হজরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.)-এর বংশধর এবং ‘হাজভের’ নামক কসবায় (গজনির এলাকা) হিজরী ৪০০ (১০০৯) সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর স্বীয় পীর হজরত আবুল ফজল মোহাম্মদ ইবনে হাসান (রহ.) তাকে নির্দেশ দেন; ‘আলী! যাও, নিজের জীবনকে সত্যের প্রচার ও ইসলামের প্রসারের জন্য উৎসর্গ করে দাও। দ্বীনের তবলিগে আত্মনিয়োগ করো।’
সমগ্র হিন্দুস্তান কুফর ও শিরকে ভরে গেছে। তুমি লাহোরে যাও এবং তাকে নিজের অবস্থানকেন্দ্র করে মূর্তিপূজকদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দা বানানোর কাজ শুরু করো। এ পথে তোমাকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং দুঃখ-কষ্টও ভোগ করতে হবে।
কিন্তু প্রতি কষ্ট ও প্রতিটি সঙ্কটকে আনন্দের সাথে বরণ করো এবং ‘এলায়ে কালেমাতুল্লাহ’ (আল্লাহর বাণী বুলন্দ করা) ব্যতীত কোনো কিছুর পরোয়া করো না। তুমি আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখবে, আল্লাহ তোমার নামকে বুলন্দ করবেন। তুমি হিন্দু ভূখন্ডের রূহানি মৃতদের জীবন্ত করবে। আল্লাহ তোমাকে চিরন্তন জীবন দান করবেন। তুমি আল্লাহর নাম জীবন্ত করো, আল্লাহ তোমায় কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত রাখবেন।’
হজরত দাতা গঞ্জে বখশ স্বীয় মুর্শিদের এরূপ হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী উপদেশ শ্রবণ করে তা পালনে কোনো বৈষয়িক সামান উপকরণ ছাড়াই কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ পদব্রজে রওনা হয়ে যান এবং লাহোরে পৌঁছে খুব দ্রুত সে কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যে জন্য তাকে প্রেরণ করা হয়েছিল।
সে সময় লাহোরে গোর্খ এলাকা কুফর ও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। হজরত আলী হাজভেরী (রহ.)-এর বদৌলতে তওহিদের আলোর রশ্মিগুলো বুলন্দ হয়ে সমগ্র পাঞ্জাবকে আলোকিত করে এবং তারই ওয়াজ এবং তবলিগের ফলে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ঈমান আনে এবং মূর্তির সামনে মাথানতকারীরা একমাত্র আল্লাহর বান্দা হয়ে যায়।
যেসব লোক হজরতের ওয়াজ-নসিহত এবং তাবলিগে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়, তাদের মধ্যে ‘রায় রাজু’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ব্যক্তি সুলতান মওদুদ ইবনে মাসউদ গজনভীর পক্ষ থেকে লাহোরের শাসনকর্তা ছিলেন। মুসলমান হওয়ার পর হজরত দাতা গঞ্জে বখশ তাকে ‘শায়খে হিন্দি’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন এবং এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
বর্ণিত আছে যে, এক বৃদ্ধ মহিলা দুধের কলস নিয়ে যাওয়ার কালে হজরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) তার কাছে সামান্য দুধ চান। বৃদ্ধা অপারগতা জানিয়ে বলেন, তিনি ‘রায় রাজু’র জন্য দুধ নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যদি দুধ সেখানে না পৌঁছান তাহলে তার গাভী-মহিষের ওলান হতে দুধের পরিবর্তে খুন (রক্ত) নির্গত হতে আরম্ভ করবে।
দাতা সাহেব বৃদ্ধাকে অভয় দিয়ে বললেন, রক্ত বের হবে না, বরং দুধ বেড়ে যাবে। সুতরাং বৃদ্ধা তাঁর সমীপে দুধ পেশ করেন। দাতা সাহেব তার প্রয়োজন অনুাপাতে দুধ গ্রহণ করেন এবং অবশিষ্ট দুধ দরিয়ায় ঢেলে দেন। দেখা গেল, এ বৃদ্ধার পশুগুলোর দুধ সত্যি সত্যিই বেড়ে গেছে। পরিণামে অন্যান্য লোকেরাও ‘রায় রাজু’র অংশ হজরত দাতা সাহেবের খেদমতে পেশ করতে লাগল।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যোগী শাসক খোদ অবস্থা পর্যবেক্ষণে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থলে আগমন করেন এবং হজরত দাতা সাহেব (রহ.)-এর কাছ থেকে আরো কিছু কারামত দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু দাতা সাহেব বলেন, ‘আপনার নিকট কোনো অলৌকিক ঘটনা থাকলে আগে তা প্রদর্শন করুন।’
অবশেষে তিনি (রায় রাজু) তার এই কারিশমা উপস্থাপন করেন যে, তিনি বাতাসে উড়াল দিয়েছেন। তখন দাতা সাহেবের ইশারা পেয়ে তার জুতো জোড়া যোগীর মাথার ওপর আঘাত করতে লাগলে এ জুতো মারের ফলে তার মাথা ঠিক হয়ে যায় এবং রায় রাজু তাওবা করে হজরত দাতা গঞ্জে বখশের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন। হজরত দাতা সাহেব (রহ.) তাকে ‘শায়খে হিন্দি’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন।
অপর এক বর্ণনা অনুযায়ী মুসলমান হওয়ার পর ‘শায়খে হিন্দি’ তার দৃঢ় ও ইখলাসে এতই উন্নতি লাভ করেন যে, হিজরী ৪৬৫ (১০৭২) সালে স্বীয় মুর্শিদের ইন্তেকালের পর তিনিই তার হেদায়েত তাবলিগের আসনে আসীন হন এবং তাঁর গদিনশিন হন। সারা জীবন তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসারে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন এবং স্বীয় মুর্শিদের শিক্ষা ও ইসলামের বাণী লোকদের মধ্যে পৌঁছাতে থাকেন এবং এ ধারা রায় রাজুর বংশে অব্যাহত থাকে।
তারাই হজরত দাতা গঞ্জে বখশের দরগাহের ঝাড়–দার, খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হন এবং সরকার কর্তৃক দরগাহের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার আগ পর্যন্ত তারাই খাদেমের দায়িত্ব পালন করেন। হজরত দাতা সাহেব যেখানে আসন গ্রহণ করতেন, পরবর্তীকালে সেখানে মর্মর পাথরের লগন (বারকোব) বসানো হয়, যাকে চশমা (ঝরনা) বলা হয়। এ ঝরনা হতে লোকেরা ভক্তি সহকারে পানি নিয়ে যায়।
রূহানি শক্তিতে বলিয়ান বহু কারামতের অধিকারী হজরত দাতা গঞ্জে বখশ শায়খ আবুল হাসান আলী হাজভেরী (রহ.) এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে লাহোরের হিন্দু যোগী শাসক রায় রাজু কেবল নিজের জীবনকেই ধন্য করেননি, তিনি হজরত দাতা সাহেবের সান্নিধ্যে থেকে তাবলিগ প্রচারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন