শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

রমাদান শ্রেষ্ঠতম মাস

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

রমাদান শ্রেষ্ঠতম মাস। আরবি বারো মাসের মধ্যে রমাদান নবম মাস। বছরের বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসটির ফযিলত ও বরকত অনেক বেশি। কেননা রমাদান হলো সিয়াম পালনের মাস, পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস, কুরআন তিলাওয়াতের মাস, তারাবীর সালাত আদায়ের মাস, লাইলাতুল কদরের মাস, ইতিকাফের মাস, দান-খয়রাতের মাস, ইবাদত-বন্দেগির মাস, সওয়াব ও নেকি অর্জনের মাস। রমাদান বদর যুদ্ধের মাস, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাস, সংযম, সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস। রমাদান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। রমাদান জান্নাত লাভের মাস ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। রমাদান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। বলতে গেলে রমাদান আরো বহু গুণে গুণান্বিত একটি মাস। যে সকল গুণাবলী রমাদান মাসকে শ্রেষ্ঠতম মাসে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১. কুরআনে রমাদান মাসের নাম উল্লেখ আছে
বছরে বারোটি মাস। কিন্তু আলকুরআনে রমাদান ছাড়া অন্য কোন মাসের নাম উল্লেখ করা হয়নি। শুধুমাত্র রমাদান মাসের নাম উল্লেখ রয়েছে। কুরআনের বাণী, ‘রমাদান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।’ [সূরা বাকারা : ১৮৫]
২. রমাদান কুরআন নাযিলের মাস
আলকুরআন হলো, পবিত্র আত্মা জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর সর্বশেষ কিতাব। এটি ইসলামী জীবনদর্শনের মূল উৎস। এতে আছে মানুষের জীবন চলার যাবতীয় প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি, নির্দেশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক তথ্য। কুরআন মানবরচিত কোনো গ্রন্থ নয়। তার রচয়িতা ও রূপকার গোটা বিশ্ব জাহানের অধিপতি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। ইসলামী জীবনব্যবস্থা বাস্তবায়নের প্রয়োজনে নবুওয়্যাতের সুদীর্ঘ তেইশ বছরে ইহা নাযিল হয়। আলকুরআন মানুষের জীবনে পরম শান্তি ও শৃঙ্খলা এবং পরলৌকিক জীবনে মুক্তির সন্ধান দেয়। ইহা বিশ্ব মানবতার জন্য শাশ্বত ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। আর এ কুরআন রমাদান মাসে অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘রমাদান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।’ [সূরা বাকারা : ১৮৫]
৩. রমাদান আল্লাহর মাস
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “শা’বান আমার মাস, আর রমাদান হলো আল্লাহর মাস’ (মা’সাবাতা বিস্সুন্নাহ)। রমাদান মাসে সিয়াম পালন করলে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদান ঘোষণা করেছেন এভাবে : ‘মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকীর সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, কিন্তু সিয়ামের ব্যাপারটা ভিন্ন। কেননা তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করব। বান্দা একমাত্র আমার জন্যই নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে।’ [সহীহ মুসলিম : ১১৫১]
৪. রমাদান সিয়াম পালনের মাস
ইসলামের পাঁচটি রুকনের একটি রুকন হল সিয়াম। আর রমাদান মাসে সিয়াম পালন করা ফরয। সেজন্য রমাদান মাসের প্রধান আমল হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’’ [সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫]
৫. রমাদান কুরআন তিলাওয়াতের মাস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদান ব্যতীত কোন মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘রমাদান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস সিয়াম পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি।’’ [সহীহ মুসলিম : ১৭৭৩]
৬. রমাদান কুরআন খতমের মাস
রমাদানে যেহেতু প্রতিটি ইবাদাতের সাওয়াব ৭০ গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাই এ মাসে যথাসাধ্য বেশি বেশি কুরআন কুরআন খতম করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘সিয়াম ও কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।’ [আহমাদ : ৬৬২৬]
৭. রমাদান সালাতুত তারাবীহ পড়ার মাস
সালাতুত তারাবীহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবীহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমাদানে কিয়ামু রমাদান (সালাতুত তারাবীহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [সহীহ আল-বুখারী : ২০০৯]
তারাবীহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবীহ) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে।’’ [সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭]
৮. রমাদান সাহরী খাওয়ার মাস
সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে, ‘‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন।’’ [মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১]
৯. রমাদান ইফতার করার মাস
সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ আমল। কোন বিলম্ব না করা । কেননা হাদীসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র। ’’ [সুনান আবু দাউদ : ২৩৫৭]
১০. রমাদান ইফতার করানোর মাস
অপরকে ইফতার করানো একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে ইফতার করানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা হাদীসে এসেছে, ‘‘যে ব্যক্তি কোন সিয়ামপালনকারীকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না।’’ [সুনান ইবন মাজাহ : ১৭৪৬]
১১. রমাদান রহমতের মাস
মুমিনদের জন্য অধিকতর রহমত ও আমলের মাস হলো রমাদান। আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘রমাদান মাস শুরু হলেই রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়।” [সহীহ মুসলিম : ২৫৪৮]
১২. রমাদান মাগফিরাতের মাস
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, “পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, এক জুম্মা থেকে আরেক জুম্মা এবং এক রমাদান থেকে আরেক রমাদান মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহসমূহকে মুছে দেয় যদি সে কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে।” [সহীহ মুসলিম : ৮৯৬৬]
১৩. রমাদান নাজাতের মাস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ [সহীহ বুখারী : ২০১৪]
১৪. রমাদান শয়তানকে বেড়ি পড়ানোর মাস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘রমাদান-বরকতময় মাস তোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস সিয়াম পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল (মহা কল্যাণ হতে)।’’ [সুনান আত-তিরমিযি : ৬৮৩] (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন