শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী বিশ্ব

বিদেশি আইএস বন্দিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড

ইরাকি আদালতের বিচারে একটিই শাস্তি

নিউ ইয়র্ক টাইমস | প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

এ সপ্তাহের কথা। স্যান্ডেল ও হলুদ জাম্পস্যুট পরিহিত ৭ জন বন্দি ফরাসি নাগরিককে হাজির করা হয়েছিল বাগদাদের একটি আদালতে এক ইরাকি বিচারকের সামনে। তাদেরকে নিজ নিজ অপরাধের জবাবদিহি করতে হয়েছে- কেন তারা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সাথে যোগ দিয়েছিলেন। প্রত্যেকেই জঙ্গিদের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। কেউ ছিলেন কর আদায়কারী, কেউ আরবি শিক্ষক, কেউ সামরিক প্রশিক্ষক, কেউ মুরগি বিক্রেতা, কেউ চিকিৎসা কর্মী ও কেউবা যোদ্ধা।

যদি প্রমাণ থাকেও যে তাদের কেউ সহিংস অপরাধ করেছেন, তা কখনোই হাজির করা হয় না। অধিকাংশেরই রক্ষীদের পাহারায় আদালতে হাজির করার আগে কোনো আইনজীবীর সাথে দেখা করতে দেয়া হয় না। ৪ দিনে ৭ জনের বিচারই শেষ হয়েছে। বিচারক আহমেদ মোহাম্মদ আলি ৭ জনকেই একই শাস্তি দিয়েছেন-০ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু।

ইসলামিক স্টেটের বিলুপ্তির পর সিরিয়া ও ইরাকে যে ৪ হাজার বিদেশী যোদ্ধা আটক হয়েছেন, এই ৭ জন ফরাসি নাগরিক তাদের কয়েকজন। তারা এক আন্তর্জাতিক উভয় সঙ্কটের শিকার। অধিকাংশ বিদেশী যোদ্ধার নিজের দেশ তাদের ফেরত নিতে রাজি নয়। তাদের বিচার বিশে^র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইরাকি আদালতগুলো সুষ্ঠু সবিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিচার মান রক্ষা করতে পারছে কিনা। ইরাকি আদালতের বিচার কাজকে তার পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রথম সপ্তাহের বিচার যদি কোনো ইঙ্গিত বহন করে থাকে তাহলে পরিষ্কার যে এসব বিচার দ্রæত সম্পন্ন হবে এবং রায় হবে অভিন্ন। গত সোমবার আদালত মুলতবি হওয়ার পর বিচারক মোহাম্মদ আলি এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারে বলেন, তারা যুদ্ধ করুক আর না করুক, তাদের শাস্তি মৃত্যুদÐ। তিনি এদিন অষ্টম আসামী ফ্রান্সের নাগরিক এক তিউনিসিয়ানকেও মৃত্যুদÐ দেন।

গত রোববার প্রথম দফায় ১২টি মামলার শুনানি হয়। মানবাধিকারের জন্য নিজে গর্ব প্রকাশকারী ও মৃত্যুদÐ প্রদানের বিরোধী দেশ ফ্রান্স ইরাকের বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে না। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাঁ ইভস লা ড্রিয়ান গত বুধবার বলেন যে ইসলামিক স্টেটের সাথে যুক্ত ৪৫০ জন ফরাসি নাগরিক উত্তরপূর্ব সিরিয়ায় ক্যাম্পগুলোতে আটক রয়েছে। কিন্তু ২০১৫ সালে প্যারিস, ২০১৬ সালে নিস ও ২০১৮ সালে ট্রেবেস-এ সন্ত্রাসী হামলার স্মৃতি এখনো তাজা থাকার প্রেক্ষিতে ফরাসি জনগণের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই এ সব নাগরিকের দেশে ফেরত নেয়ার ঘোর বিরোধী। যদি তাদের আটক ও বিচার করা হয় তবুও। তারা চায়, ইরাকেই তাদের বিচার হোক।

প্যারিসে সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষণ কেন্দ্রের প্রধান জাঁ-চার্লস ব্রিসার্ড বলেন, একটা বিষয় হল কিছু কিছু সময় ফরাসি আদালতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার যথেষ্ট প্রমাণ মেলে না। যে ফ্রান্স সরকার নির্যাতন ও মৃত্যুদÐের সম্মুখীন হতে পারে এমন বিদেশীদের দেশে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করে। তারাই তার নাগরিকদের সেই আইনি ব্যবস্থার হাতে ছেড়ে দিয়েছে যেখানে যথাযথ প্রক্রিয়া ও অধিকার গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দুর্বল এবং মৃত্যুদÐ সাধারণ বিষয়।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরাকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিচার মারাত্মক রকম ত্রæটিপূর্ণ। নির্যাতন ও জোর করে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়। কিছু বিচারক পক্ষপাতিত্ব করেন এবং আসামীরা নিয়মিত ভাবে পর্যাপ্ত আইনগত পরামর্শ পান না। জেনেভায় আন্তর্জাতিক ও উন্নয়ন স্টাডিজ গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের আর্ন্তজাতিক আইনের অধ্যাক অ্যান্ড্রু ক্ল্যাপহ্যাম বলেন, আপনি এমন কোনো বিচারকে অনুমোদন করতে পারেন না যে বিচার সুষ্ঠু নয় এবং শাস্তি হচ্ছে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

সরকার অনুমোদিত আইনজীবীরা একটি সন্ত্রাসবাদ মামলাকে বিচার থেকে আপিল পর্যন্ত নিয়ে যেতে মাত্র ২৫ ডলার পান। এ সপ্তাহের মামলাগুলোতে একজন আইনজীবী জানান, তিনি তার মক্কেলকে আদালত কক্ষে আনার আগে তার মামলার ফাইল দেখতে পারেননি। অন্যরা বলেন, তারা পাঁচ থেকে দশ মিনিট মাত্র ফাইল দেখার ও মক্কেলের সাথে কথা বলার সুযোগ পান।

ইরাকের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন নানা কিছুর মিশ্রণ যাতে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সদস্যপদকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। সুতরাং আইএসের পাচকও বোমা তৈরিকারকের মত একই দÐে দÐিত হবে- যাবজ্জীবন কারাদÐ বা মৃত্যুদÐ। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনের অস্পষ্টতার অর্থ হচ্ছে এই যে মানুষকে সুনির্দিষ্ট কোনো অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হয় না। তাই, এ সপ্তাহে দÐপ্রাপ্তরা যদি হত্যা, নির্যাতন বা ধর্ষণ করে থাকেন, সে সব বিষয় বিচারে উঠবে না।

৭ জনকে মৃত্যুদÐ দিয়ে বিচারক আলির মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০১৮ সালে প্রচুর মৃত্যুদÐদাতা দেশগুলোর মধ্যে ইরাকের অবস্থান পঞ্চম। দেশটিতে গুরুদÐ দেয়ার যথেচ্ছচারিতা আন্তর্জাতিক চুক্তি লংঘন করেছে যাতে ইরাক স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তিতে হত্যার মত ভয়ানক অপরাধ ছাড়া মৃত্যুদÐ প্রদান সংরক্ষিত।

ইরাকের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রথম ৪ মাসে ইরাকি আদালতগুলোতে আইএস সন্দেহে ৫১৪ জনের বিচার করা হয়। একজন মুখপাত্র বলেন, এর মধ্যে কতজন মৃত্যুদÐ পেয়েছেন বা কতজনের মৃত্যুদÐ কার্যকর করা হয়েছে তার কোনো রেকর্ড নেই।
একজন ফরাসি আসামী বলেন, স্বীকারোক্তি লিখে দিতে তার উপর নির্যাতন চালানো হয়। গত সোমবার তার বিচার চলার সময় ফ্রান্সের রুবেক্স-এর অধিবাসী ফযিল তাহার আউদেত তার শার্ট তুলে বিচারককে পেটের উপরের কালো দাগগুলো দেখান। তারপর ঘুরে আদালত কক্ষের বাকি সবাইকে তা প্রদর্শন করেন।

আসামির অভিযোগ একটি মেডিক্যাল টিম কর্তৃক মূল্যায়ন না করা পর্যন্ত বিচারক আলি তার বিচার কাজ স্থগিত রেখেছেন। গত রোববার আবার দিন ধার্য করা হয়েছে। আরেকজন আসামি মোহাম্মদ হাসান মোহাম্মদ বারিরি গত বুধবার বলেন, তিনি লোকদের নির্যাতন করতে ও মারধর করতে দেখেছেন। তা থেকে বাঁচতে আমি যা কিছু বলবো তাতেই রাজি।

গত রোববার প্রথম তিনটি মামলায় মৃত্যুদÐ দেয়ার পর ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, ফ্রান্স ইরাকি কর্তৃপক্ষের সার্বভৌমত্বকে নীতিগত সম্মান করে। কিন্তু ফ্রান্স ভাবে মৃত্যুদÐের বিরোধী, যখনই হোক আর যেখানেই হোক। ইরাকি আইনে মৃত্যুদÐ প্রাপ্তরা আপিল করতে পারবেন এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে প্রেসিডেন্ট তাতে স্বাক্ষর করেন। লা ড্রিয়ান বলেন, ইরাকি প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহর সাথে তিনি মৃত্যুদÐ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

ইরাক-ফ্রান্স আলোচনা যদি কোনোক্রমে সফল হয়ও, সিরিয়ায় থাকা ৮০টি দেশের বাকি তিন হাজার বন্দির ক্ষেত্রে থাকা বাধা অপসারিত হবে না। কয়েকটি দেশ সিরিয়ায় আটক আইএস বন্দিদের বিচারের জন্য ইরাকে পাঠাতে ইরাক সরকারের সাথে আলোচনা করছে। ইরাক সন্দেহভাজন বন্দিদের বাকি মামলাগুলোর বিচার করতে আগ্রহী। কিন্তু সে জন্য বন্দিদের দেশগুলোর কাছে আদালত ও বন্দিদের ব্যয় বাবদ অর্থ চাইছে। জানা গেছে ইরাক প্রতি বন্দির জন্য ১০ লাখ ডলার চেয়েছে।

কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ সন্দেহভাজন আইএসদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এ ধরনের কোনো সংস্থা গঠন করলে ব্যয় অত্যধিক হবে। তাদের কাজের ক্ষমতা সীমিত ও অবাস্তব হবে। উত্তরপূর্ব সিরিয়ার কুর্দি কর্তৃপক্ষ বিদেশী ইসলামিক স্টেট বন্দিদের ন্যায় বিচারের জন্য আদালত ভবন নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্ত তার অবস্থান হবে যুদ্ধাঞ্চলে যেখানে সুস্পষ্ট সার্বভৌমত্ব নেই।

জাতিসংঘের বিশেষ ইরাক প্রতিনিধি জেনিন হেনিস প্লাসচার্ট বলেছেন, শেষ পর্যন্ত দেশগুলোকে তাদের নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে হবে। যার মধ্যে নাগরিকদের সাথে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক ব্যবহারও রয়েছে। তিনি বলেন, একজন আশা করবে যে দেশগুলো স্ব স্ব নাগরিকদের প্রক্রিয়ার মাধ্যম বিচার ও উগ্রবাদ থেকে সরে আসার ব্যবস্থা করবে।

গত সোমবার বিচারক আলি ৩৭ বছর বয়স্ক মোস্তফা মারজুঘিকে ব্যাখ্যা করতে বলেন যে তিনি কেন সিরিয়া এসেছিলেন। স্থ‚লদেহী ব্যক্তিটি প্রথমে কিছু বলতে চাননি। পারে বলেন, আমি বোকামি করেছি, এ জন্য দুঃখিত। আমি কাউকে হত্যা করিনি। আমি কোনো অপরাধ করতে চাইনি। আমি জানি আমি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যোগ দিয়ে বিরাট ভুল করেছি। আমি এও জানি আপনি আমাকে মৃত্যুদন্ড দেবেন।

শুনানি শেষে বিচারক তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন যে তার বার বার দুঃখপ্রকাশ নথিবদ্ধ করা হবে কিনা। মারজুঘি বলেন, অপরাধকারীদের এ রকম দুঃখ প্রকাশের অনুভ‚তি হয়। তবে তা অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Masum Billah ৩১ মে, ২০১৯, ৪:২২ এএম says : 0
এটাই ওদের প্রাপ্য মানুষ নামের জানোয়ারদের জন্য
Total Reply(0)
Amran Hossain ৩১ মে, ২০১৯, ৪:২৩ এএম says : 0
পৃথীবি থেকে আই এস সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
Total Reply(0)
Naz Kabir ৩১ মে, ২০১৯, ৪:২৩ এএম says : 0
এগুলারে ফাঁসি দেয়ার কি আছে? এগুলাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা উচিৎ। এরা ইসলামের কিছুই জানে না। জানে শুধু নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলতে।
Total Reply(0)
Alauddin Al Mahmud ৩১ মে, ২০১৯, ৪:২৩ এএম says : 0
আরে ভাই! এরা জঙ্গী টঙ্গি কিছুই না, এরা নিরপরাধ ইরাকি জনতা,,
Total Reply(0)
Nahid Hassan ৩১ মে, ২০১৯, ১০:১৫ এএম says : 0
মধ্যপ্রাচ্যে যে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতেছি না
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন