জনপ্রিয় স্লোগান- উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। শুনতে মন ভরে যায়। বিশ্বাসে প্রাণ যায়! গুনতে হয় অপূরণীয় ক্ষতি, সিলেটের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের অপ্রত্যাশিত বাস্তবতায় এমন করে ভাবাতে বাধ্য হচ্ছেন সচেতন মহলকে। সিলেট ইতিহাসের করুণ এক অধ্যায়ে পড়েছে সারাদেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের মধ্য দিয়ে। রেলপথ, সড়কপথে উন্নয়নের নিত্য হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বপ্ন হবে সত্যি, সে রকম মনোবল জেগে উঠেছিল।
সিলেট-ঢাকা সড়ক ৪ লেন, কখনো ৬ লেন হয়ে যাচ্ছে। সিলেট-ঢাকা পথে রেলপথ আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে মধ্যে দূরত্ব হ্রাসসহ যাত্রী সেবার মান বাড়বে। তা স্বপ্ন নয়, জনপ্রতিনিধি তথা অভিভাবকদের ঘোষিত প্রতিশ্রুতিতে তারা দিন গুনে পার করছে, এই তো আর মাত্র কয়টা দিন। তারপর জোড়াতালির যোগাযোগব্যবস্থা হবে অতীত ইতিহাস। আপাদমস্তক রাজনীতিক চরিত্রের অভাবেই সময়ে-অসময়ের এক অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগের ইতিহাসের কবলে এখন বিভাগীয় সিলেট। উন্নয়ন অগ্রগতির প্রতীক যেন উদ্বোধন ও নিজস্ব নাম প্লেটে সীমাবদ্ধ। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করলে নাম প্লেট লাগানো যাবে না বলেই হয়তো সেদিকে মনোযোগী থাকতে চান না। যদি থাকত, তাহলে সড়ক ও রেলপথে এমন এমন বিপর্যয় ঘটত না। প্রাণহানি হতো না সাধারণ মানুষের। মূল্যহীন হতো না তাদের দুর্ভোগ, অপূরণীয় ক্ষতির হিসাব। জবাবদিহিতার ধারে-কাছে নেই বলেই সরাইলে শাহবাজপুর সেতু ভেঙে সড়ক, বরমচালের সেতু ভেঙে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতো না সিলেটবাসীর।
রেল দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়েছে এই সেতু এখন ভাঙেনি, ভাঙাই ছিল। গত রোববার রাতে হতাহতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক জানান দিয়েছে মাত্র। সেই জানানে কেড়ে নিয়েছে ৪টি তাজা প্রাণ। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক যাত্রী। লক্কড়-ঝক্কড় ব্রিজ ও লাইন, নাট-বল্টু নেই এমন অভিযোগ দেয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষ বরাবর।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলওয়ে স্টেশনের কাছে যে সেতুটি ভেঙে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, সেই সেতুটির দুরবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। রোববার গভীর রাতে ট্রেনটির ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাহাড়ি ছড়ার মধ্যে রেল লাইনটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনার পর থেকেই সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে যোগাযোগ খাতে সিলেট বিভাগ কতটা পিছিয়ে রয়েছে, তা গত ১৯ জুন থেকে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ শাহবাজপুর সেতু ভেঙে পড়ায় কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট বিভাগ। ৬ দিন বন্ধ থাকার পর সোমবার সড়কটির শাহবাজপুর খুলে দেয়া হয়। কিন্তু সড়কপথের ক্ষতির মুখে থাকতেই স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয় উপবন ট্রেন। এ দুর্ঘটনার পর সারা দেশের সাথে ট্রেন যোগাযোগ হয়ে পড়ে বন্ধ।
সড়ক ও রেলপথের এমন দৈন্যদশায় দেশের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সিলেট বিভাগ। যে কারণে যোগাযোগ, ব্যবসা-বাডুজ্যসহ সব কিছুতে ধস নেমেছে। কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন ব্যবসায়ীরা। শিল্প ও বাডুজ্য গতিশীল করতে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক জোরদারের অংশ হিসেবে ‘সাপোর্ট টু ঢাকা (কাঁচপুর)-সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ এবং উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেন নির্মাণ’ নামে ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিমসটেক করিডোর, সার্ক করিডোরসহ আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত হবে। ভবিষ্যতে উপ-আঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য মহাসড়কের উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেনসহ চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটির বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয় ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। কিন্তু অনুমোদনের ৮ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি। প্রকল্পের কাজ শুরু হলে সড়কপথে করুণ দশার গুণগত একটা পরিবর্তন আসত পর্যটন এলাকাখ্যাত সিলেট অঞ্চলের।
অন্যদিকে, চলতি বছরের ৯ এপ্রিল আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত জরাজীর্ণ রেলপথকে ডুয়েলগেজ (ডাবল লাইন) উন্নীত করতে আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ রেলপথ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন হয়। অনুমোদনের পর জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়া যাবে মাত্র চার ঘণ্টায়। আর চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের রেলযাত্রার সময় কমবে আড়াই ঘণ্টা। ১৬ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে মূল অর্থায়ন দেবে চীন, এমনটি জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
পরিকল্পনা কমিশন আরো জানায়, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইন জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। তার ওপর আঁকাবাঁকা ট্র্যাক ও পরিচালন জটিলতার কারণে এ রুটে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলতে পারে না। যে কারণে ডুয়েলগেজের কাজ শেষ হলে এ রুটে রেলের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। ফলে ঢাকা থেকে সিলেট এবং চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পৌঁছানোর সময় আড়াই ঘণ্টা কমে যাবে।
রেল যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হবে আসামের সঙ্গেও। প্রকল্পের অধীনে ২২৫ কিলোমিটার মিটার গেজ রেলপথকে সম্প্রসারণ করে ২৩৯ কিলোমিটার ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু প্রকল্পটির অনুমোদনের আড়াই মাসের মাথায় কুলাউড়ায় স্মরণকালের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস। এমন পরিস্থিতিতে সিলেটের সড়ক ও রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দ্রুত নির্মাণকাজ শুরুর দাবি সিলেটবাসীর।
সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আপাদমস্তক রাজনীতিক নেই বলেই বক্তৃতা, স্লোগানে, ঘোষণায় কেবল উন্নয়ন বোমা। এটা সিলেটবাসীর জন্য বড় দুঃসংবাদ। এর মধ্যে উত্তরণ সম্ভব নয়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম, বাস্তবে সর্বক্ষেত্রে মুখে প্রতিরোধ, কাজে প্রতিকারমুখী আমরা। এতে করে নিয়তি হয়ে গেছে, যা শোনার নয় তা শুনতে, যা দেখার নয় তা দেখতে।
সড়ক ও রেলপথের আগাম সুরক্ষার ব্যবস্থা যারা গড়তে পারে না, তারা তো অশিক্ষিত নয়, এ দায়িত্বের শপথে সুবিধা নিচ্ছেন সর্বোচ্চ। তাহলে দুই সেতুতে কেন অসহায়ত্ব ঘিরে ধরল তাদের। কেন অপূরণীয় ক্ষতিসহ প্রাণ যাবে আমাদের। পূর্বপ্রস্তুতি কেন আগেভাগেই নেয়া হলো না। সেই দায় নেই, বিচার নেই বলেই আমরা বড়ই দুর্ভাগা।
সিলেট বিভাগীয় গণদাবি পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান আজাদ বলেন, সড়ক ও রেলপথ উন্নয়নের দাবির পর দাবি জানিয়েছি আমরা। কিন্তু কোনো কর্ণপাত করা হয়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ট্র্যাজেডি ধামাচাপা দেয়া হবে এই তো। তিনি বলেন, চলতি বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের মধ্য দিয়ে সিলেটের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ খাতে দ্রুত উন্নতির দাবি জানিয়ে বলেন, বৃহত্তর সিলেটের এমপিরা মহান সংসদে সিলেটের উন্নয়নের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে ভূমিকা রাখা খুবই জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন