শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আমার মা : আমার অস্তিত্বে মিশে আছেন যিনি

এনামুল হক শামীম | প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

দেখতে দেখতে চলে গেল ৩৬৫ দিন। স্বাভাবিকভাবে ৩৬৫ দিন অথাৎ এক বছর কম সময় হলেও আমার কাছে দীর্ঘ সময়। আজকের এ দিন আমার সবচেয়ে কষ্টের দিন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আপনজন ‘মা’ হারানোর দিন আজ। আমার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে যিনি ছিলেন অপরিহার্য সেই ‘মা’ আজ নেই। আমার সকল কাজের প্রেরণা ও উৎসাহ জোগাতেন যিনি এবং আমি যে কোনো কাজে বের হওয়ার আগে যাকে সালাম করে দোয়া নিয়ে বের হতাম, সেই মায়ের মুখ দেখি না গত ৩৬৫ দিন ধরে। ২০১৮ সালের ১৫ মে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। 

পৃথিবীতে সকল মা সকল সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন ও প্রিয়। মা তো মা-ই...। যারা নিজে না খেয়ে সব সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু আমার মা আমার জন্য তার চেয়েও অনেক বেশি করেছেন। যতদূর মনে পড়ে, ছোটবেলায় (৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়) আমার মা আমাকে ও ছোট ভাই আমিনকে নিয়ে সারাদিন চিৎকার করে কাঁদতেন। কারণ আমার বাবা প্রকৌশলী আবুল হাসেম মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ ছিলেন। তিনি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে চাকরিরত অবস্থা থেকেই জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ৬ মাস পর বাবা ফিরেও আসলেন। তখন বাংলাদেশ স্বাধীন। এই ছয় মাসই মা প্রতিদিন চিৎকার করে কাঁদতেন আমাদের দুই ভাইকে বুকে নিয়ে।
আমি ছাত্র রাজনীতি করার কারণে আমার বাবার সরকারি চাকরিতে প্রায়ই সমস্যা হতো। কারণ ৮৪ থেকে ৯৬ পর্যন্ত আমি জাকসু ভিপি, ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং সর্বশেষ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। তখন বিরোধী দলের রাজনীতি করতাম। জিয়া, এরশাদ, খালেদা সরকারের রোষানলে পড়েছেন আমার বাবা ও সেনা বাহিনীতে চাকরিরত আমার ভাই। মা সবকিছুই সামাল দিয়ে আমাকে উৎসাহ দিতেন। আমাদের রামপুরার বাসায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ছিল অবাধ যাতাওয়াত। ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর কাছেই আমার মা ছিল সকলের মা। মা আমাদের যেমন আদর যত্ম করতেন, ঠিক প্রতিটি ছাত্রলীগের নেতকার্মীকেও তেমনি ভালবাসতেন। আমি বাড়িতে না থাকলেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মা দেখে রাখতেন এবং যাবতীয় দেখভাল করতেন। কখনো কখনো গভীর রাতে বাড়ি ফিরতাম। এসে দেখতাম, মা আমার অপেক্ষায় বসে আছে। কখনো তার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখিনি। ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিতে সকল সংকটেই আমাকে ভরসা দিতেন তিনি। আমার মা সব সময়ই বলতেন, আমার ছেলে বড় হবেই। মার সকল স্বপ্নই ছিল আমাকে ঘিরে। আমার এক ভাই উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা, এক ভাই ডাক্তার, বোনও ব্যাংকার কিন্তু মায়ের সকল স্বপ্নই ছিল আমাকে নিয়ে; আমি বড় হবো, এম.পি হব, মন্ত্রী হব, বড় রাজনীতিবিদ হবো, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাবো- এটাই ছিল মার একমাত্র স্বপ্ন। মায়ের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এমপি ও মন্ত্রী বানিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার মা এমপি ও মন্ত্রী হওয়া দেখে যেতে পারলেন না। আমি যখনই বাসা থেকে বের হই, তখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আমার মায়ের কথা। আজকে আমার অবস্থান দেখে মা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, যে মা আমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন আজ আমি এমপি, মন্ত্রী কিন্তু আমার মা-ই দেখে যেতে পারলেন না। আমার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে আছে?
আমাদের পরিবার ছিল একান্নবর্তী। মা দাদা-দাদীসহ সকল চাচা-চাচীকে আগলে রাখতেন। তিনিই ছিলেন সকলের মধ্য মনি। দেশ ও দশের সেবা করাই ছিল তাঁর ব্রত। নিজের জমি দান করে দিয়েছেন হাসপাতালের জন্য। ১০ শয্যা বিশিষ্ট আশ্রাফুন্নেসা হাসপাতাল হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন দেশের মানুষ। মায়ের অনুপ্রেরণায় ও মহানুভতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়, পোর্ট সিটি বিশ্ববিদ্যালয়, আমেনা রওশন হাফেজিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু মা নেই, মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন, শামীম নির্বাচন করবে, বাড়িতে সকল প্রস্তুতি আছে? কয়েকটি চাদর লাগবে; ১০টি চাদর কিনে দিয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে নেতা-কর্মী ও অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সকল প্রস্তুতি তিনিই নিয়েছিলেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আমার বোন কাকলীর নিকট পাঁচ লাখ টাকা রেখে গেছেন আমার নির্বাচনের জন্য তার নিজের বাড়ি ভাড়া থেকে।
সকল বিষয়েই মা ছিলেন আমার পরামর্শদাতা, সুখ-দুঃখ সব কিছুই বলতাম মাকে। মা বলতেন, তোর কিছু হবে না, আল্লাহ তোকে ভালো রাখবেন। আমার চিন্তা-চেতনায়, অস্তিত্বে, ভাবনায় মাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না। আমার মা বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন জায়নামাজে, রোজা রাখতেন প্রতি সপ্তাহেই। দুই দিন কখনো নামাজ কাজা করতে দেখিনি আমি। মানুষের উপকার করাই ছিল মায়ের একমাত্র লক্ষ্য। রত্মগর্ভা মা ছিলেন পরম দয়ালু ও দানশীল।
আমার মায়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমি সকলের কাছে আমার মায়ের জন্য দোয়া চাই, শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তাঁর কল্যাণ কামনা করি। আল্লাহ যেন আমার মা আশ্রাফুননেসাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সততার সাথে কাজ করার জন্য আমাকে তৌফিক দান করেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির জনকের সোনার বাংলা যেন গড়ার গর্বিত অংশীদার হতে পারি।
লেখক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ উপমন্ত্রী ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন