চলছে মধুমাস গ্রীষ্মকাল। বর্ষা মৌসুম শুরু হতে আরো কয়েক দিন বাকি। এরই মধ্যে ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। শুধু ডেঙ্গু জ্বরই নয়; মশাবাহিত রোগব্যাধি এখন নাগরিক জীবনে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। এডিস ইজিপ্ট ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের দুই প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ ছড়ায়। এসব মশার বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তার লাভের কারণেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১ মে থেকে ৮ জুন রাজধানীতে প্রায় ২০০ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। জানুয়ারিতে ৩৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১৮, মার্চে ১২, এপ্রিলে ৪৪, মে মাসে ১৩৯ এবং চলতি জুনের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৫৫ জন আক্রান্ত হন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জুন পর্যন্ত তিন শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ভর্তি রোগীদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ২৭৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ডা. আয়েশা আক্তার জানান, চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মোট ৩০৪ জন রোগীর মধ্যে প্রায় ২০০ জন গত মে ও চলতি জুনের ৮ তারিখের মধ্যে আক্রান্ত হয়।
জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যাওয়ায় তাদের প্রেসার, পালস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিডনি, লিভার ফেইলিউর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মিরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, জিকা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে এসব রোগের বাহক মশা নিধন জরুরি। বাড়ির আশপাশের পাশাপাশি ঘরের ভেতরে যেসব স্থানে মশা বংশ বৃদ্ধি করে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে চার হাজার ২৯১ জন। ওই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুও হয়। এ বছর ইতোমধ্যে দু’জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে ঈদের আগে-পরে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুসহ মশার উপদ্রব বেড়েছে। ডেঙ্গু জ্বর বিশেষজ্ঞদের মতে, জুন-জুলাই মাস ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। বাড়ির আশপাশে যেন কোথাও পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে এখন ঋতু মেনে বৃষ্টি হয় না। তাই ডেঙ্গু যেকোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার পয়ঃব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ দূষণসহ নানাবিধ নাগরিক বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্য হু স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজারি গ্রুপ অব এক্সপার্টস (এসএজিএ) বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বে বিগত ৬ দশকে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩০ গুণ বেড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে উদ্বেগজনক হারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে রোগ প্রতিরোধে নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্বের মোট ১২৮টি দেশের প্রায় ৩৯ কোটি লোক প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে মাত্র ৫ লাখ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে সাতজন (চার ঘণ্টায় একজন) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। ১ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত ৫৫ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ৯। এ ছাড়া বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জন চিকিৎসাধীন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে দু’জন এপ্রিল মাসে মৃত্যুবরণ করেন। জানা গেছে, গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা ভর্তি হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ এপ্রিল তিনি মারা যান। এ ছাড়া আজগর আলী হাসপাতালে গত ২৮ এপ্রিল ভর্তি হয়ে ৩২ বছর বয়সী এক যুবক ২৯ এপ্রিল মারা যান।
ডা. আয়েশা জানান, বর্তমানে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বেড়েছে। বাড়ির আঙিনায়, নির্মাণাধীন বাড়িতে বৃষ্টির পরিষ্কার পানি টায়ার-টিউবে, ডাবের খোসা ও ভাঙা প্লাস্টিকের বোতলে জমে ডেঙ্গু মশার জন্ম হয়।
সূত্র মতে, কয়েক বছর আগে ঢাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ বড় ধরনের আতঙ্ক হয়ে দেখা দিলে সরকারের তরফ থেকে ঢাকায় মশা নিধন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দেশের প্রায় সব শহরই মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে থাকলেও শুরু থেকে ঢাকাই হচ্ছে এসব রোগের উদ্ভবের স্থল। এক জরিপে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের মোট ডেঙ্গু রোগীর শতকরা ৯১ ভাগই ছিল ঢাকায়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো অপ্রচলিত রোগের আকস্মিক প্রাদুর্ভাব ও মানুষের মৃত্যুর কারণে আতঙ্কজনক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মশক নিধন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবতার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
এমনকি গত বছর রাজধানীর ১৯টি এলাকাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে এসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য শুধু বিশেষ সতর্কবাণী জারির মাধ্যমেই কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। নেয়া হয়নি বিশেষ কোনো পরিকল্পনা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনালের শরীফ আহমেদের সাথে সেল ফোনে ডেঙ্গু সচেতনতায় সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি অফিসে এসে কথা বলার কথা জানান। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এখনো এ কার্যক্রম শুরু হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সচেতনায় গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারণেই তারা বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ইন্টারনাল রক্তক্ষরণ অনেক বেশি হয়। শিশুরা অল্পতেই শকে চলে যাওয়ায় তাদের প্রেসার, পালস খুঁজে পাওয়া যায় না। কিডনি, লিভার ফেইলিউর শিশুদের খুব দ্রুত হয়। সে কারণে ডেঙ্গুতে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। এ ছাড়া ডেঙ্গুর ধরনও অনেক বদলেছে। অনেক সময় জ্বর বেশি হচ্ছে না। হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সামান্য জ্বরে অল্প সময়ের মধ্যে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ কারণেও ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে।
রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মিরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, জিকা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে এসব রোগের বাহক মশা নিধন জরুরি। বাড়ির আশপাশের পাশাপাশি ঘরের ভেতরে যেসব স্থানে মশা বংশ বৃদ্ধি করে সেসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে শুধু বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করলেই হবে না। ঘরের মধ্যে যে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণগুলো আমরা করি সেটিও পরিহার করতে হবে। ঘরবাড়ি ও এর চারপাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ক্যান, টিনের কৌটা, মাটির পাত্র, বোতল, নারকেলের মালা বা এ জাতীয় পানি ধারণ করতে পারে এমন পাত্র ধ্বংস করার পাশাপাশি ঘরের আঙিনা, ফুলের টব, বারান্দা, বাথরুম, ফ্রিজ ও এসির নিচে জমানো পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে, যাতে মশা বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে। ডা. মিরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন নিলেও ঘরের ভেতরটা নিজেদেরই পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। সুস্থ ও অসুস্থ সবাইকে মশারি ব্যবহারের পরামর্শও দেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন