বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামী শরীয়ায় তওবার গুরুত্ব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ভালো হোক আর মন্দ হোক কোনো না কোনো কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। মোমিন বা মুসলমানদের জীবনে কাজের ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয়ে থাকে আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের বিধানের আলোকে। সে হিসেবে ভালো কাজে নেকি বা সওয়াব হয়, আর মন্দ কাজে গোনাহ হয়। গোনাহর মধ্যে আবার কোনো কোনোটি ছোট বা আল্লাহর বিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন নয়। আবার কোনোটি মারাত্মক লঙ্ঘন, এটিকে বলা হয় কবিরা গোনাহ বা মহাপাপ। কোনো ধরনের কবিরা গোনাহ হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ইসলামে তওবার বিধান রাখা হয়েছে। হাদিসে এসেছে, পাপ কাজ করার পর অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা পাপীদের মধ্যে উত্তম।

তওবা শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, অনুতাপ করা প্রভৃতি। পরিভাষায় তওবা হলোথ কোনো পাপকাজ সংঘটিত হওয়ার পর সেই পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সেই পাপ কাজ ছেড়ে ভালো কাজে ফিরে আসাকেই তওবা বলে। যেসব কথা ও কাজ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা থেকে ফিরে এসে ওই সব কথা ও কাজে নিয়োজিত হওয়া, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ও তার অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকা যায়। এক কথায়, গোনাহের কাজ থেকে ফিরে এসে সৎকাজে উদ্বুদ্ধ হওয়া।

কোরআন, হাদিস ও উম্মতের ঐকমত্যে এটিই ইসলামের বিধান যে, গোনাহের জন্য তওবা করা ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা আন-নূর : ৩১) । তিনি আরও বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তওবা করো।’ (সূরা হুদ : ৩)। আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, বিশুদ্ধ তওবা।’ (সূরা আত-তাহরিম : ৮)।

কোরআন ও হাদিসে তওবা সম্পর্কে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তা হলো, আল্লাহ রাবক্ষুল আলামিন সব ঈমানদারকে তওবা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা তওবা করে, ঈমান আনয়ন করে এবং ভালো কাজ করে আল্লাহ তায়ালা তাদের খারাপ কাজগুলোকে ভালো কাজ দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আর যারা তওবা করে এবং নেক কাজ করে আল্লাহর প্রতি তাদের তওবাই সত্যিকারের তওবা (সূরা ফুরকান : ৭০/৭১)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনের একটি অন্যতম কাজ ছিল এস্তেগফার ও তওবা করা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (এস্তেগফার) করি ও তওবা করি। (বোখারি)। মুসলিম শরিফের বর্ণনায় ১০০ বারের কথা বলা হয়েছে।

মানুষের কর্তব্য হলো, সে সব ধরনের গোনাহের কাজ থেকে তওবা করবে, যা সে করেছে। এ জন্য সব গোনাহের কাজ থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে হোক বা সম্মিলিতভাবে হোক তওবা করা অপরিহার্য। অধিক গোনাহের কাজ সংঘটিত হয়ে থাকলে একটি বা দুটি গোনাহের কাজ থেকে তওবা করলে সব গোনাহের কাজ থেকে তওবা বলে গণ্য হয় না। যেমন এক ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে, ব্যভিচার করে, মদ্যপান করে। সে যদি মিথ্যা কথা ও ব্যভিচার থেকে যথাযথভাবে তওবা করে তাহলে এ দুটো গোনাহের কাজ থেকে তওবা হয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু মদ্যপানের গোনাহের কাজ থেকে তওবা হবে না। এর জন্য আলাদা তওবা করতে হবে। আর যদি তওবার শর্তাবলি পালন করে সব গোনাহের কাজ থেকে এক সঙ্গে তওবা করে তাহলেও তা আদায় হয়ে যাবে।

যদিও তওবার তাৎপর্য হলো এ ধরনের সংঘটিত গোনাহের পুনরাবৃত্তি না হওয়া। তথাপি গোনাহ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হওয়ায় তওবা করে আবার পাপে লিপ্ত হয়ে পড়লে আবারও তওবা করতে হবে। তওবা রক্ষা করা যায় না বা বারবার তওবা ভেঙে যায় এ অজুহাতে তওবা না করা শয়তানের একটি ধোঁকা মাত্র। অন্তর দিয়ে তওবা করে তার ওপর অটল থাকতে আল্লাহ তায়ালার কাছে তৌফিক কামনা করা যেতে পারে। এটা তওবার ওপর অটল থাকতে সহায়তা করে।

তওবা দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভের মাধ্যম। তওবার আগে এস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। তারপর তওবা। ভবিষ্যতে এমন গোনাহের কাজ করব না বলে তওবা করলাম; কিন্তু অতীতে যা করেছি এ সম্পর্কে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম না। মনে মনে ভাবলাম, যা করেছি তা করার দরকার ছিল, ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন কী? তাহলে তওবা কবুল হবে না। যেমনথ আল্লাহ বলেন, তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তারপর তওবা কর। (সূরা হুদ : ৩)।

তওবা একটি ইবাদতও বটে। তওবা জাহান্নাম থেকে নাজাতের কারণ। বৈষয়িক জীবনেও তওবার সুফল রয়েছে। যেমনটি নুহ আলাইহিস সালাম তার স¤প্রদায়কে বলেছিলেন, আমি বললাম, তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি তো ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের সমৃদ্ধি দান করবেন, ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদীনালা। (সূরা নুহ : ১০-১২)।

দোষগুণ এ দুইয়ের সমন্বয়ে মানুষের জীবন পরিচালিত হয়। মানুষ দোষ করবে এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু দোষ, অন্যায়, পাপ যেন অভ্যাসে পরিণত না হয়, সেটাই বিচার্য। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক গুনাহ তথা অন্যায় থেকে তওবা করা ওয়াজিব। তওবার ব্যাপারে কোরআনের বহু আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি সম্পূর্ণ একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে। কেননা ওই সূরায় মুসলমানদের তওবার বর্ণনা রয়েছে। তাই তার নাম তওবা রাখা হয়েছে। (মাজহারি)।

তওবা সম্পর্কিত কোরআনের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হলো, তাবুক যুদ্ধের সময় দশজন সাহাবি বিনা কারণে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে সাতজন সাহাবি কৃত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে নিজেদের মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। (সূরা তওবা : ১০২)। বাকি তিনজন যথাক্রমে কাব ইবনে মালিক, মারার ইবনে রাবিয়া ও হিলাল ইবনে উমাইয়া (রা.)। রাসূল (সা.) তাদের সঙ্গে সালাম, দোয়া আদান-প্রদান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। তাদের সমাজচ্যুত করে রাখেন ৫০ দিন। এভাবে একঘরে করে রাখেন। কিন্তু রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রাখলেন, ক্ষমা করবেন কী করবেন না। তখন তাদের ব্যাপারে সূরা তওবার ১০৬নং আয়াত নাজিল করেন। (বোখারি ও মুসলিম)।

তওবা কবুল হওয়ার জন্য কতগুলো শর্ত বিদ্যমান। যদি শরিয়তের দৃষ্টিতে অপরাধমূলক কাজ তথা গুনাহ আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে হয় ও তার সঙ্গে কোনো মানুষের হক জড়িত না থাকে, তবে তা থেকে তওবা করার তিনটি শর্ত রয়েছে। আর তা তওবা কবুলের শর্তও বটে। প্রথমত, তওবাকারীকে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সে তার কৃত গুনাহের জন্য অনুতপ্ত। তৃতীয়ত, তাকে পুনরায় গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আর যদি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গুনাহের কাজটি সংশ্লিষ্ট থাকে, ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী তা থেকে তওবা করার ওপরের তিনটি শর্ত ছাড়া আরও একটি শর্ত আছে, যা বান্দার হকের সঙ্গে জড়িত। চতুর্থ শর্তটি হচ্ছে, তওবাকারীকে হকদার ব্যক্তির হক আদায় করতে হবে। শর্ত থাকে যে, প্রাপক জীবিত থাকলে তাকে তার ধনসম্পদ ফেরত দিতে হবে অথবা মাফ করিয়ে নিতে হবে। প্রাপক জীবিত না থাকলে তার ওয়ারিশদের ফেরত দেবে। কোনো ওয়ারিশ না থাকলে বায়তুল মালে জমা দেবে। যদি বায়তুল মালও না থাকে অথবা তার ব্যবস্থাপনা সঠিক না হয়, তবে প্রাপকের পক্ষ থেকে সদকা করে দেবে। এছাড়া কোনো অন্যায় দোষারোপ এবং অন্য কোনো বিষয় থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গিবত বা পরনিন্দার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সব তওবার জন্য অবশ্যই গুনাহ বর্জনীয়। শারীরিক দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে গুনাহ বর্জন করলে তওবা কবুল হবে না। যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকা ও তওবা করাই শরিয়তের কাম্য। কিন্তু কোনো বিশেষ গুনাহ থেকে তওবা করলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতানুযায়ী সে গুনাহ মাফ হবে। তবে অন্যান্য গুনাহ বহাল থাকবে। এ সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা মন্দ কাজ করে, তারপর তওবা করে নেয় এবং ঈমান আনে, তবে নিশ্চয়ই তোমার প্রভু তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী করুণাময়। (সূরা আল আরাফ : ১৫৩)।

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, হজরত আবু মুসা আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস আশয়ারি (রা.) রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ পশ্চিম (আকাশ) দিক থেকে সূর্যোদয় (কেয়ামত) না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতে তার ক্ষমার হাত স¤প্রসারিত করতে থাকেন। যাতে রাতে গুনাহগার তওবা করে। (মুসলিম)। উল্লিখিত আলোচনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। তওবা করার জন্য আসলে নির্দিষ্ট কোনো দোয়া বা পন্থা নেই, যার দ্বারা তওবা করা যায়। তবে প্রসিদ্ধ আছে যে, ‘আসতাগফিরুল্লাহ রাবিক্ষ মিন কুল্লি জানবিউ ওয়াতুবু ইলাইহি লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লা হিল আলিয়িল আজিম’থ এটা বলে মূলত তওবা করা হয়। এছাড়াও কয়েকটি দোয়া পড়া হয়। তবে মনে মনে বিশুদ্ধ নিয়ত করলেই তওবা কার্যত হয়ে যাবে।

লেখক ঃ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠানপাড়া (খানবাড়ি) কদমতলী, সদর-সিলেট।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন