মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভ্যাট-ট্যাক্স না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

আগামী অর্থবছর (২০১৯-২০২০) থেকে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন করে ভ্যাট আরোপ কার্যকর করতে যাচ্ছে। বছর দুয়েক আগে ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ও অন্যান্য খাতে ভ্যাট আরোপ করা নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। ব্যবসায়ীরাও এর বিরোধিতা করে। তাদের প্রতিবাদের কারণে সরকার পরবর্তী দুই বছরের জন্য নতুন ভ্যাট আরোপ স্থগিত ঘোষণা করে। দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আগামী অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এনবিআর চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ভ্যাটের ¯ø্যাব যাই নির্ধারণ করা হোক না কেন, আগামী অর্থবছর থেকে ব্যবাসীয়দের জন্য ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হবে। বর্তমানে যেসব ব্যবসায়ীর বার্ষিক টার্নওভার ৮০ লাখ টাকা তাদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক নয়। আগামী অর্থবছর থেকে এই নিয়ম আর থাকছে না। তিনি বলেন, যারাই ব্যবসা করছে তাদের প্রত্যেককে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই রেজিস্ট্রেশন ছাড়া তারা ব্যবসা করতে পারবে না। ক্ষেত্র বিশেষে ভ্যাটের হার নির্ধারণ করা হয়েছে শতকরা ১৫ ভাগ। অন্যান্য খাতের হার বাজেটের সময় নির্ধারণ করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি নানা সমস্যার মুখোমুখির মধ্য দিয়ে চলছে। নতুন করে এই ভ্যাট আইন কার্যকর হলে বিনিয়োগ, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। তারা এ আইন কার্যকর না করে, ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। ভ্যাটের হার বাড়ানো সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না বলে তারা মনে করছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে যখন ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো হয়, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। এতে ব্যবসায়ীদের তেমন সমস্যা হয় না। কারণ ভ্যাটটা ব্যবসায়িরা ক্রেতাদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়। তবে এতে ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখোমুখি হন। অতিরিক্ত ভ্যাট চার্জ বা যে খাতে ভ্যাট বসানোর প্রয়োজন নেই, সেসব খাতের ব্যবসা ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং তারা তাদের ব্যয় সীমিত করে ফেলে। এতে ব্যবসার স্বতঃস্ফূর্ত গতি স্থবির হয়ে পড়ে। সীমিত আয়ের যে মানুষটি মুদি দোকান থেকে নিয়মিত বাজার-সদায় করেন তাকে যদি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে অতিরিক্ত হারে ভ্যাট দিতে হয়, তবে তার স্বাভাবিক যে কেনাকাটা তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তার জীবনযাপন ব্যয়ও সংকুচিত হয়ে আসে। যারা অগাধ অর্থ-বিত্তের মালিক তাদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে না। তবে যেহেতু ব্যবসায়ীকেই পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহ করতে হয়, ভ্যাটের অতিরিক্ত হারের কারণে তাদেরও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। পণ্য উৎপাদন এবং বিক্রির সাথে যদি সমন্বয় না থাকে, তবে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই এর ক্ষতির শিকার হয়। উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা যে নতুন ভ্যাট আইনের বিরোধিতা করছে, তা এ কারণেই। দুই বছর আগে স্থগিত হওয়া নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে শিক্ষাখাতসহ বিভিন্ন সেবামূলক খাতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। বেসরকারি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে দেখা যাবে টিউশন ফি ও বেতন অনেক বেড়ে যাবে। এতে একজন সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হবে। শুধু তাই নয়, খেটে খাওয়া মানুষকেও যখন ভ্যাট প্রদানের মাধ্যমে জিনিসপত্র কিনতে হবে, তখন তার পক্ষেও অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা সম্ভব হবে না। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে যদি তাকে ভ্যাট দিতে হয়, তবে তার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। এনবিআর চেয়ারম্যান যেভাবে ভ্যাট কার্যকর করার কথা বলেছেন, তাতে সামন্ত্যযুগীয় জমিদারদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রজা কীভাবে খাজনা দেবে জমিদারের তা দেখার বিষয় নয়। সামর্থ্য না থাকলেও, যেভাবেই হোক তাকে খাজনা দিতে হবে। না দিলে তার ভিটামাটি ক্রোক করে নেয়া হবে। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা নিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কথায় অনেকটা এমনই মনে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা নিয়ে ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে সচেতন মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা কার্যকর হলে এ নিয়ে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠা অমূলক নয়। তবে এ কথাও সত্য, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট-ট্যাক্সের প্রয়োজন। তার অর্থ এই নয়, জোর করে বা জনগণকে অসুবিধার মধ্যে ফেলে আদায় করতে হবে। বরং জনগণের যাতে কোনো সমস্যায় না পড়তে হয় এবং ব্যবসায়ীরাও যাতে কোনো ধরনের চাপ অনুভব না করেন, এমন প্রক্রিয়ায় রাজস্ব নির্ধারণ ও আহরণ করা উচিত।
আমরা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। দেশও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে যাতে কোনো আইন বা নিয়ম যা অর্থনৈতিক কর্মকাÐে ব্যাহত করতে পারে, তা করা অপরিণামদর্শীতা ছাড়া কিছু হবে না। এটা নীতিনির্ধারকদের না বোঝার কোনো কারণ নেই যে, ব্যবসা-বাণিজ্যকে যত সহজ করে দেয়া যায়, অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যও তত বৃদ্ধি পায়। দেখা যাচ্ছে, নতুন যে ভ্যাট আইন কার্যকর করার কথা বলা হচ্ছে, তা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বেশিরভাগ মানুষ তার পক্ষে নয়। এই আইন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে বলেই তারা বিরোধিতা করছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরে কোনো করহার বাড়ানো হবে না। তার এ ঘোষণা অত্যন্ত ইতিবাচক। এতে অর্থনীতি গতিশীল হবে এবং ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও স্বস্তিতে থাকবে। এ কথাও বলা প্রয়োজন, আমাদের সতের কোটি মানুষের মধ্যে ট্যাক্স প্রদানের হার খুবই নগণ্য। সহনীয় পর্যায়ে ট্যাক্স হার নির্ধারণ করে করদাতার সংখ্যা কীভাবে বাড়ানো যায়, এ প্রক্রিয়া জোরালো করা প্রয়োজন। তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি আতঙ্ক হয়ে থাকা নতুন ভ্যাট আইনও সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করার প্রয়োজন হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন