পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) মো. মিজানুর রহমানসহ পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার সংস্থার পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ বাদী হয়ে ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মিজানুর রহমানের স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্মা, ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান স্বপন এবং মিজানের ভাগ্নে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসান। মামলায় তাদেরকে সম্পদ গোপনে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা দায়েরের পরপরই তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক।
এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬(২) এবং ২৭(১) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। ধারাটি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত। সেই সঙ্গে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২) ধারাও যুক্ত করা হয়েছে। এজাহারে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া ৩ কোটি ৭ লাখ ৫ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং পাচার, স্থানান্তর ও রূপান্তরের অভিযোগ আনা হয়েছে। অনুসন্ধানে মিজানুর রহমানের মোট সম্পদ মিলেছে ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৭৪ হাজার ৪৩৩ টাকার। উল্লেখ্য, সম্প্রতি দুদক বিধিমালা-২০০৭ এর ‘অধিকতর সংশোধনী’ আনা হয়। এ সংশোধনীর ফলে সংস্থাটিকে আর থানায় হাজির হয়ে মামলা দায়ের করতে হবে না। মিজানুর রহমান ও তার পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি দুদকের নিজ কার্যালয়ে দায়ের হওয়া প্রথম মামলা (নং-১)। কমিশন মামলা অনুমোদনের পাশাপাশি তদন্তের জন্য পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিমও গঠন করা হয়। উপ-পরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিক ও নেয়ামুল আহসান গাজী এ টিমের অপর দুই সদস্য। তদন্তটি তত্ত্বাবধান করবেন দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান।
এ দিকে দুদক সূত্র জানায়, নারী কেলেঙ্কারি, দুদক পরিচালককে ঘুষ প্রদানসহ নানা ঘটনার জন্মদাতা আলোচিত ডিআইজি মিজানকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে ইমিগ্রেশন পুলিশকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দফতরে ডিআইজি হিসেবে বহাল মিজানুর রহমানকে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত না করলে তাকে গ্রেফতার প্রক্রিয়া জটিল হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র মতে, ডিআইজি মিজান দুদকের মামলা থেকে দায়মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার ঘটনা সম্প্রতি ফাঁস হয়। এনামুল বাছির তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। এ ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ১০ জুন এনামুল বাছিরকে তথ্য পাচারের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনা স্তিমিত হতে না হতেই রোববার আরো কিছু অডিও সংলাপ ফাঁস হয় সংবাদমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, অবসর-পূর্ব ছুটি ভোগরত দুদক পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী জনৈক দয়াছের মধ্যস্থতায় ঘুষ লেনদেনের আলাপ হচ্ছে। তাতে ডিআইজি মিজানকে অর্থের বিনিময়ে দায়মুক্তি দেয়ার বিষয়ে কথাবার্তা হয়। রাজধানীর নয়াপল্টনস্থ ভিক্টোরিয়া আবাসিক হোটেলে বসে দয়াছ ও আবদুল আজিজ ভূঁইয়া ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সংলাপে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পরিচালক নাসিম আনোয়ার এবং কাজী শফিকুল আলমের প্রসঙ্গ আসে। দয়াছ ইকবাল মাহমুদের ‘কাছের লোক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে। এ সংবাদের পরপর গতকাল দায়ের করা হয় এ মামলা। পরে বিকেলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আজ (সোমবার) পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তাসহ তার পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটি দুদকে দায়েরকৃত প্রথম মামলা। এতে আসামির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মিজানকে গ্রেফতার করা হবে কি না- জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আইন অনুযায়ী মামলার পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গ্রেফতারের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের এখতিয়ারভুক্ত। মিজানের পক্ষে তদবিরকারী যুক্তরাজ্য প্রবাসী হোটেল ব্যবসায়ী দয়াছ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক বহু আগে থেকেই বিষয়টি সতর্ক করে আসছে যে একটি প্রতারকচক্র কমিশনের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করছে। এখন কেউ যদি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পুঁজি করে আমার নাম ভাঙায়, সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ, আমি একজনকে নিয়ে তো কমিশন নয়।
ডিআইজি মিজান ও বাছিরকে দুদকে তলব
ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) মিজানুর রহমান এবং দুদকের সাময়িক বরখাস্তকৃত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক )। গতকাল সোমবার পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের টিম তাদের তলবি নোটিস পাঠায়। আগামি ১ জুলাই তাদের হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। সহকারি পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ টিমের অপর দুই সদস্য। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলাকালে ডিআইজি মিজানুর রহমান দুদকের তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন করেন-মর্মে অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হলে এনামুল বাছিরকে তথ্য পাচারের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও এনামুল বাছির বার বার দাবি করে আসছেন যে, রেকর্ডকৃত বক্তব্যগুলো কন্ঠ নকল করে বানানো।
এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজি মিজানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। প্রথমে এটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারি। তিনি ডিআইজি মিজানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির উদ্যোগ নিলে তাকে প্রেষণে অন্য সংস্থায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে। বাছির সাময়িক বরখাস্ত হলে গত ১২ জুন পরিচালক মো. মঞ্জুর মোরশেদকে দায়িত্ব দেয়া মিজানের বিষয়ে অনুসন্ধানের। অনুসন্ধান শেষে তিনি গতকাল সোমবার ডিআইজি মিজানসহ তার পরিবারের চার সদস্যের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন