সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কথায়- অধস্তন আদালতে বিচারসহায়ক সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলোতে এখনো স্বচ্ছতা আসেনি
অস্তিত্বহীন আদালতের কথিত ওয়ারেন্টে জেল খাটছেন নিরীহ মানুষ। ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানায় নাস্তানাবুদ হচ্ছেন আদালত-পুলিশ এবং কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আসল ওয়ারেন্টের মতোই অবিকল এসব ওয়ারেন্ট ‘ভুয়া’ প্রমাণিত হচ্ছে হেনস্তা হওয়ার অনেক পর। তত দিনে নিরীহ মানুষের অকারণ কারাবাস প্রলম্বিত হয়।
আদালত সূত্র জানায়, ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতার এবং কারাবাসের ঘটনা অহরহই ঘটছে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেনের মতে, ভুয়া ওয়ারেন্টের ঘটনা দুঃখজনক। আমাদের এখানে যেহেতু সেরকম মেকানিজম ডেভেলপ করেনি তাই থানা-পুলিশের উচিত গ্রেফতারি পরোয়ানা পেয়ে সন্দেহ হলে সেটি সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে নিশ্চিত হওয়া।
অনুসন্ধানের তথ্য মতে, কখনো ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালত, কখনো চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা জজ কখনো বা রাজশাহী দায়রা জেলা জজ আদালত থেকে আসছে ওয়ারেন্টগুলো। আসামির নাম-ঠিকানা, পরিচয় সব ঠিকঠাক। থানা পুলিশও ঝাঁপিয়ে পড়ছে ‘ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি’ পাকড়াওয়ে। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আসামিকে পুরছে থানাহাজতে।
তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই বুঝে উঠতে না পারা কথিত আসামি প্রথমে টাকা-পয়সা দিয়ে থানা থেকেই মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন একই আসামিকে পাকড়াওয়ের জন্য বিভিন্ন আদালত থেকে একাধিক ওয়ারেন্ট আসতে থাকে তখন আর তাকে ছেড়ে দেয়ার সাহস দেখায় না পুলিশও। অগত্যা আদালত হয়ে যেতে হয় কারাগারে। কিন্তু বিপত্তি বাধে তখনই যখন কথিত ওই আসামির স্বজন আদালতে তার জামিন প্রার্থনা করেন।
আদালতের রেকর্ড রুম তন্ন তন্ন করেও মেলে না আসামির সংশ্লিষ্ট মামলার কোনো নথি। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বেঞ্চ সহকারী নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রায়ই ভুয়া ওয়ারেন্ট নিয়ে আমাদের নাস্তানাবুদ হতে হয়। অস্তিত্বহীন মামলার নথি খুঁজতে খুঁজতে আমরা হয়রান। সাঙ্ঘাতিক বিপদে পড়ি তখন। দীর্ঘদিন ধরে চলার এই অবস্থার একটি স্থায়ী সমাধান দরকার।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সি.আর মামলা নং-৭৪/১৭, ধারা- ১১(গ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০। স্মারক নং-৩৮৫/১৭। আসামি মো: সাইফুর রহমান (শফি) পিতা মৃত- ফজলুর রহমান, সাং-বারান্দী মোল্লাপাড়া, কোতোয়ালি, যশোর। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং ৪’ সিলমোহর দেয়া কথিত এ ‘গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট’ যশোর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যায় ১৪/০৫/২০১৯ ইং তারিখে। পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে যশোর কোতোয়ালি থানা পুলিশের কাছে এলে এএসআই জসিম সিকদার মো. সাইফুর রহমান ওরফে শফিকে গ্রেফতার করেন। তাকে যশোর কারাগারের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারে পাঠানো হয়।
এ ছাড়া একই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম থেকে আসা কথিত একটি ওয়ারেন্ট রিসিভ করে যশোর পুলিশ সুপার কার্যালয়। এটিতে মামলা নং-৬০৫/১৭, ধারা-৪২০/৪০৬/৪০৭/১০৯, তারিখ-২২/০৬/১৭, স্মারক নং-১৬৪/১৭। পুলিশ সুপার কার্যালয় ওয়ারেন্টটি হাতে পায় ০৮/০৫/১৯ তারিখ। এটির পেছনে রয়েছে তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম, ‘আব্দুল কাদের’-এর স্বাক্ষর।
তার স্বজন জামিনের জন্য ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ নথি ওঠাতে দেন। পরে তারা নিশ্চিত হন যে, সাইফুর রহমানের নামে আদৌ কোনো মামলা নেই। ভুয়া ওয়ারেন্টে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিনা অপরাধে সাইফুর রহমানকে কারাভোগ করতে হয় ২ সপ্তাহ।
একই আদালতের সিলমোহর অঙ্কিত আরেকটি ‘গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট’-এর বিপরীতে গ্রেফতার করা হয় যশোর কোতোয়ালি থানা বারান্দী মোল্লাপাড়ার অহেদুজ্জামানের ছেলে জুয়েল সরদারকে। কথিত ওয়ারেন্টটিতে ২৭/০৫/২০১৯ ইং তারিখে কোর্ট পরিদর্শকের স্বাক্ষর রয়েছে। জুয়েল মোল্লাও দুই সপ্তাহ জেল খাটেন। জামিন নিতে গিয়ে দেখেন তার নামেও কোনো মামলা নেই।
সূত্রাপুর থানা, মামলা নং-৯৮/১৬, তারিখ-১৩/১০/২০১৬ ইং, ধারা-৩০৪/৩০৭ উল্লেখিত চিফ মেট্রোপলিটন আদালত-১৯, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট মো. সামসুল হকের স্বাক্ষর-সিলমোহর সংবলিত একটি ‘গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট’। এটির বিপরীতে গ্রেফতার করা হয় যশোর বাঘারপাড়া থানার দরাজহাট গ্রামের পাচু শেখের ছেলে মান্নান শেখ এবং তার ছেলে মো. শাহিনকে।
ঢাকা থেকে পাঠানো ওয়ারেন্টটি যশোর পুলিশ সুপার কার্যালয় গ্রহণ করে ০৩/০৭/২০১৭ তারিখে। বাঘারপাড়া থানা পুলিশ ওয়ারেন্ট তামিল করেন। যশোর এসপি’র কার্যালয়ের মাধ্যমে মো. শাহিন শেখের নামে আরেকটি ‘গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট’ আসে রাজশাহী দায়রা জজ আদালতের ‘হুমায়ুন কাদের’-এর স্বাক্ষরে। এটির মামলা নং-৭৪/১৪, তারিখ-১৭/০৮/২০১৪ ইং, ধারা ১৯(ক), অস্ত্র আইন। এটিও তামিল করে বাঘারপাড়া থানা পুলিশ।
সিআর মামলা নং-৬৮৫/১২ এর একটি ওয়ারেন্টের বিপরীতে গত বছর ৩ জুন রাজধানীর নূরের চালা থেকে গ্রেফতার করা হয় রাজধানী বাড্ডার বাসিন্দা জনি চৌধুরীকে। ওয়ারেন্টে যশোরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪২০ ধারার মামলায় ওয়ারেন্টে তার ‘২ বছরের সাজাপ্রাপ্ত’ বলে উল্লেখ করা হয়। জনিকে গ্রেফতার করে ভাটারা থানা পুলিশ। প্রথম তার ঠাঁই হয় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে। পরে তাকে যশোর কারাগারে চালান করা হয়। ওই বছর ৯ আগস্ট সংশ্লিষ্ট আদালতে তার জামিন হয়। তিনি জনি চৌধুরীর মুক্তি আটকে দেন। তাকে আবার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে চালান করা হয়। এখানেও তার মুক্তি মেলেনি।
গত বছর ৫ জুলাই ইস্যু করা ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন আদালত-৯ এর কথিত একটি প্রোডাকশন ওয়ারেন্টের বিপরীতে তাকে আটকে রাখেন কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার। কথিত এ ওয়ারেন্টে মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া ১০৭/১৬, ধারা-দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৬/১০৯ উল্লেখ করে ১২ অক্টোবর হাজির করার নির্দেশনা দেয়া হয়। তার স্বজনরা জামিনের উদ্যোগ নিলে দেখা যায়, জনি চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা- ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন আদালত-৯’ নামে কোনো আদালতের অস্তিত্ব নেই। এটি নিশ্চিত হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম তৃতীয় যুগ্ম জেলা জজ আদালত, আব্দুল কাদের স্বাক্ষরিত কথিত একটি প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট (সিআর মামলা নং-৬৮৫/১৭, ধারা-দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০, কোতোয়ালি থানা) দিয়ে তাকে আটকে দেয়া হয়। পিডব্লিউতে উল্লেখিত এ মামলায় জনি চৌধুরীকে ওই বছর ২৮ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করা হয়। পরপর কয়েকটি প্রোডাকশন ওয়ারেন্টে জনি চৌধুরী সেই যাত্রায় টানা আড়াই মাস কারাবাস করেন। কে বা কারা কী উদ্দেশ্যে ভুয়া ওয়ারেন্ট পাঠাচ্ছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো নির্দিষ্ট করতে পারেনি।
তবে আবারো ভুয়া ওয়ারেন্টের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে ভুক্তভোগী জনি চৌধুরী গতকাল (শনিবার) এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার মা নেই। মামার বাড়ি থেকে কিছু সম্পত্তি পাবো। আমাকে মামলায় জেলে ঢুকিয়ে সেই সম্পত্তি গ্রাস করার লক্ষ্যে আমার নামে ভুয়া ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়। কে এসব করছে সেটি আমি নিশ্চিত। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারছি না। তবে আশঙ্কা করছি আমি আবারো ভুয়া ওয়ারেন্টের শিকার হতে পারি।
ভুয়া ওয়ারেন্টে কারাবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে যশোরের সাইফুর রহমান শফি বলেন, কি আর বলব দুঃখের কথা ! আমার আপন ছোট ভাই শরীফুল ইসলাম নিজেই ওয়ারেন্ট জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। উদ্দেশ্য, আমাকে জব্দ করা। কারণ, শরীফুল একজন পেশাদার জালিয়াত। এর আগে সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় মামলা করে। শরীফুল জেল খাটে ওই মামলায়। তবুও তার শিক্ষা হয়নি।
এদিকে আদালতে দাখিলকৃত নালিশী মামলায় (সি.আর মামলা) এ রকম ভুয়া ওয়ারেন্ট হতে পারে বলে জানিয়েছেন অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ময়মনসিংহ) মো. মতিউর রহমান। গতকাল শনিবার তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ব্যক্তিস্বার্থে শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একজন অন্যের বিরুদ্ধে ভুয়া ওয়ারেন্ট পাঠাতে পারে। যথাযথ সিল-স্বাক্ষর থাকলে থানা পুলিশের পক্ষে ওয়ারেন্টের সত্যাসত্য যাচাই করার সুযোগ থাকে না। সেটি তখন তামিল করতেই হয়। তবে আমার কাছে ভুয়া ওয়ারেন্টের মামলা খুব একটা আসে না।
ভুয়া ওয়ারেন্ট এবং নিরপরাধ মানুষের কারাবাস সম্পর্কে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, অধস্তন আদালতে বিচার-সহায়ক সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াগুলোতে এখনো স্বচ্ছতা আসেনি। অটোমেশন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে নিরপরাধ মানুষ এ ধরনের হয়রানি থেকে রেহাই পেতেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন