শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আষাঢ়ে অসহ্য তাপদাহ

ঘরে ঘরে ভাইরাস জ্বর সর্দি কাশি শ্বাসকষ্ট ডায়রিয়া ডেঙ্গু

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

‘আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর, মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর’। কবিতার সেই আষাঢ় কোথায়? ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও তো নেই। নদ-নদী-খালে খরতর স্রোতধারা থাকবে কী করে! বরং চারদিকে ধু ধু বালুচর। আষাঢ় মাস দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হতে চলেছে। এখন ভরা বর্ষাকাল। অথচ দেশজুড়ে অসহ্য তাপদাহ। পারদ ৩৫ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গতকাল মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৮ ডিগ্রি সে.। এমনকি ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৫.৫, সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও ২৯.২ ডিগ্রি সে.। বৃষ্টির ফোঁটা পড়েনি দেশের কোথাও। পূর্বাভাস মতে, আরও অন্তত তিন দিন চলতে পারে গরমের দাপট।

খটখটে রুক্ষ আবহাওয়ায় বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের মতোই কড়া সূর্যের তেজে ভ্যাপসা গরমে-ঘামে মানুষ হাঁপাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লোডশেডিংয়ের দুঃখ-কষ্ট অবর্ণনীয়। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। রাতের তাপমাত্রাও তেঁতে আছে। আকাশতলে শীতল মেঘের আনাগোনা নেই। আবহাওয়া বিভাগের বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসও মিলছে না। হঠাৎ ক্ষণিকের বৃষ্টিতে মাটিও ভিজে না। গরম আরো উসকে উঠে। এভাবেই তিন মাস যাবৎ অনাবৃষ্টি আর খরার দহনে পুড়ছে সারাদেশ। মানুষ স্বস্তির মেঘ-বৃষ্টির আশায় চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে।

ছয়টি ঋতুর হিসাবে পুরোদমে বর্ষাকাল এলেও অস্বাভাবিক গরমের কারণে দেশের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে। ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, পেটের পীড়া, ডেঙ্গু রোগে ঘরে ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষ। হাসপাতাল ক্লিনিকেও রোগীর ভিড় বেড়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নূর মোহাম্মদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, উচ্চ তাপমাত্রার প্রবণতা বিরাজ করছে উপ-মহাদেশজুড়ে। এতে করে নতুন ধরনের ভাইরাস জ্বর, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ রয়েছে। সব বয়সের মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে। জ্বর ভালো হয়ে গেলেও জ্বরের জেরে কাশি, শ্বাসকষ্ট থেকে যাচ্ছে অনেকেরই এক মাস পর্যন্ত। এ সময়ে ভ্রমণ করে এসে মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। বৈরী আবহাওয়ায় সুস্থ থাকার পরামর্শ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ সময়ে বাইরে থেকে এসে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধুলোবালি থেকে দূরে থাকা বা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘরের পরিবেশে বিশুদ্ধ পানি, শরবৎ ও পানীয় পান করতে হবে। রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর পরামর্শ দেন তিনি।

বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, আবহাওয়া-জলবায়ু ক্রমাগত এলোমেলো খেয়ালি আচরণ করছে। এর প্রভাবে বাড়ছে দুর্যোগ ও জনদুর্ভোগ। বিশ্বব্যাপী ধারাবাহিক উষ্ণায়নে ধাক্কায় বাংলাদেশেও তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। তাছাড়া গত মে মাস থেকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আবহাওয়ার ওপর ‘এল-লিনো’ (বৃষ্টিপাতের আবহ রোধক) অবস্থা বিরাজ করছে। এতে করে কমছে ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিপাত। গত মে মাসে সারাদেশে গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম হয়েছে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত ফল-ফসল, কৃষি-খামার ও জনস্বাস্থ্য। গত ১৫ জুন বর্ষার দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে আগমন করে এবং ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু গতকাল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়নি। উত্তর বঙ্গোপসাগরেও তা দুর্বল। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরে প্রচুর মেঘ-বৃষ্টিবাহী মৌসুমী নি¤œচাপ সৃষ্টি হয়নি এখনও। একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হলেও তা ক’দিন আগে কেটে গেছে। এ কারণে বৃষ্টিহীন শুষ্ক আবহাওয়ায় গরমের মাত্রা বেড়ে গেছে।

এদিকে বাংলাদেশের ‘নাতিশীতোষ্ণ’ আবহাওয়া-জলবায়ু ক্রমাগত হয়ে উঠেছে চরম ভাবাপন্ন। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনে চিরায়ত ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্যগুলো পাল্টে যাচ্ছে। পঞ্জিকার হিসাবে বর্ষায় বৃষ্টি ঝরছে কম। অথচ প্রাক-বর্ষা ও বর্ষাত্তোর ‘অসময়ে’ ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষাকাল হচ্ছে দীর্ঘায়িত। খরতাপে যেন মরুর আগুনের হলকা বয়ে যায়। অসহনীয় গরমকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অথচ শীতকালের দেখা মিলছে অল্প কিছুদিন। শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত ঋতু অতীতের মতো অনুভব করা যায়না। আলাদা করে চেনাও সম্ভব নয়।

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষকগণ বাংলাদেশের আবহাওয়া প্রাণঘাতী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠতে পারে বলেই সম্প্রতি এক গবেষণায় সতর্ক করেন। তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিরাট অংশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানেও একই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে। এমআইটির গবেষক দলনেতা অধ্যাপক এলফাতিহ এলতাহির বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ব্যাপক সংখ্যক মানুষের ওপর প্রভাব পড়ছে।

পরিবর্তন যে ধারায় চলছে তা অব্যাহত থাকলে মারাত্মক তাপদাহ পরিস্থিতি সৃষ্টির ঝুঁকি থাকবে। ভবিষ্যতে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ঝুঁকি হচ্ছে, তাপদাহ ঘনীভ‚ত হতে থাকায় গঙ্গা-পদ্মা ও সিন্ধু নদ-নদী অববাহিকায় অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোতে ১৫০ কোটি অধিবাসী ঝুঁকিতে পড়বেন। তাদের নিজেদের অঞ্চলে বসবাস অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে তাপদাহ ও বাতাসের উচ্চ আর্দ্রতার মারাত্মক মিশ্রণে ক্রমেই অরক্ষিত হয়ে উঠছে মানুষের জীবনধারণ। ফল-ফসল, কৃষি-খামারে আবাদ ও উৎপাদনে এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত এবং উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়, সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চলতি শতকের মধ্যে দেশের তাপমাত্রা গড়ে দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বিসিএএস-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ব্যাপক তারতম্য বা অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত ৩০ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত ক্রমে বেড়ে গেলেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের হার স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে গেছে। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে। এ কারণে পানি ও মাটিতে লবণাক্ততার হার বাড়ছে। লোনার আগ্রাসন হচ্ছে বিস্তৃত।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজ আখতার মল্লিক এক গবেষণায় বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ধারায় বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে শূণ্য দমমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা ভেদে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত বেড়েছে। গত ৫০ বছর সময়কালে বৃষ্টিপাত বেড়েছে প্রায় গড়ে ২৫০ মিলিমিটার। বিগত ৫০ বছরের গড় বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তন বাংলাদেশের বিশেষত খাদ্য ও কৃষিখাতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন।
আবহাওয়া-জলবায়ুর আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ এবং এর আশপাশ অঞ্চলে চলতি বছর টানা দুর্যোগের আলামত দেখা দিয়েছে। ভয়াবহ খরা, অসহনীয় তাপপ্রবাহ, অতিমাত্রায় বজ্রপাত, হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণে এলাকাওয়ারি বন্যার শঙ্কা রয়েছে। কয়েক বছর বিরতি দিয়ে এ অঞ্চলে আবহাওয়ায় ফের ‘এল নিনো’ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে করে বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
ফাল্গুনী নিঝুম ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:৫৮ এএম says : 0
দারিদ্রতা এমন জিনিস যেখানে বিশ্রাম বলে কিছুনাই একজন ৫জনের খাবার যোগার করতে হয় এঘামের টাকাই একমাত্র হালালের
Total Reply(0)
এস এম সানাউল্লাহ্ ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:৫৮ এএম says : 0
দুঃ‌খে যা‌দের জিবন ঘরা, দুঃখ তা‌দের কি‌সে ।
Total Reply(0)
Khalilur Moju ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:৫৮ এএম says : 0
আল্লহ তুমি হেফাজত কর।
Total Reply(0)
Robin Cameron ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:৫৮ এএম says : 0
ক্ষুধা ও দারিদ্র-র কাছে তাপ মলিন।
Total Reply(0)
Md Feroj Kabir ২৬ জুন, ২০১৯, ১২:৫৯ এএম says : 0
আল্লাহ তুমি তো মহান তুমি তাদেরকে সাহায্য কর।আমিন
Total Reply(0)
Morshad Alom ২৬ জুন, ২০১৯, ১:০০ এএম says : 0
দেশের তাপমাত্রা নাথিং । প্রবাসের তাপমাত্রার অর্ধেক।
Total Reply(0)
সাখাওয়াত হোসেন উজ্জ্বল ২৬ জুন, ২০১৯, ১:০২ এএম says : 0
হে আল্লাহ তুমি তাপদাহ ও রোগবালা থেকে আমাদের রক্ষা কর।
Total Reply(0)
Md Ariful Islam Raju ২৬ জুন, ২০১৯, ৯:৪০ এএম says : 0
Allah vorosa.
Total Reply(0)
Adv Junnun Ahmed ২৬ জুন, ২০১৯, ৯:৪২ এএম says : 0
Allah'r rahmate kicu e Hobe na... Allah e Valo janen ki korlay amader Valo Hobe... tai amader uchit basi basi tar ebadat kora
Total Reply(0)
Hossni Mubarak ২৬ জুন, ২০১৯, ৯:৪২ এএম says : 0
নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন