শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আমরা ফল খাচ্ছি না বিষ খাচ্ছি

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

আমের মৌসুম পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীসহ সারাদেশের বাজারে উঠতে শুরু করে বিভিন্ন জাতের আম। আমগুলো দেখতেও বেশ ঝকঝকে এবং সুন্দর। এখন ইফতারেও এ আম যুক্ত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আম কি সত্যিকার অর্থেই পাকা? এগুলো কি খাওয়ার উপযোগী? কারণ এসব আম কিনে বাড়িতে নিয়ে কেটে দেখা যায় ভেতরের আঁটিই শক্ত হয়নি, আঙ্গুলে চাপ দিলেই ভেঙ্গে যায়। আম কেটে কিছু সময় রাখার পর আপনা আপনি কালো হয়ে যায়। খেতেও আমের মতো লাগে না, মিষ্টি লাগা দূরের কথা বিশ্রী স্বাদে মুখ বিস্বাদ হয়ে যায়। এ আম খাওয়ার পর অনেকের পেটেও সমস্যা দেখা দেয়। গত কয়েক দিনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এই ঝকঝকে পাকা আমের আসল রহস্য। পরিপক্ব হওয়ার আগেই আমগুলো পেড়ে আনা হয়েছে বাগান থেকে। তারপর বিষাক্ত ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়েছে রোজার মধ্যে অতিলাভে বিক্রির উদ্দেশ্যে। সেই আমেই রাজধানীসহ সারাদেশের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। বিষয়টি নজরে আসার পর র‌্যাব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালযুক্ত আম জব্দ করে ধ্বংস করেছেন। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে কেমিক্যাল মেশানোর অভিযোগে ২৫ মণ খিরসাপাত আম ধ্বংস করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী রওশন ইসলাম পরিচালিত আদালত একই সঙ্গে আমের মালিক ও শ্রমিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করে। একই দিন সাভারের আশুলিয়ায় ফলের আড়তে অভিযান চালিয়ে অপরিপক্ব ও সময়ের আগেই বাজারজাত করা ১৫ মণ আম ধ্বংস করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। র‌্যাবের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত মিরপুর শাহ আলী ফলের বাজারে অভিযান চালিয়ে রাসায়নিক দিয়ে পাকানো দুই হাজার কেজি আম ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাওরান বাজারে অভিযান চালিয়ে ১২শ’ কেজি অপরিপক্ব আম ধ্বংস করেছে। র‌্যাবের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত যাত্রাবাড়ীর ফলের আড়তগুলোতে অভিযান চালিয়ে কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ১৬ হাজার কেজি আম ধ্বংস করার পাশাপাশি ২৪ লাখ টাকা জরিমানাও আদায় করেছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। এত কিছুর পরও থামছে না একশ্রেণির অসাধু ফল ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য।

রাসায়নিক দিয়ে পাকানো এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আম বিক্রি প্রতিরোধ করতে না পারায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ট এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালত। কারণ, এর আগে গত ৯ এপ্রিল আদালত এক নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, বাগান থেকে অপরিপক্ব আম পেড়ে রাসায়নিক দিয়ে যাতে পাকানো না হয় এবং তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে যেন আম বাগানগুলোতে পুলিশ নিয়োগ করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের সেই আদেশ বাস্তবায়নের কোনো আলামত ফলের বাজারে দেখা যাচ্ছে না, বরং রাজধানীসহ সারাদেশের ফলের বাজার ছেয়ে গেছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত আমে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএসটিআই-এর একজন অতিরিক্ত পরিচালক ১৫টি পাইকারী ফলের বাজার পরিদর্শন করে কোথাও ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানো হয়েছে মর্মে কোনো প্রমাণ পাননি। কিন্তু ফলের স্বাদ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা হয়েছে ফরমালিনের জন্য। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর বিষয়টি অস্বীকার করে বলা হয়েছে, আমাদের ফল শিল্পের ক্ষতি করার জন্যই কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো এবং ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণের বিষয়টি প্রচার করা হচ্ছে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, যেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও বিশেষজ্ঞরা বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো আম জব্দ করে ধ্বংস করছে, সেখানে বিএসটিআই ও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর একে ষড়যন্ত্র বলছে। তারা কি জানে না, আমের মৌসুম এখনো শুরু হয়নি? তার আগে এসব আম এলো কোথা থেকে? কেমিক্যালযুক্ত বিষাক্ত আমের পক্ষে তাদের এই সাফাই গাওয়া কি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি নয়? অথচ, ২০১৮ সালের বুয়েটের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিক্রেতারা কৃত্রিমভাবে ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথোফেন, কেরোসিন, ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করে থাকেন। আর এসব কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল খেলে বদহজম, স্থায়ী চর্মরোগ, ডায়রিয়া, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এমনকি ফুসফুস অকার্যকর হওয়ার মতো ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। শুধু বুয়েটের গবেষণাই নয়, বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে ফল ব্যবসায়ীরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, তারা অপরিপক্ব আম পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে থাকেন। এ অবস্থায় ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানোর ব্যাপারে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি- দাবি করা বিএসটিআই-এর ওই অতিরিক্ত পরিচালক এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নিশ্চিতভাবেই জনস্বার্থবিরোধী। তাদের বক্তব্য যদি সঠিকই হবে, তাহলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ পরিচালিত একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাওরান বাজারে অভিযান চালিয়ে ১২শ’ কেজি অপরিপক্ব আম কোন যুক্তিতে ধ্বংস করেছে? বুয়েটের গবেষণায় ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানোর বিষয়টি প্রমাণিত হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন সেটা প্রমাণ করতে পারছে না তা এক রহস্যই বটে।

অতিলোভ এবং বিবেকহীনতা আমাদের নীতি-নৈতিকতাসহ মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সামান্য ক’টা টাকা বেশি লাভের জন্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক-বিষতুল্য কেমিক্যাল মেশাতে একটুও দ্বিধাবোধ করছেন না। এমনকি আম চাষি বা বাগানমালিকরাও পা দিয়েছেন এই ধ্বংসাত্মক পথে। গাছে ফুল আসার আগেই শুরু হয় হরমোন ছিটানো। ফুল আসার পর কয়েক দফায় অতিমাত্রায় ছিটানো হয় কীটনাশক। ফলে আম বিষাক্ত হতে শুরু করে গাছে থাকতেই। তারপর দেখতে একটু বড় হলেই গাছের সব আম এক সঙ্গে পেড়ে বিক্রি করা হয় ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীরা ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে একরাতেই পাকিয়ে ফেলেন সেই অপরিপক্ব আম। ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকিয়েই তারা ক্ষ্যান্ত থাকেন না, বরং তাতে ফরমালিন মেশান যাতে আমগুলো অনেকদিন সংরক্ষণ করে বিক্রি করা যায়। এই অবস্থায় বিষমুক্ত গাছপাকা আম বা অন্যান্য ফল দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। বিষমুক্ত ফল পেতে হলে শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু আম ধ্বংস বা কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা এবং দন্ড দিলেই হবে না, বরং চাষি থেকে শুরু ব্যবসায়ী এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে সমন্বিত করে সচেতনতামূলক উদ্যোগ নিতে হবে। মাঠপর্যায়ে চাষিদেরকে প্রয়োজনী প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দিয়ে বিষমুক্ত আম, লিচু, আনারস বা অন্যান্য ফল উৎপাদনের ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। দ্রুত ফল পচে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে ব্যবসায়ীদের লোকসানের হাত থেকে রক্ষার জন্য উন্নত মানের প্যাকেজিং এবং প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সকল স্তরে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য আইনকে আরো কঠোর করতে হবে। যাতে কেউ আইন লঙ্ঘন করে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান আম বা অন্য কোনো ফলে মেশানোর সাহস না করে। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ পকেটের টাকা খরচ করে আমরা জেনেশুনে বিষ কিনে খেতে পারি না।

বিভিন্ন জাতের আম কেনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের সময়সীমা বেঁধে দেয়া আছে। যেমন গত ১২ মে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাত ভেদে আম বাজারজাত করার তারিখ ঠিক করে দেওয়া হয়। প্রথম দফায় ১৫ মে থেকে গুটি আম নামানোর সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। এর পর পর্যায়ক্রমে ২০ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে রানিপাসান্দ ও লণভোগ, ক্ষীরশাপাত বা হিমসাগর ২৮ মে থেকে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি, ফজলি ও সুরমা ফজলি ১৬ জুন থেকে ও আশ্বিনা আম ১ জুলাই থেকে বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কোনো জাতের আম কেনা থেকে যেকোনো ভোক্তাকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেও আম কেনার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। কেননা, তখনও বাজারে ক্যালসিয়াম কার্বাইডযুক্ত, এমনকি ফরমালিন মেশানো আম থাকতে পারে। এসব কেমিক্যাল মিশ্রিত ফল খেলে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি নানা রকম জটিল রোগ যেমন- বদহজম, পেটেরপীড়া, পাতলা পায়খানা, জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, শ্বাসকষ্ট, অ্যাঁজমা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়াসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া মহিলারা এর বিষক্রিয়ায় বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিতে পারে। তাই কেমিক্যালযুক্ত আম বা ফল কেনা থেকে আমাদের সাবধান হতে হবে। আম বা অন্যান্য মোসুমী ফল কেনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও মেনে চলতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, গাছপাকা আমের ত্বকের রঙে ভিন্নতা থাকবে। গোঁড়ার দিকে গাঢ় রঙ হবে। নাকের কাছে ধরলে মিষ্টি-মধুর একটি ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। দেখতে ততটা সুন্দর নাও হতে পারে। কিন্তু কার্বাইড দেওয়া আমের আগাগোঁড়া সবটাই হলদেটে হয়ে যায়। ফরমালিন বা অন্য রাসায়নিকে চুবানোর কারণে আমগুলো হয় ঝকঝকে সুন্দর। কেমিক্যালযুক্ত আমের মিষ্টি ঘ্রাণ বোঝা যায় না। তাছাড়া রাসায়নিকযুক্ত আমের আশেপাশে কোনো মাছিও থাকে না। কেটে খেতে গেলে আমের সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, বাজার থেকে যেকোনো ফল কিনে এনে সরাসরি খাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ পানিতে ডুবিয়ে রেখে, তারপর ভালো করে ধুয়ে খেতে হবে।

আমাদের শরীরের সুষম পুষ্টির যোগানের জন্য আমসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফল খাওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু কতিপয় মানুষের লোভের কারণেই সেই ফল বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। একেকটি আম বিষের গোল্লায় পরিণত হচ্ছে। তাছাড়া মাঠপর্যায়ে চাষি বা কৃষকদের অসচেতনতার কারণেও ফলে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত বিষ। এই বিষযুক্ত ফল খেয়ে একদিকে আমরা নিজেরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, অন্যদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অসুস্থতা চলতেই থাকবে। বলা বাহুল্য, অসুস্থ প্রজন্ম নিয়ে দেশ ও জাতি কখনো এগুতে পারে না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ট এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। জনগণকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন