বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বাজারে ভারতীয় চাল কৃৃষকের সর্বনাশ

| প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

চালের মূল্য ঠিক রাখতে এবং ধানচাষিদের লোকসান, হতাশা ও বিক্ষোভ প্রশমনে চালের আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ভারত থেকে চাল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গত বুধবার এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫৫ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে কি কৃষকের ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে? ধানের বর্তমান মূল্যে কৃষকের খরচ না উঠার পেছনে নানাবিধ কারণ থাকলেও বোরোর ভরা মওসুমে ভারত থেকে অবাধে চাল আমদানির সুযোগ এ সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। নিম্নমানের ভারতীয় চালে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ার কারণে মিল মালিকরা সরকার নির্ধারিত বা কাছাকাছি দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। ধানের ভরা মওসুমে ভারত থেকে চাল আমদানী এবং কৃষকের লোকসান দেয়ার চিত্র এ খাতে কোনো নতুন উপসর্গ নয়। গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি আলোচনা-সমালোচনা সত্তে¡ও বছরের পর বছর ধরে এ ঘটনা অব্যাহত আছে। বেশ কিছুদিন ধরে ধানের বাজার নিয়ে কৃষকের হতাশা, বিক্ষোভ-মানববন্ধন, রাজপথে ধান ছিটিয়ে, ধানক্ষেতে আগুন দিয়ে কৃষকদের প্রতিবাদের ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে আছে। কৃষিমন্ত্রী ধানে কৃষকের ক্ষতি মেনে নিলেও ভারত থেকে চাল আমদানির বিষয়ে তেমন কোনো বাক্যব্যয় করেন নি। এ সপ্তাহে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চলতি মাসে শুধুমাত্র হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি করা হয়েছে ৬ হাজার মেট্টিক টনের বেশি। ভারত থেকে অবাধে চাল আমদানিকেই ধানের দর পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন কৃষক ও মিলাররা। এহেন বাস্তবতায় চালের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। কৃষক পর্যায়ে এ উদ্যোগের সুফল নিশ্চিত করতে হবে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সুপরিকল্পিতভাবে দেশের ধানচাষিদের লোকসানের মুখে ফেলে তাদেরকে ধানচাষে নিরুৎসাহিত করে দেশের ধান-চালের বাজারের উপর ভারতীয় আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে এক সময় দেশের কৃষকরা ধানচাষ বাদ দিয়ে তামাক অথবা ভিন্ন কোনো লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকলে দেশে বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে, সে সুযোগে চালের বাজারে সিন্ডিকেটেড মনোপলি প্রতিষ্ঠিত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের দরিদ্র মানুষ। বাম্পার ফলনের পর দেশের উত্তরাঞ্চলে ধানের মোকামগুলোতে এখনো বোরো ধান কেটে ঘরে তোলা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে সব স্থানীয় বাজারের দোকানগুলোতে ভারতীয় চালের রমরমা বাণিজ্যের খবর দিয়েছেন ইনকিলাবের প্রতিনিধিরা। বগুড়ার একটি বাজারের মুদি দোকানের চিত্র তুলে ধরে ইনকিলাব প্রতিনিধি তাঁর মূল্যায়ণে বলেছেন, একটি সুদৃঢ় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশের চালের বাজারের উপর ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত চলছে। মধ্যস্বত্বভোগী মুনাফাবাজ সিন্ডিকেটের সাথে একশ্রেনীর চালকল মালিকও শিখন্ডি হিসেবে এই তৎপরতার সাথে যুক্ত আছে বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু চালই নয়, চিনিসহ বেশকিছু কৃষিপণ্যের উপর এই সিন্ডিকেটের তৎপরতা দেশের কৃষক ও স্থানীয় শিল্পের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করছে।
ধান-চালের বাজার ও কৃষকের স্বার্থের প্রশ্নের সাথে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। কয়েক বছর আগে অকাল বন্যা ও ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে ব্যাপক ফসলহানি ঘটেছিল। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে সে ক্ষতির পরিমান ছিল কমবেশি ১০ লাখ টন। দেশের কৃষকরা যেখানে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন ধান উৎপাদন করে দেশের ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদা পুরণ করছে এবং স্বল্প পরিমানে হলেও উদ্বৃত্ত চাল বিদেশে রফতানিও করছে, সেখানে হাওরে ১০ লাখ মেট্টিকটন ফসলহানিতে তেমন কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। হাওরের ফসলহানির ঘটনাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কার কথা বলে চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার করিয়ে ভারতীয় চাল আমদানির মাধ্যমে চালের বাজারে ধস নামিয়ে কৃষকের বারোটা বাজিয়ে দেয়। অনেক দেরিতে হলেও চাল আমদানির শুল্ক দ্বিগুণ করার মধ্য দিয়ে কৃষকের স্বার্থ রক্ষার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা খুবই ইতিবাচক। চাল, চিনি, ডালসহ কৃষিপণ্যের সিন্ডিকেটেড বাণিজ্য একদিকে দেশের কৃষি, কৃষক এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে এই সিন্ডিকেট আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এহেন বহুবিধ সমস্যার পেছনে কাজ করছে দেশবিরোধী সুগভীর চক্রান্ত। যে কোনো মূল্যে এ চক্রকে রুখে দিতে হবে। ভরা মওসুমে চাল আমদানীসহ কৃষিপণ্যে সিন্ডিকেটেড বাণিজ্য বন্ধ করতে কৃষিবান্ধব বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশবিরোধী এই শক্তির তৎপরতা সম্পর্কে উপযুক্ত তদন্ত হওয়া আবশ্যক। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়ের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর সাথে সাথে রাইস মিল মালিকদেরকেও ধানের ন্যূনতম মূল্য মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন