ইসলামে নারীর মর্যাদা নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি আছে। এই বিভ্রান্তির কারণ হলো এই যে আমরা কোরআন-হাদিস ভালো করে পড়ি না বা পড়লেও মেয়েদের সম্পর্কে যে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে তা করি না। ইসলামে নারীকে যে সুমহান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা পশ্চিমের মেয়েদের ভাগ্যে একশো বছর আগেও জোটেনি। প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে ইওরোপের কয়েকটি দেশে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত মেয়েরা ব্যাংক চেক সই করতে পারতো না। ঘোড়ায় চড়লে সাইড-স্যাডলার হিসেবে বসতে হতো। ইংল্যান্ডে সম্পর্কে পর্যটকদের লেখা পড়লে জানা যায় যে একশো বছর আগেও মেয়েদেরকে আসবাবপত্রের সাথে তুলনা করা হতো। এ প্রসঙ্গে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পৃষ্ঠপোষক প্রিন্স চার্লস এর সঙ্গে ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কাউন্সিলে কথা বলবার সুযোগ হয়েছিলো। তিনি বললেন, ‘আমাদের নানী-দাদীরা যেসময় নানান রকম বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ, তারও অনেক আগে ইসলামে মেয়েদের অধিকার ছিলো তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।’ জন্মের পর একজন ছেলেকে ইসলামে যেভাবে খাদ্য, পোষাক-আশাক, শিক্ষা ও আদব-কায়দা দিয়ে বড় করতে বলা হয়েছে তা ছেলের বেলাতেও যেমন প্রযোজ্য, মেয়ের বেলাতেও ঠিক একই রকম প্রযোজ্য। একটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে নবী করিম (দ.) একজন সাহাবীকে বলেছিলেন, কারো যদি তিনটি মেয়ে থাকে এবং সে যদি তাদেরকে ভালোভাবে বড় করতে পারে, তাহলে সে বেহেশতে যাবে। একথা শুনে একজন সাহাবী বল্লেন আমার তো দু’টি মেয়ে আছে। আমি যদি তাদের ভালোভাবে মানুষ করতে পারি তাহলে কি আমি বেহেশতে যাবো? রাসূল বলেছিলেন, হ্যাঁ। আরেকজন সাহাবী বলেছিলেন যদি কারো একটি মেয়ে থাকে এবং তাকে তার বাবা ভালোভাবে মানুষ করে, তবে সেই বাবা কি বেহেশত পাবে? নবী করিম (দ.) জবাব দিলেন, হ্যাঁ, সে-ও বেহেশত পাবে।
সন্তান লালন-পালনে মেয়েরা যেমন ত্যাগ স্বীকার করে তার মূল্যায়ন ইসলামে যেমন হয়েছে, অন্য ধর্মে তেমনটি দেখা যায় না। সন্তান প্রসব করা যেমন একটি অতি সাধারণ ব্যাপার কিন্তু তবুও পবিত্র কোরআনে সন্তানদেরকে চিন্তা করতে বলা হয়েছে যে তাদের মা গর্ভাবস্থায় কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করেছেন এবং তাদের পরিচর্যা করেছেন। সেজন্যে সন্তানদেরকেও বলা হয়েছে মা-বাবার উপর রহমত বর্ষণের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার জন্য। প্রার্থনাটাও কোরআনে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা। অর্থাৎ হে আমার প্রভু, আমার মাতাপিতা ছোটবেলায় আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেছে, ঠিক তেমনিভাবে তুমিও তাদের উপর রহমত বর্ষণ করো।
এভাবে শিশুদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা পাওয়া, কর্মজগতে প্রবেশ করা- কোনো জায়গাতেই ইসলামে ছেলে এবং মেয়েদের ভেতর কোনো পার্থক্য করা হয়নি। একটি চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে এই যে কোরআনে ২৪ বার নর-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিক নারীর কথা-ও উল্লেখ করা হয়েছে ওই ২৪ বার। ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (দ.) পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন, ‘জ্ঞানার্জন নর ও নারী উভয়ের জন্যে অবশ্যকর্তব্য।’ আমরা রাসূলের হাদিস মানি সুন্নাত হিসেবে। কিন্তু রাসূল যে কাজটিকে ফরয বলে গিয়েছেন, সেই কাজটিই আমরা এখনো পর্যন্ত ঠিকমত করে উঠতে পারিনি। এটা বড়ই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই উক্তিটি বাংলাদেশের প্রতি বাড়ির প্রবেশদ¦ারে স্মারক হিসেবে ঝুলিয়ে রাখা উচিত। তাহলে আমরা নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে আরো আগেই মুক্ত হতাম এবং আমাদের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হতো। একথা তো সত্যি যে একটি গৃহে একজন শিক্ষিত মা থাকলে তার কোনো সন্তান নিরক্ষর থাকতে পারে না। তাই ইসলামের দিক দিয়ে নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার পর প্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন নারী (বিবি খাদিজা রা.)। ইসলামের জন্য প্রথম শহীদ হন একজন মহিলা। আজকে আমরা ইসলামের প্রচারের কথা বলি। কিন্তু এই প্রচারে, বিশেষ করে হাদিস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে পবিত্র রমণীর অবদান অনস্বীকার্য তিনি হচ্ছেন বিবি আয়েশা (রা.)। আমরা যদি ইসলামের পবিত্র অনুষ্ঠান হজ-এর দিকে তাকাই তাহলেও দেখবো যে হজ্বের যে রিচুয়ালস বা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের উৎসে রয়েছেন মহিলারা। হজ্বে যখন মুসলমানেরা সাফা এবং মারওয়ার মধ্যে যাতায়াত করেন, তখন দু’প্রস্থ সবুজ বাতির ভেতরের জায়গাটি একটু জোরে অতিক্রম করবার সময় কারো কি মনে হয় না যে এই কাজটি একটি নারীর স্মরণে করা হচ্ছে? সেই মহিমান্বিত নারীটি হচ্ছেন বিবি হাজেরা (রা.)। উনি যখন সন্তানকে রেখে পানির সন্ধান করছিলেন তখন উল্লেখিত অংশে গিয়ে তিনি সন্তানকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি জোরে হাঁটছিলেন সন্তান কোনো জন্তু দ্বারা আক্রান্ত হলো কিনা এই দুশ্চিন্তায়। তারপর হজ্বের অনুষ্ঠান শেষে যখন যমযমের পানি খাওয়া হয় তখন কি কারো মনে পড়ে না যে পানির এই উৎসের জন্য একজন রমণী (বিবি হাজেরা রা.) কী করুণ আকুতি করেছিলেন ¯্রষ্টার কাছে। তারপর পানি যখন উঠলো তখন তিনি বলতে বাধ্য হলেন যে যম, যম। অর্থাৎ থাম, থাম। এই সুশীতল পানি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমরা পান করে চলেছি এবং এই পানিকে মুসলমানেরা অত্যন্ত পবিত্র বলে গণ্য করেন। কিন্তু এই পবিত্র পানির উৎসে যেই পবিত্র রমণী রয়েছেন তার কথা আমরা ক’জন মনে রাখি? হজ্বে মহিলাদের সংশ্লিষ্টতা আরো ব্যাপক।
অথচ এই মানুষ-ই আমরা যখন রাস্তায় চলাচল করি তখন জেনান-মর্দ, নর-নারী, মানব-মানবী কত না ভেদাভেদ! একক্ষণ এসব কথা শুনে অনেকে হয়ত ভাবছেন আমি আসল জায়গাতে কেন আসছি না। আসল জায়গাটা হচ্ছে সেইখানে যেখানে অনেক শিক্ষিত মেয়েই পর্দা এবং উত্তরাধিকার নিয়ে মেয়েদেরকে বৈষম্যের শিকার বলে মনে করেন। এবার এ দুটো প্রসঙ্গেই আমরা আসি।
প্রথমেই আসি পর্দা প্রসঙ্গে। ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবী, শার্ট-প্যান্ট পড়তে পারে অথচ মেয়েদের কেনো পর্দা করতে বলা হয়েছে- এধরনের একটি অভিযোগ অতীব সাধারণ। প্রথমেই বলে রাখা দরকার, পর্দা সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা মোটেই স্বচ্ছ নয়। পর্দা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সূরা নূর ও সূরা আহযাবে নির্দেশক কথাবার্তা বলা হয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে এই যে মেয়েদেরকে পর্দা করতে বলার আাগে ছেলেদেরকে পর্দা করতে বলা হয়েছে। সূরা নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুমিনদিগকে বল, তাহারা যেন তাহাদিগের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাহাদিগের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে; ইহাই তাহদিগের জন্য উত্তম। উহারা যাহা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত।’ এর পরে মেয়েদেরকে পর্দা করতে বলা হয়েছে, ‘মুমিন নারীদিগকে বল, তাহারা যেন তাহাদিগের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাহাদিগের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে; তাহারা যেন যাহা সাধারণত পরে থাকে তাহা ব্যতীত তাহাদিগের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে...।’ মেয়েদের পর্দার ক্ষেত্রে যে বাড়তি কথাটা বলা হয়েছে তা হলো ‘গ্রীবা ও বক্ষদেশ’ যেনো মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করা হয়। এখানে কি রঙের কাপড় পড়া হবে, তার কম্পোজিশন কেমন হবে- কটন, উল বা অন্য কোনো উপাদান দ্বারা তৈরি হবে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। অর্থাৎ বক্ষ, গ্রীবা, ও মাথা ঢাকার কাপড়টি পরিধানকারীনির ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা নির্ণীত হতে পারে। শাড়ি পরিহিতা বা সালওয়ার-কামিজ পরিহিতা একজন মহিলা একটি চাদর দ্বারাই এই পর্দার কাজটি করতে পারেন। তবে পর্দা এখন হয়ে গিয়েছে কালো রঙের আজানুলম্বিত একটি বস্ত্রখন্ডের সমার্থক। প্রকৃত বিশ্লেষণে ইসলামে পর্দার আসল তাৎপর্য হচ্ছে শালীনভাবে পোশাক পরা। আসল কথা হচ্ছে, পোশাক এমনভাবে পরতে হবে যাতে দেহের ভূগোল ও জ্যামিতি প্রকটভাবে ধরা না পড়ে। ছেলেদের পর্দা করা, অর্থাৎ দৃষ্টিকে নি¤œমুখী করা এজন্য প্রয়োজন যে একজন লোক যদি একটি সুন্দরী মেয়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাহলে সেই মেয়েটি বিব্রত বোধ করেন। কিছুদিন ধরেই আমরা যে ইভ টিজিং এর কথা শুনে আসছি তা বাস্তবিকভাবেই সভ্যতা বিবর্জিত এবং মেয়েদের চলাচলের অনেক বিঘœ ঘটিয়ে থাকে। অনেকেই মনে করে থাকেন, পর্দা মেয়েদের কাজকর্মের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কথাটি সত্য নয়। আমি এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৮০-র দশকে আমার একবার ইরান যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। একজন তরুণ পিএইচডি শিক্ষার্থী আমার গাইড হিসেবে কাজ করছিলেন। আমি একসময় কথা বলতে বলতে বলে ফেললাম, বিবিসিতে যা শুনছি তাতে তো মনে হয় তোমরা তোমাদের মেয়েদেরকে একেবারে অন্দরমহলে পাঠিয়ে দিচ্ছো; এটা কি ঠিক হচ্ছে? একথা শোনা মাত্রই ওই তরুণ ভদ্রলোক আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে একটি বড় রাস্তায় নিয়ে গেলেন। আমার হঠাৎ মনে হলো আমি বোধহয় কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছি। তিনি আমাকে বললেন যে রাস্তার দিকে তাকাও এবং দেখো যে কারা গাড়ি চালাচ্ছে। আমি দেখলাম, চার পাঁচজন পুরুষ এর পরে একজন মহিলা গাড়ি চালাচ্ছে। তিনি আবার বললেন, তুমি যে হোটেলে অবস্থান করছো, সেখানে মেয়েরা কিন্তু চাকরি করছে। আবার তুমি যদি আজ বিকেলে শপিংয়ে যাও তাহলে সেখানেও দেখবে মেয়েরা দোকানে কাজ কর্ম করছে। কাজ করছে অফিস-আদালতেও। শুধু তফাৎ হলো এই যে তারা হিজাব পরিধান করে করছে। কথা হলো এই যে এই হিজাব তাদের কোনো কাজেই কোনো অন্তরায় হয়ে দেখা দিচ্ছে না। এর পর এই প্রসঙ্গে আমি আর কোনো কথা বলতে পারিনি।
এবার আসা যাক উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। অনেক মেয়েরই একটি অভিযোগ যে বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে ছেলেরা দু’ভাগ পাবে আর মেয়েরা একভাগ পাবে কেনো? ভাবটা দেখে মনে হয় যে মহান স্রষ্টা তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা-প্রসূত পরিকল্পনার মাধমে জটিল ম্যাথেমেটিক্সের সাহায্যে সকল বস্তু রচনা করেছেন (ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম এবং বৃহৎ হতে বৃহত্তম) তা বুঝতে আমরা বিজ্ঞানীরা হিমশিম খাচ্ছি। তাহলে কি জ্ঞানের সকল উৎস এবং সর্বোত্তম গণিতবিদ মহান আল্লাহ তায়ালা কি পাটীগণিতে দুর্বল? (নাউযুবিল্লাহ্্)
আসলে এই দুইভাগ বনাম একভাগের বিবেচনাটি একটু খতিয়ে দেখা দরকার। আগেই বলেছি মেয়েদেরকে ভালো করে গড়ে তোলা, তাদেরকে শিক্ষাদান করা, সমাজের কল্যাণমূলক কাজে চাকরি করা, এর কোনোটিতেই মেয়েদের জন্য কোনো বিধিনিষেধ নেই। অথচ সংসারের ব্যয় নির্বাহ করবার জন্যে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুরুষ মানুষকে। এমনকি মেয়ের বিয়ের পরেও যদি তার উপর নির্ভরশীল কোনো আত্মীয়স্বজন তার কাছে এসে থাকে, তবে তাকে দেখাশোনার দ্বায়িত্ব-ও স্বামীর উপর বর্তায়। দুঃখের কথা হলো এই যে আজকাল ভাইয়েরা বোনদের দিকে এই দৃষ্টি আর দেয় না। আজকাল কোনো বাচ্চা জন্মের সময় যদি নার্সিং হোমে জন্ম না হয় তাহলে সাধারণতঃ জন্ম হয়ে থাকে মাতুলালয়ে। অর্থাৎ মেয়েরা বাপের বাড়িকে একটা আশ্রয়ের জায়গা হিসেবেই মনে করে থাকেন। বোনদের প্রতি ভাইদের তাই উচিত এই প্রীতিকর রীতিটির পুনরাবির্ভাব ঘটানোর মতন পদক্ষেপ নেওয়া।
আবার উত্তরাধিকার আইনে চলে আসি। উত্তরাধিকার প্রশ্নটি সাধারণত আসে বিয়ের অনেক পরেÑ মাতাপিতার মৃত্যুর পরে। সাধারণত আমরা লক্ষ করি, মাতাপিতা মেয়ের বিয়ের পর নানা-নানী হন, তাদের সঙ্গে খেলা করেন এবং একটি পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেন। তখনি উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি আসে। কিন্তু মোহরানার প্রশ্নটি আসে বিয়ের সাথে সাথেই। আমি একবার মহিলা সমিতির একটি মিটিংয়ে, যেখানে অনেক সুশিক্ষিতা নারী ছিলেন, সেখানে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম, যে আপনাদের পরিবারে বিয়েশাদী হলে আজকের বাজারে মোহরানার অংকটি কেমন হবে? তাঁরা অনেক আলোচনা করার পর বললেন, কমপক্ষে পাঁচ-ছয় লাখ তো হবেই। কেউ কেউ দশ লাখের প্রতিও ইঙ্গিত করলেন। আমি বললাম যে ঠিক আছে, আমরা ছয় লাখ-ই ধরলাম। এই টাকাটি কিন্তু মেয়েকে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেওয়ার কথা। এখানে কোনরকম ফাঁকিবাজির ¯েকাপ নেই। কোনো মৌলভী সাহেব বা ম্যারেজ রেজিস্ট্রার যদি বলেন আমি টাকা দেখতে পাচ্ছি না, সুতরাং বিয়ে পড়ানো যাবে না, তাহলে তাঁকে ফাঁসিকাঠে চড়ানো যাবে না। তাহলে ধরা হলো যে মেয়েটি বিয়ের সময় ছয় লাখ টাকা পেলেন এবং লাভজনক কোনো জায়গায় টাকাটি খাটিয়ে ‘ছয় বছরে টাকা হবে দ্বিগুণ’ এমন একটি ব্যবস্থা করলেন। আমি ওই বিশিষ্ট মহিলাদেরকে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলাম। তা হলো এই যে আপনাদের স্বামীরা যদি হালাল রিযিক উপার্জন করেন এবং আপনাদেরকে সেই টাকা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করিয়ে থাকেন এবং আপনারা যদি দুই ভাই দুই বোন হন, তাহলে কি মৃত্যুর সময় আপনাদের স্বামীরা খুব একটা বেশি টাকা কি জমিয়ে যেতে পারেন? ওনারা বললেন, না। আমি তখন বললাম যে ধরে নেই এক কোটি টাকা আছে। এখন বিয়ের ২৫ বছর পরে যদি বাবার মৃত্যু ঘটে, তখন ওই এক কোটি টাকা দুই ভাই দুই বোনের ভেতর বিতরণ হলে প্রত্যেক ভাই পাবে ৩২ লাখ এর কিছু ঊর্ধ্বে। আর বোনেরা পাবে ১৬ লাখের কিছু ওপরে। যদি ‘ঠকা’র কথা আসলেই বলতে হয়, তাহলে বোন ১৬ লাখ টাকা কম পেল ঠিকই। কিন্তু বিয়ের শুরুতে সে যে ৬ লাখ পেয়েছিলো সেটা ২৪ বছর পরে কমবেশি ৯৬ লাখ হয়ে গিয়েছে। এই ৯৬ লাখ তো কম পাওয়া ১৬ লাখের ৬ গুণ। তাহলে এখানে তো মনে হচ্ছে ¯্রষ্টা বোধহয় মেয়েদের প্রতি কোনো অবিচার-ই করেননি। অবিচার করছি আমরা। আমরা মোহরানাটি ঠিকমত দিচ্ছি না। পুলিশ একাডেমিতে একবার আমি পুলিশ অফিসারদের সাথে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে এই মোহরানার কথা এলো। ২০ জন পুলিশ অফিসারের ভেতরে এক দু’জন ছাড়া বাকীরা সবাই বল্লেন যে, তাঁরা মোহরানা আদায় করেননি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে, তাহলে আপনাদের বিয়েটা হলো কীভাবে? এই প্রশ্নে সবাই মুখ নিচু করলেন।
এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে। মেয়েদের যা প্রাপ্য তা যদি আমরা ঠিকভাবে আদায় করি এবং তাদের প্রতি ভালোভাবে ব্যবহার করি, তাহলে বলা-ই যায় যে আল্লাহতায়ালা গণিতশাস্ত্রের সঠিক প্রয়োগ-ই আমাদের জীবনে ঘটিয়েছেন; মেয়েদের প্রতি কোনো অন্যায়-অবিচার করেননি। অনেকে মনে করতে পারেন যে, একজন নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তি যখন বিয়ে করবে তখন তার মোহরানা কত টাকা হবে? এক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে যে বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি এবং এই চুক্তিতে যার যেমনটা সামর্থ্য তেমনটি-ই মোহরানা দেবে। এই পরিবারে উত্তরাধিকার হতে পারে থালাবাসন নিয়ে, জমিজমা-টাকাপয়সা নিয়ে নয়। সুতরাং আসল কথা হচ্ছে এধরনের সমাজে দারিদ্র্যবিমোচনই হবে প্রধান লক্ষ্যবস্তু এবং মানুষ যখন দারিদ্র্যসীমার ওপরে গিয়ে স্বচ্ছল অবস্থায় ইন্তেকাল করবে, তখন যদি ধর্মীয় বিধান আমরা মেনে চলি এবং মেয়েদের যা প্রাপ্য তা যদি আমরা ঠিকমত দিই, তাহলে মেয়েরা কখনোই ইসলামিক জীবন পদ্ধতিতে অবিচার ও প্রবঞ্চনার শিকার হতে পারে না।
০ লেখক: শিক্ষাবিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন