শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তরল দুধে মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান

| প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

আমাদের সমাজে গরুর খাঁটি দুধে পানি মেশানো অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মিশ্রণ ঘটিয়ে অথবা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কৃত্রিম দুধ তৈরী করে বাজারজাত করা শুধু অপরাধই নয়, নাশকতা বলে অভিহিত করা যায়। একশ্রেনীর অসাধু মানুষ অনিরাপদ পানিতে নামমাত্র ননি, গুড়া দুধ, দুধের এসেন্স, লবন, চিনি ও খাবার সোডা মিশিয়ে কৃত্রিম তরল দুধ তৈরী করে গরুর খাঁটি দুধ বলে বাজারে বিক্রি করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে প্রচলিত নামি-দামী কোম্পানীর ব্রান্ডেড তরল দুধের প্রায় সবই মারাত্মক সব রাসায়নিক দূষণ নিয়েই ভোক্তার খাবার টেবিলে যাচ্ছে। এমনটা সম্ভবত: ভাবা যায়নি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সম্প্রতি বাজারের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মানের উপর একটি অনুসন্ধানী গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেছে। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টে জমা দেয়া এই জরিপ রিপোর্টে দেখা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাতকৃত ৯৬টি তরল দুধের মধ্যে ৯৩টিতেই ক্ষতিকর সিসা, আফলাটক্সিন, টেট্টাসাইক্লিন, এনরোফ্লোক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লোক্সাসিনের মত এন্টিবায়োটিকসহ নানা মাত্রার ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও রাসায়নিকের অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় দুধ সাধারণত শিশুখাদ্য, বৃদ্ধ এবং রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুধের মত সুষমখাদ্যে সিসা অনুজীব,ব্যকটেরিয়া ও পেস্টিসাইডের উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তরল দুধে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতির অভিযোগ কোনো নতুন বিষয় নয়। তরল দুধে ক্ষতিকর অনুজীব, ই-কোলাই সহ নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির খবর ইতিপূর্বেও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এসবের প্রতিকারে জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎপরতা এবং আদালতের পর্যালোচনার পর খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া গেছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন এখন সরকারের অবশ্যিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিপূর্বে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি দুধ, দুগ্ধজাত সামগ্রী, পশুখাদ্যসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মান যাচাই ও প্রতিবেদন তৈরীর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রাথমিক অনুসন্ধান রিপোর্ট আদালতে দাখিল করার পর আদালত আগামী ১৫ মে’র মধ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ব্যাকটেরিয়াসহ দুধ, দইসহ দুগ্ধজাত পণ্য তৈরী ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের তালিকা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিপূর্বেও জনস্বার্থ ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে আদালত থেকে নির্দেশনা জারি করা হলেও সে সব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রনালয়ের গাফিলতি ও ব্যর্থতা সীমাহীন।
নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ ভোক্তাদের এক প্রকার নাভিশ্বাস অবস্থা। একদিকে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ করে তোলার মূল কারিগর প্রান্তিক কৃষকরা পণ্যের ন্যয্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যদিকে সরকারের সংস্থাগুলো পণ্যমূল্য এবং খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সভ্য দুনিয়ার কোথাও নিত্যপণ্য, দুধ, শিশুখাদ্য, ওষুধ-পথ্যে এমন ভেজাল ও রাসায়নিক দূষণের নজির নেই। দেশে লাখ লাখ মানুষের নানা রকম দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণই হচ্ছে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য ও পানি। ঢাকা ওয়াসার দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার নাগরিক জীবনে অন্যতম আলোচিত বিষয়। দুধ, শিশুখাদ্য, পশুখাদ্য, পোল্ট্রি, ফরমালিনযুক্ত ফলমূল, মাছ-গোশত্সহ প্রায় সব খাদ্যপণ্যেই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। সরকারের মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব বিভাগ যেন এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নিরুপায় ও নির্বিকার। অথচ এসব ভেজাল ও দূষণের শিকার হচ্ছে দেশের প্রতিটি পরিবার। তরল দুধ, গুড়াদুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যসহ সব ধরনের খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মান যাচাই ও মান নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্যাকেটজাত তরল দুধে নানা রকম ব্যাকটেরিয়া এবং এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থেকে পশুখাদ্য ও দুগ্ধখামারে মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণে মানহীনতার প্রমান পাওয়া যায়। খাদ্যের মান যাচাই ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দীর্ঘদিন যাবৎ জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য দায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আর্থিক জরিমানা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন