৫/৬শ’ টাকার মজুরি দিয়েও যখন বোরো চাষীরা ক্ষেতের ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছে না, আবার ধান কেটে হাটে বাজোরে তুলেও উপযুক্ত দামে তা বাজারে বিক্রি করতে পারছে না তখন উত্তরাঞ্চলের চালের বাজার চলে গেছে ভারতীয় চালের দখলে। শুধু বড় বড় পাইকারি আড়তেই নয় বরং পাড়া মহল্লার মুদি দোকানগুলোতেও শোভা পাচ্ছে ভারতীয় চালের বস্তা!
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি সুদৃঢ় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশে চালের বাজারের ওপরে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে। এক্ষেত্রে কম পরিশ্রমে লাভের আশায় এক শ্রেণীর চালকল মালিক শিখ-ি হিসেবে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। গত কদিনে দেশি/বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যবেক্ষণ এবং উত্তরাঞ্চলের হাটে-বাজারের চিত্র অবলোকনে স্পষ্ট মনে হয়েছে দেশ থেকে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আখের আবাদ যেভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তেমনিভাবেই ধানের আবাদও বন্ধের ষড়যন্ত্র চলছে। দীর্ঘদিন ধরে চিনি, চাল ও কৃষিপণ্য আমদানীর সাথে জড়িত কয়েকজন আমদানিকারক ইনকিলাবকে জানিয়েছেন, ’৮০’র দশকে এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই উত্তরাঞ্চলভিত্তিক কয়েকটি মাড়োয়ারী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ব্যাপকভাবে ভারতীয় চিনি চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসতে থাকে।
ওই সরকারের প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে সেসময় ভারতীয় চিনি চোরাকারবারী চক্রের বিরুদ্ধে কোন অ্যাকশানে যায়নি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে সেসময় সস্তা ভারতীয় চিনিতে বাজার সয়লাব হয়ে গেলে দেশের চিনি কলগুলোতে উৎপাদিত উন্নত মানের চিনি অবিক্রিত থাকে। একই সাথে সরকারি চিনি কলগুলিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে। ফলে আখ উৎপাদনকারী চাষীরা দিনের পর দিন তাদের উৎপাদিত আখের মুল্য না পেয়ে হতাশা ও ক্ষোভে আখ চাষই ছেড়ে দেয়।
’৯০ দশকে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে আবাধ আমদানী নীতির কারণে ভারতীয় চিনির চোরাচালান বন্ধ হলেও চাল, চিনি, ডালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের অবাধ আমদানীর কারণে কৃষি সেক্টরে দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। বর্তমানে ডাল জাতীয় শস্যদানা, ভোজ্য তেল, রসুন ও আদাসহ গরম মশলার বাজার পুরোপুরি আমদানী নির্ভর হয়ে পড়েছে।
তবে দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি টন হওয়ায় এবং ভাত দেশের মানুষের প্রধাণ খাদ্য হওয়ায় সারাদেশে ধানের আবাদে কৃষকের মনোযোগ এখনও কমেনি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গত ৫ বছর ধরে দেশে আমন, আউশ ও বোরো মওশুমে উৎপাদিত ধান চালের গড় উৎপাদন কখনো কিছু কম, কিছু বেশি হয়েছে। উদ্বৃত্তের কারণে সীমিত পরিমাণে চাল রফতানীও হয়েছে।
সরকারের রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের উদাসীনতার কারণে ২০১৬ সালে সিলেটের হাওরাঞ্চলে বাঁধভাঙা পানিতে আনুমানিক ১০ লাখ মে. টন ধানের ক্ষতি হলে সেটিকে পুঁজি করে চালকল মালিক ও চালের মজুদদার সিন্ডিকেট চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে দেশে হৈচৈ ফেলে দেয়। প্রবল জনমত তৈরী করে মিল মালিক ও আমদানীকারক সিন্ডিকেটের চাপে প্রায় শূন্য এলসি মার্জিনে চাল আমদানীর সুযোগ দেয়। আর তারপর থেকেই বাজার চলে যায় ভারতীয় চালের দখলে।
কয়েকজন ভারতীয় রফতানীকারকের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার চালের বাজারে সম্প্রতি ভারতের জন্য প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। এছাড়া মিসর, সউদী আরব ও তুরষ্কের বাজারে উন্নত ও সুগন্ধী জাতের বাসমতি চালের বাজার ভারতের হাতছাড়া হয়ে পুরোপুরি চলে গেছে পাকিস্তানের কব্জায়। ফলে প্রতিবেশি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বাজারের দিকেই মনোযোগী হয়েছে ভারতের চাল রফতানীকারকরা। তারা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে দেশকে পুরোপুরি ভারতীয় চালের ওপর নির্ভরশীল করতে। কমিশন ও নগদ লাভের আশায় দেশের প্রভাবশালী মহল এক্ষেত্রে সহযোগিতাও করছে।
কয়েকজন ধানচাল ব্যবসায়ী পরিষ্কার করেই জানালেন, দেশকে ভারতীয় চালের ওপর নির্ভরশীল করতেই পরিকল্পিতভাবে ধানের বাজারের দরপতন করা হয়েছে যাতে আগামীতে হতাশ, ক্ষুব্ধ, দিশেহারা চাষীরা ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অপরদিকে চাল আমদানীর নামে ভুয়া এলসি বা এলসিতে আন্ডার ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থপাচারের রাস্তা পরিষ্কার হয়।
বগুড়ার নারুলী মহল্লার একটি মুদি দোকানে ভারতীয় চালের বস্তা -ইনকিলাব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন