মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার ও স্বরূপ

প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এ এইচ এম মোস্তাইন বিল্লাহ

॥ তিন ॥
এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। এ ছাড়াও বিশেষত ষোড়শ শতাব্দীতে মাদ্রাসা সংখ্যা বৃদ্ধির আরো একাধিক কারণ রয়েছে: প্রথমত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ক্ষমতা সংহত হওয়ার ফলে সে সময়ের এ অবস্থায় সৃষ্টির পেছনে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীভূতকরণ ও দায়ী ছিল। দ্বিতীয়ত; পাশাপাশি সমাজে আলেম, সুফিদের ধর্মগুরু হিসেবে তাদের সম্মান ও প্রভাব সমাজে বৃদ্ধি পেয়েছিল। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সম্রাট ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মুঘল সম্রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ দুটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়; শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্বৈত বৈপরিত্য শিক্ষার ব্যবস্থার ধারার উপস্থিতি। একটি সমাজের বিপুল অংশের জনগোষ্ঠীকে মাদ্রাসা পাঠ্যসূচিতে সম্পৃক্তকরণ; দ্বিতীয়টি মাদ্রাসা শিক্ষাকে সমসাময়িক বিষেশত ইউরোপিয়ান বিজ্ঞান ও শিক্ষায়ন্নোয়ন থেকে আলাদা করা। নাস্তিক ও পাশ্চাত্যবাদীরা মনে করত বিজ্ঞান শিক্ষার মূল্যে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারণ হচ্ছে, তাতে জাতি বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি জ্ঞানার্জনে পিছিয়ে থাকছে।
প্রভাবশালী ঐতিহাসিকগন এ বিষয়ে একমত যে, মুঘল শাসকদের মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার ছিল সাধারণ শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে। নরেন্দ্র নাথ ল’ তাঁর ভারতে মুসলিম শাসকদের শিক্ষা গবেষণায় অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, প্রায় সকল মুঘল সম্রাটই সাধারণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রসারে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলেন (ল’ ১৯১৬ : ১৯০)
এ উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ঐতিহাসিক তথ্য বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাবরের শাসনামল (১৫২৬-৩০) সাধারণ জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হত। সম্রাট আকবর তাঁর শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) শিক্ষা সম্প্রসারণে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর সময় সরকারি বহু বিভাগ/প্রশাসনিক অবকাঠামো তৈরী করেছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করার জন্য। তার শাসনামলকে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা হয়ে থাকে, (আকরাম, ১৯৬৪ : ১৫৪)।
স¤্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৬০৫-১৬২৭) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক আইন পাস হয়ে ছিল, তা’হল কোন বিত্তবান ব্যক্তি অথবা ধনবান পরিভ্রমণকারী উত্তরাধিকারিহীন অবস্থায় মারা গেলে তার সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হত। আর এ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরামত করা হত। জান জাহান খান তার ঞধৎরশযর ঔধহ ঔধযধহ এ উল্লেখ করেছেন যে, স¤্রাট জাহাঙ্গীর এমন মাদ্রাসা ও মেরামত করেছেন যেগুলো দীর্ঘ ত্রিশ বৎসরে যাবৎ পশু-পাখির আবাসস্থল হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় পরিপূর্ণ ছিল।
স¤্রাট শাহজাহানের শাসনামলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে আনুষ্ঠানিক যে আইনটি উৎযাপন করা হয়েছিল তাহল ১৬৫০ সালে দিল্লি “ইম্পিরিয়াল কলেজ” প্রতিষ্ঠা লক্ষ্যে [ল’ ১৯১৬ : ১৯০] । মুঘল শাসনামলে কয়েকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল শিক্ষানুরাগী, সমাজের বিদ্যুৎসাহী এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দাতা বিত্তবানদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান। এর ফলে ব্যাপক হারে ব্যক্তি উদ্যোগে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে ছিল। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে আলেম উলামা বিত্তবান দাতাগণ অত্যন্ত সমাদৃত ছিলেন। প্রায়শই প-িতগণ ও স¤্রাটদের সহযোগী হয়ে সামরিক আগ্রাসনে ও যেতেন। মুঘল শাসনামলে রাষ্ট্র ও ওলামাদের নিবিড় সম্পর্ক বিশেষ কোন বিষয় ছিল না বরং উসমানিয়া এবং সুফিবিদ স¤্রাজ্যের বৈশিষ্ট্য ছিল। আলেম সমাজ রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে নিবেদিত থাকতে তারা স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। আর এ দায়িত্বটিকে তারা তাদের সফল কেরিয়ার হিসেবে নিতেন তা নয় বরং ধর্মীয় আইনের সফল বাস্তবায়নের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব এবং ধর্মীয় বিষয়াবলীর সঠিক ব্যাখ্যাদানের দায়িত্ব পালন করতেন। ফলে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ও শিক্ষার মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (মেটকাফ্, ১৯৮২ : ২১-২২)। এ সম্পর্কের মধ্যে যে কোন প্রকার টানাপড়েন ছিল না এমন কোন কথা নয়। তবে সার্বিক সমন্বয় নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল।
মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার ও বৃটিশ ষড়যন্ত্র
বৃটিশ মিশনারীর মাধ্যমে ভারতের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার
মাদ্রাসা শিক্ষার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা দেখা যায় যে ভারতের মাদ্রাসা শিক্ষা উপনিবেশিক প্রশাসনিক নীতি দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত ও পুনর্গঠিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে মুঘল স¤্রাজ্যের পতনের পর শিক্ষা কাঠামোকে তারা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রেখেছিলেন। তাছাড়া ভারতে মুসলমানদের সম্প্রদায়িক উত্থানের বিষয়টি উপনিবেশিক নীতিমালা প্রনয়নে তারা বিবেচনায় রেখেছিল, সর্বোপরি বৃটিশ উপনিবেশ শাসনামলে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর তখনকার রাজনৈতিক গতিময়তা ফুহধসরপং-এর সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল।
পলাশীযুদ্ধে বাংলার নবাবের পরাজিত ও মৃত্যুর নয় বৎসর পর ১৭৬৫ সালে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। আওরঙ্গজেবের ১৭০৭ সালে মৃত্যুর পর মুঘল সম্প্রাজ্য মূলত দিল্লিভিত্তিক হয়ে গিয়েছিল, প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে ভারতের পূর্বাঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীতি ছিল প্রাথমিকভাবে বেশী কার্যকর। আর অঞ্চলগুলো ছিল বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা, বৃটিশরা এসব এলাকাতে তাদের প্রাথমিক কার্যক্রমের এৎড়ঁহফ ড়িৎশ উপর ভিত্তি করে সমগ্র ভারতকে শাসন করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপের পদক্ষেপটি তারা গ্রহণ করে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর, ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্ট প্রবর্তনের মাধ্যমে। এ আইনটি তাদের গ্রহণ করতে হয় বহু বিতর্ক ও পদক্ষেপ গ্রহণের পর।
প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মুঘল শাসনামলের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বাহ্যিক তেমন কোন হস্তক্ষেপ করেনি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল শাসনামলের শিক্ষা ব্যবস্থার ধারা ও ঐতিহ্য অব্যাহত ছিল। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে প্রকৃত বিষয় উপলব্ধি করে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপ না করে, ধর্মীয়ভাবে খৃষ্টান মিশনারীর উদ্যোগে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রাজনৈতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে প্রথম মিশনারী স্কুল কলকাতায় ১৭০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটিশরা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুভূতি সংশ্লিষ্ট ছিল বিধায়, এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার জন্য তারা পলাশী যুদ্ধের পরপর বর্রাটক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে খৃস্টান মিশনারী ও এদের কর্মীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম বৎসরে ৪৮ জন ছাত্র থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৭৪ জনে (ইসলাম; ২০০২ : ২৭) [ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ ঁহফবৎ জঁষব ড়ভ ঊধংঃ ওহফরধ ঈড়সঢ়ধহু ধহফ অষর জরধু, ২০১০:ঢ়৭৭]
শিক্ষা সংস্কারের বিষয় ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অনেক দিন ভারত শাসন করার পর অহমষড় ওহফরধহং দের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হল, তাদের শাসন ভারতে দীর্ঘ স্থায়ী করা যাবে না, যদি এখানের অধিবাসীদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা না হয়। তদানুসারে ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া চার্টার নবায়ন কালে ইংল্যান্ডে কতিপয় উদ্যোগ নিয়েছিল। তা’হল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাধ্য করা হোক, তাদের রাাজস্বের একটি অংশ ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে খরচ করা জন্য। এ লক্ষ্যে জুন ১৫, ১৮৫৩ সালে হাউজ অব লর্ড গৎ. ঔ.ঈ গধৎংযসধহ-এর নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া বিভিন্ন কার্যাবলি পর্যালোচনা করা জন্য একটি কমিটি গঠন করে।
১৭৯২ খৃস্টাব্দ থেকে বিশ বৎসর পর্যালোচনার পর কোম্পানীর চার্টার নবায়ন করা হয় ১৮১৩ খৃস্টাব্দে। এ সকল উদ্যোগ ছিল কোম্পানীর রাজস্ব্যের একটি অংশ ভারতীয়দের শিক্ষা খাতে ব্যয় করা যাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন