শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পানি-বায়ু প্রাণ-প্রকৃতি বিনষ্টের অপরিণামদর্শিতা বন্ধ হোক

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গালী কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কথা দুই বাংলার সাধারণ পাঠকরা ভুলে গেলেও তার লেখা একটি ব্যঙ্গ কবিতার কয়েকটি চরণ শত বছর ধরে বাঙ্গালীর নাগরিক জীবনের বাস্তবতার সাথে মিশে আছে। ‘রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে কলিকাতায় আছি’ গুপ্ত কবির এই লাইন এখন শুধু কলিকাতায়ই নয়, দুই বাংলার সব জনপদের মানুষ সমানভাবে এই বাস্তবতায় আক্রান্ত। তবে গত শত বছরে মশা ও মাছিদের পাশাপাশি আরো অনেক উপদ্রব আমাদের নাগরিক জীবনকে আক্রান্ত করে চলেছে। ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তির জন্য এ দেশের মানুষ স্বরাজ আন্দোলন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু নিজেদের শাসনেও শোষনমুক্তির সেই স্বপ্ন আজো পুরণ হয়নি। সেই মশা মাছিদের উৎপাতও তেমনই আছে, সেই সাথে চেনা জানা মানুষগুলোও এক সময় ক্ষমতালোভী, মুনাফাবাজ রক্তচোষা ড্রাকুলার ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিরীহ দরিদ্র মানুষের রক্ত চুষে কেমন ভয়ঙ্কর,মোটাতাজা হিংস্র হয়ে উঠেছে। এদেরকে এখন আর কেউ সামলাতে পারছে না। বৃটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে শত বছর আগে কলিকাতা শহরের ফিরিঙ্গি কর্মকর্তারা নাগরিক জীবনে স্বস্তির জন্য অনেক কিছুই করেছিলেন। ট্রেন, ট্রাম, ট্রাফিক সিস্টেম, রাস্তার বাতি, সুপেয় পানি, খেলার মাঠ, রেসকোর্স, সোশ্যাল ক্লাব ইত্যাদি সমন্বিত উদ্যোগে কলিকাতাকে ভারতের উন্নত আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে ইশ্বর গুপ্তের কবিতার সেই চরণই কলিকাতার দরিদ্র মানুষের জন্য বেশী বাস্তব হয়ে ধরা পড়েছে। শত বছরের ঐতিহাসিক বিবর্তনে বৃটিশদের বিদায়, দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। মুক্তির আকাঙ্খা থেকে আমরা বার বার রাষ্ট্রকে বিভক্ত-বিভাজিত হতে দেখেছি, তবে আকাঙ্খা পুরণ না হওয়ায় বিভাজন বিভক্তি ক্রমে বেড়েই চলেছে। ভাষায়, আঞ্চলিকতায়, ধর্মে, জাতি, বর্ণ ও রাজনৈতিক বিভাজন যতই বেড়েছে মানুষের অশান্তি, অস্বস্তি, বিড়ম্বনা ও নিরাপত্তাহীনতাও তত বেড়েছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে শাসনব্যবস্থার রাজনৈতিক দলীয়করণ, ঘুষ-দুর্নীতি, সুশাসন না থাকার অভিযোগ নিয়ে এমন হাহাকার কখনো দেখা যায়নি। একদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার দাবী, উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নেক কাছাকাছি পৌছে যাওয়ার দাবী, অন্যদিকে পবিত্র রমজান মাসেও ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষকে সুপেয় পানির দাবীতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাকা ওয়াসার মহাপরিচালক, তাকসিম এ খান ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই অংশের ৫৯টি এলাকায় ওয়াসার পানিতে দূষিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনে আওতাধীন জুড়াইনের অধিবাসিরা বছরের পর বছর ধরে ওয়াসার দূষিত পানির বিড়ম্বনা পোহাচ্ছেন। যতই দিন যাচ্ছে দূষণ ও বিড়ম্বনা ততই বাড়ছে। বার বার অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পায়নি তারা। রমজান মাসে পানির সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করার পর এলাকাবাসি খরতাপ উপেক্ষা করেই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলেও ওয়াসার মহাপরিচালক দাবী করেছিলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়।
শহরের মানুষকে সুপেয় নিরাপদ পানি সরবরাহ করা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব। পানির নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং শহরের সুয়্যারেজ লাইন বা পয়োঃব্যবস্থাকে নির্ঝঞ্জাট রাখাও ঢাকা ওয়াসার অন্যতম দায়িত্ব। এ জন্য নগরবাসি নিয়মিত পানির বিল ও পয়োঃবিল হিসেবে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা পরিশেঅধ করে থাকে। সুপেয় পানির নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো জনপদের জীবনযাত্রা সচল রাখা অসম্ভব। অপরিকল্পিতভাবে, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, পরিষেবাব্যবস্থা ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাস্তবতায় ঢাকা ওয়াসা, ডেসা, তিতাস গ্যাস সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে নিরাপদ নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বাস্তবতা অস্বীকার করে অবস্থার কাঙ্খিত পরিবর্তন অসম্ভব। জুরাইনের সচেতন বাসিন্দারা প্রতিবাদ হিসেবে তাদের এলাকায় প্রাপ্ত ওয়াসার লাইনের পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে ওয়াসার ডিজিকে পান করাতে গিয়েছিলেন। তিনি তা পান করতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে পানির দূষণ স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে আদালতের নির্দেশে শহরের ৫৯টি এলাকায় ওয়াসার পানি দূষণের শিকার হওয়ার কথা স্বীকার করলেও এ সংখ্যা আরো অনেক বেশী। সিটি কর্পোরেশনের দুই অংশের বেশীরভাগ এলাকায় ওয়াসার পানিতে দূষণ। শহরের অনেক এলাকায় দূষিত পানিরও প্রয়োজনীয় সরবরাহ নেই। মূলত: ঢাকা শহরে এমন একটি স্থানও নেই যেখানে মানুষ সরাসরি ওয়াসার লাইন থেকে পানি নিয়ে পান করতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে জানা যায়, ঢাকা শহরে ৯০ শতাংশের বেশী মানুষ ওয়াসার পানি চুলায় ফুটিয়ে পান করছে। শুধু পানি ফোটাতে বছরে শত শত(৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হচ্ছে বলে গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে। ওয়াসা নগরবাসির জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলেও পানির বিল, পানির লাইনের বৈধ-অবৈধ সংযোগ, অবকাঠামো নির্মান ও রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে বহুমাত্রিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা চলছে বছরের পর বছর ধরে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)র সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানা যায়, ওয়াসার ৬২ ভাগ গ্রাহককে নানা রকম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হতে হয়। ওয়াসার দুর্নীতি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন গত বছর একটি গণশুনানীর আয়োজন করেছিল। অংশগ্রহণকারী নাগরিকদের উপস্থাপনায় ট্যাপে পানি না আসলেও ওয়াসার অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, ঘুষ-দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠে আসে। রান্না, খাওয়া, বাথরুম, ধোয়া-মোছা, অজু- গোসলের জন্য পানি যেখানে সার্বক্ষনিক প্রয়োজনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে শহরের অনেক এলাকায় দিনে দু’তিন ঘন্টার বেশী পানি পাওয়া যায় না। যতক্ষণ যেটুকু পাওয়া যায় তাও দূষিত, দুর্গন্ধযুক্ত, সরাসরি ব্যবহারের অযোগ্য। জুরাইন এলাকার মানুষ পানির দাবীতে নানাবিধ অভিনব প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি পানি সরবরাহে ওয়াসার ব্যর্থতা এবং দূষিত পানির কারণে যে সব বিড়ম্বনা ও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে তার ক্ষতিপুরণেরও দাবী তুলেছে। তাদের এই দাবী যুক্তিসঙ্গত এবং ন্যায্য। সাম্প্রতিক সময় জনগুরুত্বপূর্ণ নানা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রনালয়ের প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছেন। ওয়াসার দূষিত পানি, ভেজাল খাদ্য, দুধ ও দুগ্ধপণ্যের দূষণ, মশা-বায়ূদূষণ ও পানিবদ্ধতার মত ইস্যুতে আদালতের অবজারভেশন এবং নির্দেশনা মানুষকে আশ্বস্ত ও আশাবাদী করে তুলেছে। ওয়াসা, ডেসা, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীর মত প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় জনগনের সম্পদে গড়ে উঠেছে এবং পরিষেবার বিনিময়ে নাগরিকরা প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করলেও প্রয়োজনীয় পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষত: ওয়াসার দূষিত পানির কারণে নানা রোগব্যধি ও জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাবের কথা উঠে আসে। এ সব ক্ষেত্রে নাগরিকদের বিল রেয়াত, জবাবদিহিতা এবং ক্ষতিপুরণের আইনগত নিশ্চয়তা থাকলে ওয়াসা, ডেসার মত সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-স্বেচ্ছাচার ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রবণতা অনেকটা কমে আসতে পারে।
স্বাধীন বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো দশকের পর দশক ধরে উপেক্ষিত হয়ে আসছে। জনগনের সম্পদের উপর জনগনের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা যেন নাগরিকদের উপর তাদের স্বেচ্ছাচারিতার হুকুমদারি চালাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া ও ভাগবাটোয়ারার যোগসাজশে তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় ইতিমধ্যে প্রকৃতি ও মানুৃষের টাইমলেস সম্পদগুলো ধ্বংস হতে শুরু করেছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর উপর দখলবাজি, দূষণ, ঢাকার অভ্যন্তরের খালগুলো ভরাট ও দখল, সরকারী খাস জমি, বনভূমি, উদ্যান, খেলার মাঠ, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থানগুলোর বেশীরভাগ এখন অপদখলের শিকার। এভাবেই এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত, চারটি নদীর দ্বারা বেষ্টিত ও সুরক্ষিত নান্দনিক নগরী ঢাকা মাত্র চার দশকের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম দূষিত, অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নাগরিকরা অসচেতন নয়। পরিবেশবাদিরাও সোচ্চার ভ’মিকা পালন করছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো এবং স্থানীয় নির্বাচনের আগে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা শহরকে তিলোত্তমা, গ্রীনসিটি, ক্লিনসিটি নাগরিক বান্ধব, পরিবেশবান্ধব করে তোলার উপচে পড়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। এসব প্রতিশ্রুতি শহরকে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ার বাস্তবতা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার কমিশন-লুটপাট, ভাগবাটোয়ারার সুযোগ না থাকলে মসনদে বসার পর জনস্বার্থে জনগনের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তাগিদ কেউ অনুভব করেনা। সাময়িক স্বার্থ ও লোভের পরিনতি হিসেবে আমাদের পুরো জনপদ এখন বেদখল, দূষণ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, খাদ্যদূষণ, ভেজালের দৌরাত্ম্য, যানজট, পানিবদ্ধতা, সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ, গণপরিবহণে মানুষের জিম্মিদশা, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, গুম-খুন, ধর্ষণ, ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক- প্রাতিষ্ঠানিক স্বেচ্ছাচারিতার যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট মানুষ এখন নিজেদের নাগরিক অধিকারের দাবী তোলতেও যেন ভয় পায়। মানুষের মৌলিক অধিকারের ন্যায্য দাবী রাজনীতি ও কালনিরপেক্ষ। পানিদূষণ, গ্যাস- বিদ্যুত- পানির সংকট, বায়ূদূষণ, যানজট, রাস্তায় পানিবদ্ধতা, খাদ্যের ভেজাল, বেকারত্ব, সামাজিক বিশৃঙ্খলা- অবক্ষয়, খুন-ধর্ষণ ও মাদকাসক্তির মত বিষয়গুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিটি মানুষ আক্রান্ত। সরকারের অসহিষ্ণু অগণতান্ত্রিক আচরণ, জনস্বার্থের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটমেন্টের অভাব এবং বিভেদ-বিশৃঙ্খলার কারণে বৃহত্তর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কণ্ঠ এখন অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষীণ। তবে জনগণের অধিকারের দাবী দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ের কোটা বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন এবং জুরাইন এলাকার বাসিন্দাদের ওয়াসার পানির আন্দোলন তারই বাস্তব প্রমান। জনস্বার্থের প্রশ্নে অকার্যকর রাজনীতির বন্ধাত্ব্যের সময় দেশের উচ্চ আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত প্রায় ইস্যুতে আমাদের উচ্চ আদালত বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। ঢাকা শহরের বায়ূদূষণ, পানিদূষণ, পানিবদ্ধতা ও মশা নিধনে ব্যর্থতার জন্য সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যর্থতাকেই দায়ী করেছে আদালত।এসব সমস্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে সমন্বয়হীনতা দূর করতে সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তবে সোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেয়া রায়ের পর গণতান্ত্রিক রাজনীতির বন্ধ্যাত্ব এবং রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে আদালতের নিরবতা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে জনমনে সংশয় দেখা দিলে তা হবে বিচার বিভাগের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।
নিবন্ধের শুরুতে ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গালী কবি ইশ্বর গুপ্তের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কবি ইশ্বর গুপ্ত কলকাতার নাগরিক বিড়ম্বনা নিয়ে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন। এটি একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতারই অংশ। ইশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর অর্ধ শতাব্দী পর রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটলেও বিংশ শতাব্দীতে পর্দাপণের আগে এবং রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে বাংলা বা ভারতে ইউরোপ-আমেরিকার মত এমন নগরায়ণ বা শিল্পায়ণ ঘটেনি যে তিনি বলতে বাধ্য হন,
“দাও ফিরে সে অরণ্য,লও এ নগর,
লও যত লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তুর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সে তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,” (সভ্যতার প্রতি)
রবীন্দ্রনাথ যখন নগরসভ্যতাকে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী বলছেন, তখনো গঙ্গার উপর কোনো বাঁধ নির্মিত হয়নি। পদ্মা-যমুনা- তিস্তা- ভগিরথী, সুরমা-কুশিয়ারা রাজনৈতিক দখলবাজি ও ভয়ানক রাসায়নিক দূষণের শিকার হয়নি। আজ আমরা যখন সর্বগ্রাসী দূষণ, লুণ্ঠন, দখলবাজি ও সীমাহীন অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছি তখন আমাদের কবিরা কলাকৈবল্যবাদী হয়ে উঠেছেন। আমাদের রাজনীতিবিদরা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ণের আনন্দে আত্মহারা। রাজনীতির বিরোধীপক্ষ শুধু ক্ষমতা হারানোর বেদনা আর যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার কসরতে ব্যস্ত। তারা লাভক্ষতির হিসাব করছেন জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর আর্থিক অপচয়-দুর্নীতির মানদন্ডে। রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠুর,সর্বগ্রাসী নবসভ্যতার অতি ঔৎকর্ষ দেখে যেতে পারেননি। তিনি হারানো তপোবন, পুণ্যচ্ছায়ারাশির জন্য আক্ষেপ করেছেন। যে গড়াই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে যাতায়াত করতেন, যেখানে বজরায় বসে মাঝিদের ভাটিয়ালির সুর শুনতে শুনতে কবিতা ও সঙ্গিত রচনা করতেন, উজানে ভারতের বাঁধ নির্মানের কারণে সেই নদী এখন মরুভ’মিতে পরিনত হয়েছে। নবসভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় দেশের প্রায় সবগুলো নদী রাসায়নিক শিল্প দূষণ ও দখলবাজির শিকার হয়ে একেকটি দুর্গন্ধ নহরে পরিনত হয়েছে। শহরের কাছাকাছি সবুজ গ্রামগুলো হাউজিং কোম্পানীর দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া, নদীর ধারগুলো, খাল-বিল জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে কনক্রীটের আস্তরণ ও বহুতল অট্টালিকায় পরিণত হওয়াকে আমরা এখন উন্নয়ন বলে দাবী করছি। লোভী অপরিনামদর্শি রাজনীতি-অর্থনীতি ও অনৈতিক ভোগবাদী সংস্কৃতির কারণে মাত্র এক শতাব্দীর ব্যবধানে রবীন্দ্রনাথের ‘নবসভ্যতা’ পুরনো, জীর্ণ ও পরিত্যক্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। যে সভ্যতাকে রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠুর-সর্বগ্রাসী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন সেই নিষ্ঠুর-সর্বগ্রাসী চরিত্রের চুড়ান্ত প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে। এখনকার নাগরিক কবি ও প্রকৃতিপ্রেমিরা তপোবন-ছায়াবিথির স্বপ্ন দেখার সাহস পাননা, তারা এখন একগ্লাস বিশুদ্ধ পানির স্বপ্ন দেখেন, এই দাবীতে তারা এখন বুকে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামেন। প্রাণবন্ত সুনীল স্বচ্ছতোয়া নদীতে নৌকা ভাসিয়ে ভাটিয়ালি সুর তুলে আজলা ভরে জলপানের সেই দিনগুলো ফিরে পাওয়ার আকুতিকে কী বলা যায়? প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে, পানি, মাটি বায়ূকে বিষাক্ত করে আমরা কিসের উন্নয়ন করছি? এটিই এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতির বাসযোগ্যতা বিনষ্টের অপরিনামদর্শি নিষ্ঠুর ধ্বংসাত্মক খেলা বন্ধ হোক।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন