সম্প্রতি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর পক্ষে অভিযান চালানোর একটি প্রস্তাব র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর পক্ষ থেকে দেয়া হয়। র্যাবের মহাপরিচালকের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবের বিভিন্ন অভিযান দেশের সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। খাদ্যদ্রব্য ভেজাল, ভেজাল ওষুধ ও কসমেটিকস, ভুয়া ডাক্তার, লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, অবৈধ ব্লাড ব্যাংক, অবৈধভাবে বন্য প্রাণী ক্রয়বিক্রয়-সংক্রান্ত অপরাধসহ মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর তফসিলভুক্ত অন্যান্য আইনে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে। মূল্য সংযোজন কর আইনকে মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯-এর তফসিলভুক্ত করা হলে কাস্টমস ও ভ্যাট দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ভ্যাট ফাঁকির বিরেুদ্ধে আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এতে ব্যবসায়ী সমাজ সরকারের রাজস্ব আদায়ে তাদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হবে এবং সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও অর্জিত হবে। এনবিআর-এ র্যাবের পক্ষ থেকে ভ্যাট আদায় নিয়ে দেয়া এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ব্যবসায়ী মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কেউ কেউ এ প্রস্তাবকে ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন আতঙ্ক হিসেবে গণ্য করছেন। তারা বলেছেন, র্যাব কেন এই অভিযান পরিচালনা করবে তা বোধগম্য নয়। এ কাজের জন্য এনবিআরের নির্দিষ্ট লোক আছে, যারা এ কাজে অভিজ্ঞ। যার কাজ তাকে দিয়ে করাতে হবে। ব্যবসায়ীরা একে নতুন উপদ্রব ও হয়রানিমূলক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অর্থমন্ত্রীও র্যাবের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এর বিরুদ্ধে এনবিআরকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দেন। অবশেষে এনবিআর প্রচলিত পদ্ধতিতেই ভ্যাট আদায় করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ভ্যাট আদায়ে র্যাব-এর এই অতি উৎসাহ কেন? এ ধরনের চিন্তা তার আসে কি করে? এটা কি এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থ মস্তিষ্কের চিন্তা নয়?
দেশে এখন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও অস্থিতিশীলতা নেই। এই পরিস্থিতিতেও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে খরা চলছে। কাক্সিক্ষত নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহী করা যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন আশ্বাস ও নিশ্চয়তার কথা বলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, আমরা ব্যবসা করতে আসিনি, ব্যবসার পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে কাজ করে যাচ্ছি। একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টিসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করার কাজ করে চলেছেন। তারপরও বিনিয়োগকারীদের আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। তাদের দ্বিধা ও শঙ্কা পুরোপুরি দূরীভূত হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প-কারখানা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নানা সংকটে ধুকছেন। ব্যবসার মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় র্যাবের ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব তাদের আতঙ্কিত করে তোলে। ভ্যাট দেয়া নিয়ে নয়, বরং বন্দুক কাঁধে নিয়ে র্যাবের উপস্থিতি এবং হয়রানির অশঙ্কাই তাদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বলাবাহুল্য, র্যাবের কর্মকা- সম্পর্কে তারা ভালোভাবে ওয়াকিবহাল। কখন কাকে হয়রানির মধ্যে পড়তে হবে, এ নিয়ে শঙ্কা জাগা অমূলক নয়। এ ধরনের শঙ্কা নিয়ে কারও পক্ষেই স্বস্তিতে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। যথার্থ কারণেই ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ের অভিজ্ঞতা এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। সে সময় একে-ওকে গ্রেফতারের মাধ্যমে যে ভীতি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক কর্মকা- ও বিনিয়োগের ধারা স্থবির হয়ে পড়েছিল। অনেকে বিনিয়োগ না করে অর্থ বিদেশে পাচার করে দেয়। র্যাবের ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাবে সে ধরনের আতঙ্ক কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। তারা ভাল করেই জানেন, র্যাব যখন-তখন ভ্যাট আদায়ের জন্য হাজির হয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘিœত করতে পারে। সঙ্গত কারণেই র্যাবের এই প্রস্তাবে তারা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন। যেখানে ভ্যাট আদায়ের জন্য এনবিআর-এর মতো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এবং তার অঞ্চলভিত্তিক কার্যালয় রয়েছে, সেখানে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া এনবিআর ভ্যাট ও কর দেয়াকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছরই আয়কর মেলার আয়োজনসহ শ্রেষ্ঠ আয়কর দাতাদের পুরস্কৃত করে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এলাকাভিত্তিক কর্মকর্তাদের ভ্যাট আদায়ের মেয়াদভিত্তিক টার্গেটও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এসব কার্যক্রমের মধ্যে যদি র্যাব-এর অন্তর্ভুক্তি ঘটতো তবে তা এনবিআর-এর ব্যর্থতাই স্পষ্ট হতো। প্রশ্ন উঠতো, এত লোকবল নিয়ে তাহলে এনবিআর কি করে? অন্যদিকে র্যাবের প্রস্তাব অযাচিত, অনাকাক্সিক্ষত এবং শোভনীয় নয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক রাখার ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করাই তার কাজ। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের কাজ করার বাসনা কেন জাগল, তাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সংস্থাটির বোঝা উচিত, ভেজালবিরোধী কাজ আর ভ্যাট আদায়ের কাজ এক নয়। ভ্যাট আদায়ের কাজ একটি নিরন্তর ও নিয়মিত প্রক্রিয়া। সার্বক্ষণিকভাবে এ কাজে তদারকি করতে হয়। হুট করে হাজির হয়ে আদায় করা বা বাধ্য করা আতঙ্ক সৃষ্টিরই শামিল। ফলে র্যাবের যেচে ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব দেয়া ও কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ জবরদস্তিমূলক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে বলেই ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ করেছেন।
ভ্যাট আদায় নিয়ে আতঙ্ক ও ভয়-ভীতি সৃষ্টি হয় এবং ব্যবসার পরিবেশ বিঘিœত হয়, এমন কোনো প্রস্তাব কখনোই কাম্য হতে পারে না। যেখানে ব্যবসার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ বজায় রেখে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ ও প্রণোদনা দেয়ার কাজ বেশি করা দরকার, সেখানে বন্দুক দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অপ্রত্যাশিত ও অনভিপ্রেত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করা নয়। র্যাবের ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাব কোনো বিবেচনাতেই স্বাভাবিক চিন্তাপ্রসূত নয়। আমরা মনে করি, নিয়মিত ভ্যাট ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের উৎসাহী করা এবং অর্থনীতিতে তাদের অবদান ও অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে আরো বেশি কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। ভ্যাট ও কর ফাঁকির প্রবণতা যেমন অনৈতিক, তেমনি এসব আদায় করতে গিয়ে জোরজবরদস্তি করাও ন্যায়-নীতির পরিপন্থী। আমরা অর্থমন্ত্রী ও এনবিআর এর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই, তারা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের বিষয়টি যথাসময়ে উপলব্ধি করে র্যাব-এর অতি উৎসাহী প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন