শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

এরশাদের জাপায় বৈশাখী ঝড়

জি এম কাদের কার্যকর বিরোধী দল; রওশন চান ক্ষমতাসীনদের তল্পিবাহক

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

৯০ বছর বয়সে বয়সের ভারে ন্যুব্জ এইচ এম এরশাদের সঙ্গী এখন হুইল চেয়ার। এক সময়ের দোর্দান্ত প্রতাপশালী এই লৌহমানব এখন চলাফেরা করতে পারেন না। জীবদ্দশায় তার প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে চলছে কামড়াকামড়ি। তিনি যাদের নেতা-মন্ত্রী-এমপি বানিয়েছেন, তাদের ‘বাড়াবাড়ি’ নীরবে হজম করেন। তার স্বপ্নের জাপার ভেতরে উঠেছে বৈশাখী ঝড়। এই ঝড় কি দলকে ভেঙেচুরে নিয়ে যাবে? এক দিকে পরিচ্ছন্ন নেতা ভাই জি এম কাদের; অন্য দিকে দলকে ক্ষমতাসীনদের বি-টিম বানানো স্ত্রী রওশন এরশাদ। নেতাকর্মীদের অভিমত এরশাদ তার বিকল্প ‘নেতা’ চিনতে ভুল করেননি। জাপায় এই বৈশাখী ঝড়ে কেউ আম কুড়াচ্ছেন; আবার কেউ হচ্ছেন ক্ষতবিক্ষত। ৪ মে জি এম কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ায় মূলত এই ঝড়ের আবির্ভাব। এরশাদের এই ‘হঠাৎ’ সিদ্ধান্তে সাধারণ কর্মীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা; কিন্তু নাখোশ বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী রওশনপন্থীরা। তাদের আশা, আবারো এরশাদের মত পরিবর্তন হবে। জি এম কাদেরকে সরিয়ে তাদের পক্ষভুক্ত কাউকে দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাবেন আনপ্রেডিক্টেবল এরশাদ। তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও প্রত্যাশা করছেন। তবে দলের সাধারণ নেতারা বলছেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ এরশাদ নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে আর চিন্তা করবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে কেন্দ্র ও তৃণমূলে জি এম কাদেরের যে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, অন্যদের তা নেই।
এরশাদ দলের কিছু নেতার ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত। তাদের তিনি ভবিষ্যতে দলের জন্য হুমকি মনে করে থাকেন। এ কারণে তাদের খপ্পর থেকে নিজের সম্পদ রক্ষায় বনানী থানায় জিডি করেছেন এইচ এম এরশাদ। দলের এই নেতাদের কেউ কেউ তার (এরশাদ) সই জাল করে স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ লুটে নিতে পারেন বলে জিডিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া জি এম কাদের চাচ্ছেন বিএনপির অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংসদে জাপাকে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ করতে। সারা দেশে জাতীয় পার্টিকে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু ঝড় তোলা রওশনপন্থীরা চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনদের অনুগত থেকে কিছু পেতে। কেউ কেউ মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর জন্য দেনদরবার করছেন এবং দলকে কাজে লাগিয়েই একসঙ্গে সরকার ও বিরোধী থাকতে চাচ্ছেন।
দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপিকে ‘ভাড়াটে নেতা’ দিয়ে দল পরিচালনা করতে হলেও এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সে অবস্থায় পড়তে হয়নি। সুবিধাবাদী রাজনীতি এবং গণবিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার কারণে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন দলটি এখনো নেতাশূন্য নয়। দলটির নেতাকর্মীদের মতে, এরশাদের বিকল্প নেতা দলে সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্য ব্যাক্তিকেই বেছে নিয়েছেন এরশাদ। তবে ঝামেলা পাকিয়েছেন রওশন এরশাদসহ কয়েকজন সুবিধাবাদী নেতা। দলের শক্তি বৃদ্ধির চেয়ে সরকারের অনুগত হয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টায় তারা সব সময় ব্যতিব্যস্ত থাকেন। দলে এদের কাউকে কাউকে আবার বলা হয় ‘বসন্তের কোকিল’। সুসময়ে থাকেন অসময়ে উড়ে যান। যাকে নিয়ে তাদের এই গুঞ্জন সেই রওশন এরশাদ দেশের অন্য দুই শীর্ষ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কারাবন্দী বেগম খালেদা জিয়ার মতো জনমনা নেত্রী নন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করা এবং দলকে সুসংগঠিত করার প্রয়াসও তার মধ্যে নেই। ১৯৯৫ সালে মিজানুর রহমান চৌধুরী যখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তখন বন্দী এরশাদের চিঠি পেয়ে রওশন এরশাদ ও জিনাত মোশাররফকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করতে বাধ্য হন। জিনাত এখন সুদূর অতীত। জাপার নেতারা জানান, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে রওশন এরশাদ ইশপের গল্পের রাক্ষস চরিত্রের ভূমিকায় আবতীর্ণ হন। রাক্ষস যেমন মানুষের গন্ধ পেলে অস্থির হয়ে ওঠে; তেমনি রওশন টাকার গন্ধ পেলে অস্থির হয়ে ওঠেন। এ জন্যই রওশন এরশাদ স্বামী এরশাদকে বাদ দিয়ে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ওয়ান-ইলেভেনের কারণে ওই নির্বাচন বাতিল করা হয়। বনানীর হাওয়া ভবনে রওশনের ছিল নিত্য যাতায়াত। ওই বছরই তিনি জাতীয় পার্টি থেকে এরশাদকে বহিষ্কার করে নিজেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। বর্তমানে সউদী আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহকে করেন দলের মহাসচিব। ওই একই কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি অংশগহণ করেন। তার তাছে অর্থই সব দলের আদর্শ, নীতি-নৈতিকতা অর্থহীন। রওশন এরশাদের এই দুর্বলতা বুঝতে পেরে কয়েকজন নেতা তাকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বি-টিম করে রাখার কৌশল গ্রহণ করেন। এসব তথ্য দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টি নিয়ে গত কয়েক মাসে নানান খেলা হয়েছে। জি এম কাদেরকে দল ‘উইল’ করে দেয়া, তাকে ভবিষ্যৎ দলের নেতা এবং সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার পদে বসানো হয়। পরবর্তীকালে তাকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। জি এম কাদেরকে সরিয়ে দিয়ে সংসদের উপনেতা করা হয় রওশন এরশাদকে। জি এম কাদেরকে তার কো-চেয়ারম্যান পদ ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার নেতারা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তারা প্রয়োজনে দল থেকে পদত্যাগ এবং রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম প্রতিহতের ঘোষণা দেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ’৯১ সালের নির্বাচনে এরশাদের মনোনয়ন পত্র বৈধ করার দাবিতে আন্দোলনের আদলে জি এম কাদেরের পদ ফিরিয়ে দেয়ার দাবির আন্দোলনের ঘোষণা ও আল্টিমেটাম দেন। বাধ্য হয়েই এরশাদ জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদে পুনরায় বসান। ৪ মে জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। অতঃপর জি এম কাদের বলেন, এরশাদ যতদিন বেঁচে রয়েছেন তার নির্দেশেই দল চলবে। আমরা তার ইচ্ছামতো কাজ করব। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রুটিন ওয়ার্ক করার জন্য। আমি রাজা বা জমিদার হওয়ার রাজনীতি করি না। দলের সবাই মিলে রাজনীতি করব। দলকে শক্তিশালী করে এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। কিন্তু বেঁকে বসেছেন সুবিধাবাদী নেতারা। জানতে চাইলে পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় বলেন, জি এম কাদের জাতীয় পার্টির যোগ্য উত্তরসূরি। এরশাদের অসমাপ্ত কাজ, তার স্বপ্ন আগামীতে জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই বাস্তবায়ন হবে। জাতীয় পার্টি ও এরশাদ পরিবার একই সূত্রে গাঁথা। যারা নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে পরিবারের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছেন, তারা ভবিষতে মীরজাফর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। দলের প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য বলেন, যদি ভোটও হয় তাহলে দলের ভবিষ্যৎ নেতা নির্বাচিত হবেন জি এম কাদের। দলে অন্য যারা রয়েছেন তারা বিতর্কিত। তাদের কারোই ব্যক্তি ইমেজ ও কর্মকান্ড পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু জি এম কাদের পরিচ্ছন্ন এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তবে তার দুর্বলতা তিনি কর্মীবান্ধব নন। কিন্তু দলের কিছু নেতা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য রওশন এরশাদকে ব্যবহার করে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বি-টিম বানিয়ে রেখে এরশাদের জীবদ্দশায় দলকে ‘শেষ’ করতে চাচ্ছেন।
এর মধ্যে গত ৯ মে এরশাদ পার্টির গঠনতন্ত্রে ২০১ক ধারা মোতাবেক ৮ জনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন- সৈয়দ দিদার বখত (সাবেক মন্ত্রী), কাজী মামুনুর রশিদ (ব্যবসায়ী), জাফর ইকবাল সিদ্দিকী (সাবেক এমপি), নাজমা আকতার এমপি, আব্দুস সাত্তার মিয়া, আলমগীর সিকদার লোটন (সাবেক ছাত্রনেতা), এমরান হোসেন মিয়া এবং মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল এমপি। এর প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
রওশনপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা জাতীয় পার্টির এই ঝড় থামানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চাচ্ছেন। তারা চান তিনি জাতীয় পার্টির বর্তমান ঝড়ের একটি সুরাহা করে দেবেন। এরশাদকে চাপ দিয়ে হলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদ থেকে জি এম কাদেরকে সরিয়ে অন্য কাউকে বা রওশন এরশাদকে বাসিয়ে দেবেন। অতীতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে দলের রওশনপন্থী নেতারা বলছেন, এরশাদ সাহেব কখনোই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেননি। বিভিন্ন ঘটনা ও সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের দেয়া সিদ্ধান্ত নিজেই পরিবর্তন করেছেন। সেই সূত্রে জি এম কাদেরকে নিয়ে এরশাদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেখানে পরিবর্তন এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জি এম কাদের টিকবে না। রওশনপন্থীদের দাবি দলে তাদের অবস্থান দৃঢ় এবং নেতাকর্মীর বেশির ভাগই তাদের সঙ্গে রয়েছেন। ফলে কাউন্সিল হলে জি এম কাদেরের পক্ষে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব নয়। তবে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ নেতাই এরশাদের বিকল্প জি এম কাদেরকেই মনে করছেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, মুজিবুল হক চুন্নু, কাজী ফিরোজ রশিদ, রওশন এরশাদসহ অনেকের নাম উল্লেখ করে তারা বলেন, এদের কেউ দলছুট, কেউ অন্যদলে গিয়ে পরে জাপায় এসেছেন। এদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। এরশাদের আলোয় আলোকিত। এরা বিতর্কিত।
সূত্র জানায়, দলটির রওশনপন্থীদের মধ্যে আলোচনা চলছে মন্ত্রী হওয়া নিয়ে। তারা দলের নেতাকর্মীদের নিজেদের পক্ষ্যে টানতে ইতোমধ্যে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছেন তারা কেউ মন্ত্রী কেউ প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন। বিগত দশম জাতীয় সংসদে যেমন সরকার ও বিরোধী দলে জাতীয় পার্টির অবস্থান ছিল; এবারো সেটাই হবে বলে তারা প্রচার করছেন। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আলোচনায় রয়েছে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুুুজিবুল হক, জিয়াউদ্দিন বাবলু, ফখরুল ইমাম মহিলা এমপি নাজমা আক্তার এবং ব্যারিস্টার শামীম পাটোয়ারীর নাম। এদের মধ্যে দলের মহাসচিব শামীম পাটোয়ারী এবং অন্যরা কেউ মন্ত্রী, কেউ প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন বলে প্রচারণা রয়েছে। মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদের প্রচারণা কার্যত মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো। বাস্তবতায় এদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর হওয়ার বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন