বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

লোহার খনি আবিষ্কার আনন্দের বিষয়

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় দেশের প্রথম লোহার খনির সন্ধান মিলেছে। উপজেলার ইসবপুর গ্রামে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) এ খনির সন্ধান পেয়েছে। জিএসবি জানিয়েছে, খনিটিতে উন্নতমানের লোহার আকরিক (ম্যাগনেটাইট) রয়েছে।

ইতোপূর্বে সমুদ্র জয়ের পর মহাকাশে নতুন ঠিকানা স্থাপনসহ নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনায় সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। যা ছিলো দেশ ও জাতির জন্য এক অসামান্য সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্যাটেলাটের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি গৌরবের এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বাঙ্গনে দেশের ভাবমর্যাদাও উজ্জ্বলতর হয়েছে সফল মহাকাশ ও সমুদ্র জয়ের ওই মিশনের মাধ্যমে।

দেশের প্রথম লোহার খনির আবিস্কারের আনন্দের খবরে, লোহার খনির সন্ধানে নিয়োজিত বাংলাদেশ ভূতাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি দেশেবাসীর পক্ষ থেকে অভিনন্দন! লোহার খনি উত্তোলনে আমরা সফল হলে আরেকটি ইতিহাস ও স্বপ্ন সত্যি হবে! মহাকাশের পর এবার ভ‚-গর্ভের সহস্র ফুট গভীরের পাতাল জয়ের ‘মহাকাব্য’ লেখার পালা শুরু হবে। প্রথম লোহার খনি উত্তোলন, অবলোকনও হবে গোটা জাতির জীবনে এক অনন্য উচ্চতা ও বহুল প্রতীক্ষিত গৌরবের অনুভ‚তি।

দীর্ঘ দুই মাস ধরে ক‚প খনন করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর গত ১৮ জুন এ তথ্য জানান জিএসবির সংশ্লিষ্টরা। লোহার পাশাপাশি খনিটিতে মূল্যবান কপার, নিকেল ও ক্রোমিয়ামেরও উপস্থিতি রয়েছে বলেও জানা যায়। গত ২৬ মে জিএসবির মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান চৌধুরীসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা ইসবপুর পরিদর্শন করেন। লোহার খনি আবিষ্কার হতে চলেছে, এমন ইঙ্গিত ওই সময়ই মিলেছিল। জিএসবির কর্মকর্তারা জানান, ভ‚গর্ভের ১ হাজার ৩০০ ফুট থেকে ১ হাজার ৬৫০ ফুটের মধ্যে লোহার একটি স্তর পাওয়া গেছে। খনিটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার। খনিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন লোহাসহ অন্যান্য মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। হাকিমপুর উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইসবপুর গ্রাম। এই গ্রামের ৫০ শতক জমিতে খনিজ পদার্থের সন্ধানে ক‚প খনন করেছে ভ‚তাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তর।

খননকাজে নিয়োজিত জিএসবির সংশ্লিষ্টরা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে লোহার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর অধিকাংশে লোহার গুণগত মান ৫০ শতাংশের নিচে। তবে এ খনিতে লোহার মান ৬০ শতাংশের ওপরে। জয়পুরহাট ও ঢাকায় জিএসবির পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এর আগে ভ‚তাত্তি¡ক জরিপ অধিদপ্তর ২০১৩ সালে একই এলাকার মুশিদপুরে ক‚প খনন করে খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছিল। সেই গবেষণার সূত্রধরে ৬ বছর পর চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল থেকে ইসবপুরে ক‚প খনন শুরু হয়। দিনাজপুরে লোহার খনির পাশে নতুন করে দীঘিপাড়া কয়লাখনির কাজও চলছে। এসব খনি থেকে পুরোদমে উত্তোলন শুরু হলে উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষদের জীবনমান পাল্টে যাবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার মানুষদের।

আকরিক লোহা বা ‘আয়রন ওর’ সাধারণত ওপেনকাস্ট মাইন (যে মাইন উপরের মাটি সরিয়ে গঠিত) থেকে আহরিত হয়। আন্ডার গ্রাউন্ড মাইন, যা ১৬০০ ফিট গভীর হবে, তেমন মাইন থেকে আকরিক লোহা উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে ‘ভাইয়্যাবল’ হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশ্ববাজারে লোহা ও স্টিল ইন্ডাস্ট্রির কঠিন সময় যাচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে ওভার প্রোডাকশনে কতিপয় সমস্যারও বিষয় রয়েছে। কাজেই পূর্ণ সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। এ ধরনের সংবাদে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করা আবশ্যক। যাই হোক আমরা আশাহত না হয়ে আশাবাদী হতে চাই। আশাবাদী না হয়ে ভবিষ্যত আনন্দপূর্ণের প্রত্যাশা করা যায় না। একথা ঠিক যে, কাজটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ফেলে রাখা যাবে না। জিএসবি সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে গভীরতার লোহার খনি লাভজনক হবে কিনা? আর যে পদ্ধতিতে ১৩০০ থেকে ১৬৫০ ফিটে অবস্থিত স্তর থেকে ‘আয়রন ওর’ তোলা সঠিক ও নিরাপদ হবে সেটিই করতে হবে। এর থেকে অধিক ভ‚-গভীর থেকেও লৌহ খনিজ তোলার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন, বর্তমানে সুইডেনে কিরুনা আন্ডারগ্রাউন্ড আয়রন ওর মাইনে ২০০০ মিটার নীচ থেকেও সর্বাত্যাধুনিক উপায়ে লৌহ খনিজ তোলা হচ্ছে।

বর্তমানে এমনিতেই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে চলেছে। নতুন খনি আবিষ্কারকে বড় চ্যালেঞ্জের সাথে সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি অবলম্বন করতে হবে। অতীতে ফুলবাড়ি কয়লাখনি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে চালু করার আয়োজনের পরে আন্দোলনে তা বাতিল হয়েছিল। বাংলাদেশের মত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের জন্য ওপেনকাস্ট মাইন বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি খনন দেশের জন্য পরিবেশ বিপর্যয় কারণ হবে কিনা ভাবতে হবে।

২০০৫ সালে নাইকোর গ্যাস কুপ খননে অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে পরপর দুই দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দেশের গ্যাস সম্পদ ও গ্যাসফিল্ড এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরে সরকার আর্ন্তজাতিক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করে। বর্তমানে আর্ন্তজাতিক আদালতে মামলাটি বিচারধীন রয়েছে। টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ড অগ্নিকান্ডের ১৫ বছর পরও সুনামগঞ্জের ওই এলাকায় নারী পুরুষ ও শিশুরা এখনো মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। স্থানীয়রা আর্সেনিক দূষণ, অকাল গর্ভপাত, চোখে কম দেখা, চর্মরোগসহ নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত গ্যাসফিল্ড এলাকার টেংরা, গ্রিসনগর, আজমপুর, টিলাগাঁও ও আলীপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। টিউবওয়েলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের জন্য আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া বর্তমানেও ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে।

গতানুগতিকভাবে নতুন সব খনিকেই খুব উন্নত, খুব ভালো বলা হয়! পরবর্তীতে জটিল ও দুর্বোদ্ধ কোন চুক্তিতে বিদেশী কোম্পানি কাজ পায়। আর বিদেশী কোম্পানি তখন খনিজ সম্পদের মান ও লাভ-লছ নিয়ে নানা তালবাহানা করে থাকে। এসব দিকগুলোর বিশেষ প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

দেশের প্রকৃতিক সম্পদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ আর গবেষণার অভাবেই অপার সম্ভাবনার সব সম্পদ উত্তোলিত হচ্ছে না। খেয়াল রাখতে হবে এটা যেন টেংরাটিলা গ্যাস খনির মত না হয়। সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি-অপচয় ও অস্বচ্ছতার দরজা খোলা থাকা কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সেক্টরে বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত আছে।

সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে কেনাকাটা নিয়ে যা ঘটেছে, তা অকল্পনীয় সমুদ্রচুরির ঘটনা! রূপপুর গ্রিনসিটি প্রকল্পের কেনাকাটায় যে দুর্নীতির চিত্র বেড়িয়ে এসেছে, তাতো রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। প্রকল্পের প্রারম্ভেই অতি সাধারণ কেনা-কাটায় এতো বেশি দুর্নীতি চিত্র যে, কেনাকাটার তালিকাটির প্রতি কারো নজর পড়লে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছেন। রূপপুরে ‘বালিশ-কেটলির’ উপাখ্যান পুরো প্রকল্পে সম্ভাব্য অনিয়মকে ‘হিমশৈলের চ‚ড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন? আমাদের নৈতিক চরিত্রের এতটাই অবক্ষয় হয়েছে, দুর্নীতিতে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা অন্ধ হয়ে গেছেন! তারা রাতকে দিন বানাচ্ছেন আর দিনকে রাত! না হলে একটি বালিশ কিনতে তাদের ৬ হাজার টাকা খরচ করতে হবে! যে যেখানে পারছে লুটে নিচ্ছে। সবাই ধরে নিয়েছে সরকারি তহবিল তছরুপ করলে কিছু হয় না। আগেও কিছু হয়নি। এখনো কিছু হবে না।

অতীতেও বাংলাদেশে দুর্নীতির যে সামগ্রিক চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা এক কথায় ভয়াবহ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান এবং একমাত্র অন্তরায় দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সরকারি ‘সু-শিক্ষিত’ প্রশাসন। অশিক্ষিত লোকের চেয়ে শিক্ষিত লোকেরাই দেশের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করছে! রূপপুর তার একটা উদাহরণ মাত্র! এ সমাজ একজন পেটের দায়ে চোরকে যতটা অবজ্ঞা করে, তার কিছুমাত্রও যদি এই ‘শিক্ষিত’ চোরদের করত, তবে দেশে চুরি-চামারি অনেক কমে আসত!

দেশের প্রথম লোহার খনির আবিষ্কার বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়। এর যথাযথ উৎঘাটন যদি না করা যায়, তাহলে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। লোহার খনি আবিস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের বিশাল কর্মযজ্ঞে মেধা, নিরলস পরিশ্রম ও কারিগরি সহায়তাসহ যাদের নির্দেশনায় সফল একটা পর্যায় আসা সম্ভব হয়েছে; সেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী, পরামর্শক ও সংশ্লিষ্টজনরা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।

লেখক: প্রবান্ধিক, কলামিস্ট

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন