লক্ষণীয় জরুরী বিষয়টি হচ্ছে, নামায, রোযা, তারাবীহ ও তাতে কুরআন খতম- এসবই ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত। আর সকল ইবাদতই একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে পালন করার নির্দেশ এবং করতে হয়। জাগতিক লাভ/বিনিময়/হাদিয়া প্রাপ্তির নিয়্যত বা প্রত্যাশা তাতে বৈধ নয়। কিন্তু নিয়্যত/প্রত্যাশা তো একটা অদৃশ্য ও মনোজগতের ব্যাপার। আর শরীয়তের মাসআলা বা আইন-বিধান প্রযোজ্য হয়ে থাকে বা বৈধ-অবৈধ বলা যায় বাহ্যিকভাবে দৃশ্য ও স্বীকারোক্তি কেন্দ্রিক কথাবার্তার নিরীখে মাত্র। অন্তরে বা মনে কি আছে, তা ধারণা করে বা মনে মনে যোগ-বিয়োগ করে একজন মুফতী ফাতওয়া দিতে পারেন না; এবং একজন বিচারক রায় দিতে পারেন না । সুতরাং যেখানে তারাবীর হাফেযের পক্ষ হতে বা কমিটির লোকজন কেউ তারাবীতে নিয়োগকালীন বা খতম শেষ কালীন ‘তারাবীহ’ তথা ইবাদতের বিনিময় দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন তেমন কিছু না বলার পরও, তেমন হাদিয়া বা সম্মানীকে ‘ইবাদতের বিনিময়’ বা ‘মজুরী’ দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন মর্মে ফাতওয়া দেন ও ‘না-জাযেয়’ বলেন, তা ¯্রফে বাড়াবাড়ির নামান্তর।
‘হাদিয়া’ বা ‘সম্মানী বাবত কিংবা এই নামে হাফেযদের দেয়ার ক্ষেত্রেও কোন কোন আলেম অবৈধতার পক্ষে যুক্তি দেখান, সারা বছর হাদিয়া দেন না কেন? তারাবীহ পড়িয়েছেন বিধায় কেন দিচ্ছেন? অথচ এমন প্রশ্ন তো অন্য বক্তা, পীর, উস্তাদ শ্রেণীর সকল আলেমের ক্ষেত্রেও হতে পারে যারা বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে জড়িত এবং হাদিয়া দাতাদের সাক্ষাতে এসেছেন বা আনা হয়েছে বিধায় বা একটু ওয়ায শুনিয়ে বা কুরআন শুনিয়ে বা মাছআলা-বিধান শিক্ষা দিয়ে বা আধ্যাত্মিক দীক্ষা দিতে এসেছেন বা আনা হয়েছে; তাই তখন দেয়া হচ্ছে। সারা বছর বা অন্য সময় আসেন না বিধায় তখন দেয়া হয় না বা দেয়ার কথা মনে জাগে না। এসব তো একটা স্বাভাবিক ব্যাপার । কুটতর্ক বা নেতিবাচক মনোভাব থাকলে এমন আরও অনেক কথাই বলা যায়; অনেক প্রশ্নই উত্থাপন করা যায়। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সহজ সমাধান বেরিয়ে আসে না এবং মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিদের সংশয়, দ্বিধা-দ্ব›দ্ব থেকে বাঁচানো যায় না।
নিজেদের কল্যাণে ধর্মীয় কাজ বা ইবাদত করা হবে এটাই ধর্মের নির্দেশনা । তাতে ১০ জনের যৌথ একটি ইবাদতের (জামাতের) সুবিধার্থে অন্য ২/১ জন হাফেযকে শুধু জড়িতই নয় বরং নিয়মিত থাকতে এবং ২৫/২৭ দিন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট সময়দানে বাধ্য করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অথচ সংশ্লিষ্ট সহযোগিতাকারী হাফেযদের ব্যক্তিগতভাবে ওই ইবাদতটি পালনে তেমন বাধ্য-বাধকতায় আটকা পড়ার প্রয়োজন ছিল না। উক্ত ‘সময়দান’ ও ‘আটকে পড়ার’ বিবেচনায় ইমাম/মুয়ায্যেন প্রমুখের বেতন-ভাতার বৈধতা বের করা হয়। তবে পার্থক্য বের করা হয় এই মর্মে যে, তাঁরা ফরয ইবাদতে সাহায্য করেন আর এই হাফেযরা সুন্নাতকাজে। যদিও ফরয ও নফলের মধ্যে তেমন পার্থক্য এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।যেমনÑ
“আর ফরয ও নফল সালাত এ ক্ষেত্রে সমান। আপনি কি জানেন না যে, যদি কোন এক ব্যক্তি অপর একজনকে ফরয বা নফল নামায পড়ানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ করে Ñতাতে তেমন পারিশ্রমিক ধার্য জায়েয নয়। একইভাবে আযানের ক্ষেত্রেও।”(Ñনষ্ট ইজারা অধ্যায়/খ-৪,পৃ-১৬;দারু ইবন হাযাম,বায়রুত, লেবানন‘,কিতাবুল-আসল’:ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী (র),১৩২-১৮৯হি:।) অর্থাৎ ‘পারিশ্রমিক’ বা‘ সম্মানী’ বৈধ হলে উভয়টিতে হবে; আর অবৈধ হলেও উভয়টিতেই হবে। সুতরাংÑ
ইমাম প্রমুখ ফরয কাজে সহযোগিতা করেন বিধায় ‘পারিশ্রমিক’ বা ‘বেতন’ নামেও বিনিময় গ্রহণ করতে পারেন (যা সকল ফাতওয়া গ্রন্থেই বিদ্যমান)। আর এঁরা হাদিয়া হিসাবেও নিতে পারবেন নাÑএমন ফায়সালা বিতর্ককেন্দ্রিক হতে পারে; সহজ-সরল দ্বীন ধর্মকেন্দ্রিক হতে পারে না।
শরীয়তের বিধি-বিধান তথা ইবাদত-উপাসনার দু’টি দিক লক্ষণীয় : একটি হচ্ছে ‘ফাযাইল’ বা উৎসাহ-উদ্দীপনা কেন্দ্রিক; আরেকটি হচ্ছে তৎসংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান কেন্দ্রিক। ‘ফাযাইল’ প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে নফল/মুস্তাহাব বিষয়েও অনেক বেশী উৎসাহব্যাঞ্জক বা অনেক কঠোর বাণী/বর্ণনা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু ফাযাইল সংশ্লিষ্ট হাদীস-দলীল দ্বারা বিধান নির্ধারিত হয় না; বিধান সংশ্লিষ্ট হাদীস-দলিল ভিন্ন হয়ে থাকে। সে কারণে জায়েয/নাজায়েয বলা বা ফাতওয়াদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধানটি সম্পর্কিত হাদীস-দলিলে কী বলা হয়েছে, সেটি হচ্ছে মূল বিবেচ্য।
‘হারাম’/‘না-জায়েয’-কে যে আঙ্গিকে উপস্থাপন বা পেশ করা হবে ঃ ‘মাকরূহ’ (‘অপসন্দনীয়’ তবে ‘নিষিদ্ধ নয়’)-কে সেভাবে উপস্থাপন করা যাবে না। আবার যা কিছু (মুস্তাহাব/নফল) কেবল “উত্তম’/অধিক উত্তম; কিন্তু ‘না-জায়েয’ও নয়, ‘মাকরূহ’ও নয়; তেমন বিষয়াদিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে আদৌ পেশ করা যাবে না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি শহরে-বন্দরেও এক শ্রেণীর আলেম/ইমাম/বক্তা আছেন যাঁদের নিজেদের প্রথমত উক্ত বিধানগত পার্থক্য-জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়ত আবার কিছু এমন আছেন যারা জুনিয়র হওয়াতে নতুন নতুন কিছু মাস্আলা শেখেই জ্ঞানগত ধৈর্য-সংযমতা অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সবদিক না বুঝে, সার্বিক বিবেচনা না করেই, ওয়াযের মাঝখানে ভারসাম্যহীন ভঙ্গিতে তেমন কোন মাস্আলা বলে ফিতনা বা দ্ব›েদ্বর সূত্রপাত করে বসেন; যা ঠিক নয়।
ইমাম মুহাম্মদ (র.) এর ‘কিতাবুল আস্ল’ তথা ‘আল-মাবসূত’( খ. ১, পৃ. ১২০, দারু ইবন হাযাম,বায়রুত, লেবাবন,সংস্করণ-২০১২ খ্রি ;যা হানাফী মাযহাবের মূল ছয় কিতাবের অন্যতম প্রধান কিতাব) গ্রন্থেও বলা হয়েছে ,“হাদিয়া বা সম্মানী হিসাবে দেয়া যাবে এবং সেটাই উত্তম”। যেমনÑ
“আমি বললাম:আপনি কি ইমাম ও মুয়াযযেন এর জন্য নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আযান দেয়া ও ইমামতি করা মাকরূহ মনে করেন?তিনি বললেন:হ্যাঁ, আমি তাদের জন্য তেমনটি মাকরূহ মনে করি;এবং মুসুল্লিদের জন্যও তাদেরকে তা পারিশ্রমিক হিসাবে প্রদান করা সমীচীন নয়। আমি বললাম:যদি তিনি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক গ্রহণ করে আযান দেন ও ইমামতি করেন ? তিনি বললেন: তাদের জন্য (নামায-জামাত) জায়েয হয়ে যাবে। আমি বললাম: যদি তিনি নির্দিষ্ট কিছুর শর্ত না করেন ; তবে তারা তাঁর প্রয়োজন বুঝতে পেরে তাঁর জন্য বাৎসরিক (বা মাসিকÑএকই সূত্রে হাফেযদের) কিছু সংগ্রহ করে তা তাঁকে প্রদান করেন; সেক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন: এটাই উত্তম”। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন