একসময়ের থৈ থৈ পানি আর পানি নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল প্রায় সাগরে রুপ নিয়েছিল। মাছের গুঁতোয় নাকি নৈাকা চলাচলই দায় ছিল। সেটা এখন রূপকথার গল্পের মতো। এখন সেই অথৈই চলনবিল নদী আর নদী নেই। বর্তমানে সেটা খালে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে প্রমত্ত খরস্রোতের যমুনাও যেন মরা নদীতে পরিনত হওয়ায় শাখা নদ-নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মৃতপ্রায় যমুনার বহুমুখী বঙ্গবন্ধু সেতুর ৪/৫ নং পিলারে দাড়িয়ে চোখ মেলালে দেখা যায় খালের মত রুপতার। চারিপাশে ধু-ধু বালুচর। বিস্তৃর্ন চরে কৃষকেরা চাষ করছে বিভিন্ন ফসল। মৎস্যজীবিরা হচ্ছে বেকার। নৈকার মাঝিমাল্লারা হাপিতিস করছে। সবচেয়ে আশংকার বিষয় হচ্ছে মাঝ নদীতে বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীর গতিপথে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যা দুপাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনচে অশনি সংকেত।
বৃহত্তম চলনবিলের ইতিহাস থেকে জানা যায় চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট বড় ৪০ টি নদী ছিল সিরজগঞ্জের প্রাণ। কালের বিবর্তনে ২৪ টির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। আর ১৬ টির মধ্যে অন্যদিকে জেলার পুর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত যমুনা নদীর বুকে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় যমুনা তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে সারা বছরই নৌ চলাচল করত। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও ১৯৮০’র দশকে পদ্মার উৎমুখে অপরিকল্পিত সুইসগেট নির্মাণের ফলে চলনবিলের বিভিন্ন নদ-নদী ও বিল, জলাশয়, খালগুলো পলি জমে ক্রমে ভরাট হয়ে গেছে।
ক্রমশ নদীটি উত্তর দিকে কাজীপুরের অংশ জামালপুর জেলার দিকে ও পুর্ব তীরে অবস্থিত টাঙ্গাইলের চৌহালী উপজেলার দিকে ঢুকে পড়ছে। গ্রাস করছে বসতভিটা-ফসলী জমি, নিঃস্ব করে ফেলছে চর এলাকার হাজার-হাজার পরিবারকে। যা দু-পাড়ের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অশনি সংকেত। এছাড়াও বেলকুচি-শাহজাদপুরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক হুরাসাগরটিও মরাখালে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে বিলুপ্তির পথে মৎস্য সম্পদ। এক সময় যমুনা ও চলনবিলের মাছ উত্তরাঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও ভারতে রপ্তানি করা হতো। অবিলম্বে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে পুনখনন করা না হলে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে নদীগুলো।
আরো জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, সলঙ্গা, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম ও নওগাঁর আত্রাই নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল গঠিত। গঠনকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮ বর্গ কি.মি। চলনবিলে ছোট-বড় প্রায় ৪০টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল। কালের বিবর্তনে ২৪ টি নদী বিলীন হয়ে গেছে। খালগুলোর অস্তিত্ব নেই। চলনবিলের পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে বিলের আয়তন দাঁড়ায় মাত্র ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে মূল বিলটির আয়তন দাঁড়ায় ১৫.৯ থেকে ৩১ কি.মি। এছাড়া বিলের গভীরতা ১.৫৩ মিটার থেকে ১.৮৩ মিটার।
চলতি দশকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণের পর পানি প্রবাহে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। গতকয়েক বছরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফলে বিলের দেশীয় প্রজাতির প্রায় ৫০ প্রকার মাছের অধিকাংশই বিলুপ্তি ঘটেছে। এছাড়াও জেলার বেলকুচি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহাসিক হুরা সাগরটি এখন মরাখালে পরিণত হয়েছে। মৎস্য বিভাগ থেকে কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নদীর এ খনন কাজ তামাশা ছাড়া অন্য কিছুই না বলে মন্তব্য করেছেন হুরা সাগর পারের বাসিন্দরা। একসময় প্রমত্ত উত্তাল যমুনা নাব্যতা হারিয়ে এখন মরানদীতে পরিনত হয়েছে। যতদুর চোখ যায় বিস্তৃর্ন এলাকাজুরে শুধুই ধু-ধু বালুচর।
এদিকে চলনবিলে মাছ আর পানি ছিল সমান সমান। মাছের গুতোয় নৈাকা চলাচল করা দায় হয়ে পড়তো। চলনবিলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গারিদহ, ফুলজোড়, করতোয়া নদীতে বড় বড় জাহাজ চলাচল করত। বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা হাটের দিন জাহাজে করে মালামাল পরিবহন করা হতো। হাজার হাজার জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। বন্যা মৌসুমে সামান্য পানি থাকলেও শুস্ক মৌসুমে নদীর বুকে ধান চাষ হচ্ছে। প্রবীনদের মতে গত ৩০ বছরে চলনবিলের গভীরতা বহুলাংশে কমে গেছে। এ কারণে বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বিস্তৃত চলনবিলের বক্ষে এখন চাষ হচ্ছে ধান, গম, ভুট্টা, সরিষাসহ নানা জাতের সবজি, মশলা, রসুন পিঁয়াজ। পানির স্তর এমনভাবে নেমে গেছে শ্যালো মেশিন বসিয়েও ঠিকমতো পানি পাওয়া হচ্ছে না।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সমন্বয়ক মিজানুর রহমান জানান, যতদিন যাচ্ছে ততই চলনবিল ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। জীব বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। চলনবিলকে রক্ষায় সরকারের কাছে ২৬ দফা দাবী দেয়া হয়েছে। সরকার শুধু আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু বাস্তবায়নে কোন ভুমিকা রাখছে না।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশালী শফিকুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জর উত্তওে কাজিপুর থেকে দক্ষিনে চৌহালী পর্যন্ত প্রায় ৮২ কি.মি দৈর্ঘ্য যমুনা নদীর। পুর্বে টাঙ্গাইল- পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত যমুনার প্রস্থ প্রায় ১৫.কিমি.। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে লক্ষ লক্ষ টন পলি পড়ে। এ জন্য স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে যমুনার বুকে অসংখ্য চর জেগে ওঠেছে। ফলে নদীটি আকা-বাকা ও বিভিন্ন চ্যানেল বিভক্তি হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বড় দুটি চ্যানেল পুর্ব-পশ্চিম তীর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীর এলাকাগুলো ভাঙ্গনের মুখে পড়ছে। সরকার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাস্তবায়ন হলে নদী পুর্বের যৌবন ফিরে পাবার পাশাপাশি তীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়াও আভ্যন্তরীন নদীগুলোও খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে করতোয়া, ফুলজোড়, হুরাসাগর ও বাঙ্গাল নদীর ১২২ কি.মি খননের জন্য চুড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি বছরে দরপত্র আহবান করা হবে।
অভিজ্ঞজনের মতে, যে নদীকে ঘিরেই মানুষের সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল। গড়ে ওঠেছিল বন্দরসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অথচ সেসব নদীই মৃত প্রায়। নদী মরে যাওয়ার কারণে মানুষ ও পরিবেশের উপর মারাত্মক ধ্বংসাত্বক প্রভাব পড়ছে। নদী রক্ষা করতে যমুনা ও পদ্মা নদীসহ বিলের প্রধান প্রধান সব নদী ও খাল ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে পানির প্রবাহ সৃষ্টি ও ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। দখল বন্ধ ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার করতে হবে। জনগনের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিলের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়-প্রতিকুল পরিবেশ, অপরিকল্পিত সড়ক-মহাসড়ক, বাঁধ, ক্রসবাঁধ কালভার্ট, সুইচগেট, উৎসমুখ ভরাট ও দখল-দুষণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের আভ্যন্তরীন নদ-নদী। তাই পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সব ব্রিজ, কালভার্ট, ক্রসবাঁধ, সুইচগেট, অপসারণ করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের নদী-উপনদীগুলো রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব থাকবে না। তাই প্রয়োজনের তাগিদেই জরুরী ভিত্তিতে কাজগুলি সমাধান করা উচিত বলে অভিজ্ঞ তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন