক্ষণে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল বাংলাদেশ তা করে নাই। তবে সম্প্রতি পর্যটক সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গা ও সেন্ট মার্টিনকে নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি যে কোনো সময় যে কোনো দিকে মোড় নিতে পারে।
৩০ বছর গবেষণা করে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদের সর্বসম্মত বা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা জাতিসংঘ দিতে পারে নাই। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একটি সংজ্ঞা প্রদান করেছে। তারা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী তালিকা থেকে হিজবুল্লাহকে বাদ দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। ফলে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদ নির্মূলের বা প্রতিবন্ধক সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক ঐক্যমত সংজ্ঞা এখনো প্রকাশিত হয় নাই। কেউ অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্র হাতে নেয়, অন্যদিকে ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়ের জন্য অস্ত্রধারীর অভাব নাই। তবে আমি মনে করি, কোনো কারণেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে একজন নিরস্ত্র মানুষের উপর অস্ত্রের আঘাত বা বোমা বিস্ফোরণে হত্যা পৈশাচিক এবং মানবতার চরম লংঘন। এটা কোনো নৈতিকতা বা আর্দশ হতে পারে না। এটা সভ্যতার জন্য কলংক। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে নিরস্ত্র ব্যক্তির উপর হামলার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ এবং নিরস্ত্র মানুষের উপরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো এক হতে পারে না। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখা অথবা নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচারের প্রতিবাদে সন্ত্রাসবাদের সূচনা হলেও নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা সভ্যতার জন্য একটি কলংক এবং মানবতাবিরোধী।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন