এম মাফতুন আহম্মেদ
দৈনিক আজাদ থেকে দৈনিক ইনকিলাব। দুটি কিংবদন্তি বাংলা জাতীয় সংবাদপত্র। এ দুটি সংবাদপত্র গোটা দেশ এবং জাতির কাছে স্মরণীয়। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এ দুটির অবদান। ইসলামী মূল্যবোধ, বাংলাদেশি চিন্তা-চেতনার ওপর ভিত্তি করে জাতির ভাগ্যোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট কিছু কমিটমেন্ট নিয়ে জাতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই উপমহাদেশে এ দুটি বাংলা সংবাদপত্রের আগমন ঘটে। আপন মহিমায় গোটা জাতির কাছে পত্রিকা দুটি ভাস্বর হয়ে থাকবে। কালের আবর্তে দৈনিক আজাদ আজ অধুনালিপ্ত। কিন্তু তার ইতিহাস, অতীত ঐতিহ্য আজও জাতির কাছে দেদিপ্যমান। এক কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
এ দুটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠায় যারা ছিলেন প্রাণ পুরুষ তারা আজ না ফেরার দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী শান্ত, শ্যামল ঢাকার বুকে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। তারা দুজনই মহান পথিকৃত। কারো সাথে কারোর কোনো তুলনা চলে না। কারণ তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মহিমান্বিত। জাতির কাছে গৌরবান্বিত। কর্মের মাঝে আজও তারা বেঁচে আছেন। দুজনই যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম, বুজুর্গ ব্যক্তিও বটে। তারা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। একজন হলেন উপমহাদেশের মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ। অপরজন যুগ শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)।
মাওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। তিনি একজন প্রখ্যাত রাজনীতিক হিসেবে আসাম-বাংলার কোটি কোটি ভাগ্যাহত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মজলুম মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে হতভম্ব হয়েছিলেন। তাই তিনি ভাগ্যাহত মুসলমানদের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষাকল্পে রাজনীতির পাশাপাশি কলম যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর অখ- বাংলার রাজধানী কোলকাতা থেকে প্রথম দৈনিক আজাদ প্রকাশ করেন।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন একজন মুসলিম দরদি, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। এই স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা যখন বিজাতীয় সংস্কৃতির করাল গ্রাসে হাবুডুবু খাচ্ছিল, যখন গোটা দেশ-জনপদ আধিপত্যবাদ, সা¤্রাজ্যবাদের নির্মম শিকার; ঠিক কঠিন এক ক্রান্তিলগ্নে ৪ঠা জুন ১৯৮৬ সালে স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা থেকে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করেন।
নীতিগতভাবে এ দুটি সংবাদপত্রের আদর্শ ছিল অভিন্ন। চিন্তা-চেতনার মূলে ছিল উপমহাদেশের ভাগ্যাহত মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তাই দৈনিক আজাদ থেকে দৈনিক ইনকিলাব এ দুটি সংবাদপত্র বাংলা-ভাষাভাষী কোটি কোটি জনতার শিকড়ের সাথে আজও মিশে আছে।
দৈনিক আজাদ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিটি মুহূর্তে জাতির কা-ারি ভূমিকা পালন করেছে। দৈনিক ইনকিলাব একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে। দৈনিক ইনকিলাব জাতির একটি ইনস্টিটিউশন। এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাথে রয়েছে তার হৃদয়ের বন্ধন। জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই সংবাদপত্রটি অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতীয় কৃষ্টি-সভ্যতা ও তমদ্দুনকে লালন করছে। প্রচার করছে। এক মিশনারীর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ইনকিলাব এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কলম সৈনিকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
যুগের চাহিদার কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের এই পবিত্র জমিনে দৈনিক ইনকিলাবের আর্বিভাব ঘটেছিল। সেদিন তার কিছু সুনির্দিষ্ট কমিটমেন্ট ছিল। কিছু চিন্তা-চেতনা ছিল। কিছু দর্শন ছিল। জাতির ভাগ্য উন্নয়নে কিছু আশা-প্রত্যাশা ছিল। হ্যাঁ উদ্বোধনী সংখ্যায় সম্পাদকীয় কমিটমেন্টের কথা বিস্মৃতির অন্তরালে থেকেও অনেকের হয়তবা আজও মনে আছে। সেদিন লেখা ছিল, “আমরা নির্লোভ, নির্মোহ; তবে নিরপেক্ষ নই”। কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেদিন সম্পাদকীয় কলামে তুলে ধরা হয়েছিল, নিরপেক্ষ একটি আপেক্ষিক শব্দ। একজনের দৃষ্টিতে যা নিরপেক্ষ অন্যের দৃষ্টিতে পক্ষাবলম্বন। আসলে ইনকিলাব কখনই নিরপেক্ষ ছিল না। সব সময় ‘দেশ-জাতির পক্ষে’ কথা বলেছে। নির্ভয়ে সমাজগঠনে জাতির পক্ষে লিখে যাচ্ছে।
সেই শ্লোগানকে আজও বুকে ধারণ করে দৈনিক ইনকিলাব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে চলেছে। অর্থাৎ সর্বাগ্রে মা-মাটি মানুষকে বুকে ধারণ করে ইনকিলাব পরিবার আজও ক্ষুরধার কলম চালিয়ে যাচ্ছে। ইনকিলাবের যাত্রা পথ কখনও সুখময় ছিল না। পত্রিকাটি শুরু থেকে মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সংগ্রাম আজও অবিরত চলছে। ইনকিলাব তার আদর্শ থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। সরে আসেনি ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে। সরে আসেনি বলে এই নির্ভীক সংবাদপত্রটিকে বারবার শাসক মহলের কোপানলে পড়তে হয়েছে, হচ্ছে। সাংবাদিক, সম্পাদককে হামলা-মামলাসহ নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, হচ্ছে। তবুও ইনকিলাব জাতির কাছে আজও দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার কারণে আদর্শ থেকে সরে না এসে অবিচল গতিতে এগিয়ে চলেছে। জাতীর মুখপত্র হিসেবে নির্ভীকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাবের সাথে শুধু কিছু সাংবাদিক, কর্মচারী জড়িত নয়। এই পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছেন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী কোটি কোটি শুভানুধ্যায়ী। আজকে ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠালগ্নের এই দিন বাংলাদেশি চেতনার সাথে যারা বিশ্বাসী তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নানা ঘটনা, নানা ইতিহাস। স্মরণ করিয়ে দেয় যুগের আলোক বর্তিকা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর কথা। তিনি দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। গোটা জাতিকে নিয়ে চিন্তা করতেন। আলেম সমাজকে নিয়ে ভাবতেন। স্বপ্ন দেখতেন, যে কোন মূল্যে জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে। বিজাতীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তিনি ভাবতেন, মজলুমের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সংবাদপত্রের কোনো বিকল্প নেই। এক কথায় সুস্থ, সুন্দর, স্থিতিশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রের প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য। এই সংবাদপত্র ছাড়া একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই তিনি একটি মানসম্মত পত্রিকা প্রকাশের জোর তাগিদ অনুভব করছিলেন।
দৈনিক আজাদ তখন মৃত প্রায়। তিনি অনুভব করলেন, শিকড় সন্ধানী একঝাঁক সাংবাদিকের প্রয়োজন। যারা এদেশকে ভালোবাসে। এদেশের শিকড়ের সাথে যারা মিশে আছে। এক কথায় যাদের এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আজাদের সে সময়ের খ্যাতনামা সাংবাদিকদের সাথে যোগযোগ রক্ষা করতেন। এ কে এম মহিউদ্দিনের (মরহুম) নেতৃত্বে নির্ভীক এবং প্রথিত যশা একঝাঁক সৎ সাংবাদিক দৈনিক ইনকিলাবের ছাতার নিচে সমবেত হয়েছিলেন। নতুন দৈনিকটির সাংবাদিকদের উপযুক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। দৈনিক ইনকিলাব মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পাঠক তৈরিতে সমর্থ হয়েছিল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত ইনকিলাবের ছিল অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা।
দেখতে দেখতে এই জাতীয় দৈনিকটি আজ ৩১ বছরে পদার্পণ করছে। একটি সফল সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটা কম সময় নয়। তবুও ইনকিলাবের চলার পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বরং প্রতিটি মুহূর্তে কণ্ঠকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। অনেকের গাত্রদাহ হয়েছে। ইনকিলাব যা দেখেছে সততা এবং নিষ্ঠার সাথে জাতির মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কারণ ইনকিলাব ১৬ কোটি আমজনতার কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ইনকিলাবের এই অঙ্গীকার ছিল এদেশের মাটি-মানুষের কথা বলবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আপসহীন ভূমিকা পালন করবে, দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলবে, সীমান্ত রক্ষার কথা বলবে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিনাশকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বিভাজনের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানাবে। দেশ উন্নয়নে জাতিকে ইস্পাত কঠিন শপথ নেবার আহ্বান জানাবে।
ইনকিলাব তার এই অঙ্গীকার পালনে আসলে কি সমর্থ হয়েছে? প্রিয় পাঠক, আজকের এই দিনে একটু চিন্তা করে দেখুন, দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সাথে একাকার হয়ে মিশে আছে। যাদের দায়িত্ব ছিল দেশের সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ তৈরি করা। তারা তা পালনে ব্যর্থ হয়েছে; এখনও হচ্ছে। কিন্তু দৈনিক ইনকিলাব এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের না বলা কথাগুলো ইনকিলাব বলতে সমর্থ হয়েছে। জাতির কাছে ম্যাসেজ পৌঁছে দিয়েছে। এখানেই ইনকিলাবের সফলতা। সংবাদপত্র হিসেবে সার্থকতা।
সময়ের সাফ কথা। ইনকিলাব তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখুক। কারণ এই পত্রিকার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের গৌরবগাঁথা, অনেক নানা জানা অধ্যায়। তাই বলতে হয়,
“যে জাতির প্রতি অণু-পরমাণু প্লাবিত তোমার দানে
ইনকিলাব তোমার কথা শুনবে সতত সর্বকালের গানে”।
দৈনিক ইনকিলাব আগামীর প্রত্যাশায় সত্য ন্যায়ের পথে এগিয়ে চলুক। এই হোক সবার মনের প্রত্যাশা।
য় লেখক : আইনজীবী ও খুলনা থেকে প্রকাশিত আজাদ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক
ধুধফনধৎঃধশযঁষহধ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন