এক
শৈশবে আমি তখন সবে কয়েকদিন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। বড় জোর প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। আমার সেই স্কুল তখন ছিল চব্বিশ পরগণার পারুলিয়ার কামার পাড়ায়। নতুন স্কুল ঘর। সে সময়েই দুপুরের পরে খবর পেলাম আমার ঝিমা ইন্তেকাল করেছেন।
ঝিমার বয়স তখন শতাধিক বছরও হতে পারে। ঝিমা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা তখনও বুঝতাম না। এখনও বুঝি না। সম্পর্কগুলোর কথা আমার আব্বার মুখে শুনতাম। আর মামাও বলতেন! ওই দু’জনের কেউ আর আজ বেঁচে নেই।
আব্বা এবং মামা যখন সম্পর্কগুলোর কথা বলতেন তখন সেটা গুরুত্ব দিয়ে বুঝে নেয়ার এবং মনে রাখার বয়স তখন ছিল না। শুধু মনে আছে উনি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবের চাচী ছিলেন। পিয়ারায়।
এরপর পারুলিয়ার শেখ পাড়ায় তাঁর বিয়ে হয় মামাদের পরিবারে। মামা একবার তাঁদের বাড়ীর দেয়ালে টাঙানো ছবিও দেখিয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারি উনি খুব সুন্দরী ছিলেন। কেবল ফর্সা নয়। গায়ের রঙ যেন কিছুটা লাল। গায়ের রঙ লালচে ছিল। ও রকম গায়ের রঙের মানুষ আর দেখেছি বলে মনে হয় না।
আমাকে খুব আদর করতেন। আব্বা আমাকে মারতে গেলে বলতেন, “মারিস্ না। ও আমার শহীদুল্লাহর মতো সোনার কলম (পকেটে) গুঁজবে।”
বুঝতাম, আব্বা তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। সম্মান করতেন। মানতেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সাহেবও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। মনে রাখতেন। পাকিস্তান থেকে তিনি তাঁর এই চাচীর জন্য শাড়ী পাঠাতেন। এসব শুনতাম বাড়ীর লোকদের কাছে।
ঝিমা আমাকে একটা কাঁসার গ্লাস এবং একটা কাঁসার মালা দিয়েছিলেন। এ দুটো জিনিস আমার কাছে খুব আদরের বস্তু ছিল। ঝিমা আমাকে দিয়ে গেছেন, এ নিয়ে গর্বও হতো আমার। ওই বোধ হয় প্রথম ও শেষ গর্ব ছিল আমার। আর কখনো কিছু নিয়ে গর্ব করেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর ইন্তেকালের পরও বহু বছর ব্যবহার করেছি ওই দুটো জিনিস। ওই দুটো জিনিসের চেহারা এখনও মনে পড়ে।
দুই
আজ মনে হয় ঝিমার কথাগুলোই আমাকে জ্ঞানচর্চায় আগ্রহী করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্য বইয়ের মধ্যে আমার জ্ঞানচর্চা সীমাবদ্ধ রাখিনি। যখন ফাইভ ক্লাসে পড়ি, সেই তখন থেকেই স্কুলের পাঠাগার থেকে নানান রকম বই নিয়ে পড়তাম। ঝিমা সোনার কলম ঝেরে (পকেটে) গোঁজা বলতে বোধ হয় জ্ঞানচর্চা করে সম্মান পাওয়া বুঝিয়েছেন। আর আমি জ্ঞানচর্চা করি মানুষের সেবার প্রয়োজনে। সৎ থেকে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মানুষকে সেবা করবো, এই মনোভাব নিয়ে এখনও পড়ি এবং লিখি। শৈশব থেকে এখনও কোথাও কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হইনি বা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক হইনি।
যে কাজ কোনো রাজনৈতিক দলের তা করার কথা আমি কখনো চিন্তাও করি না। আমি যখন যে দেশে থাকি সে দেশের সংবিধান এবং আইন কানুন মেনে চলি। তবে যে বিষয়গুলো বুঝি সে বিষয়গুলোয় কী কী করা ভালো আর কী কী করা ভালো নয়, সে সব বিষয়ে আমার নিজের মতামত প্রকাশ করাটাও আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য বলেই মনে করি। আমি কখনো ক্ষমতার চর্চা করিনি। ক্ষমতার চর্চা করি না। নিজেকে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের মানুষ বলে ভাবি না। নিজেকে এভাবে কখনো ভাবিওনি।
আমি পড়া ও লেখার কাজ প্রধানত করি বাঙলা ভাষায়। তবে বাঙলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে আমি গ্রহণ করিনি। কোনো জাতীয়তাবাদকেই গ্রহণ করিনি আমি। কেননা, জাতীয়তাবাদ ধর্মভিত্তিক হোক, বর্ণ বা গায়ের রঙভিত্তিক হোক, ভাষাভিত্তিক হোক, কিংবা কোনো অঞ্চল বা আঞ্চলিকতাভিত্তিক হোক, যে কোনো জাতীয়তাবাদেরই একটা প্রতিপক্ষ ও শত্রু থাকতে হয়। বাঙলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদেরও একটা প্রতিপক্ষও শত্রু আছে। কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শুত্রু হিসাবে দেখার মানসিক যোগ্যতা আমার নেই।
তিন
আমি মুসলমান। মুসলমানদের ইতিহাস ঐতিহ্য আমার মানসিক আশ্রয়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা আমার আদর্শ। ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা আমার পছন্দের বিষয়। মুসলিম জাতিসত্তা আমার কাছে জীবনের মতো। তবু মুসলিম জাতীয়তাবাদী আমি নই। ইসলাম তৌহীদবাদ কেন্দ্রিক, আল্লাহর একত্ববাদ কেন্দ্রিক, আল্লাহর একাত্ববাদ কেন্দ্রিক। আল্লাহর ওয়াললেস কেন্দ্রিক। অতএব, মুসলিম জাতীয়তাবাদ বলে কোনো কিছু হয়ও না। তৌহীদবাদে বিশ্বাসী মুসলমানরা কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু সনাক্ত করে জাতীয়তাবাদী হতেও পরেন না। তবু দেখি এ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে কোনো কোনো কলামিস্ট মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা লেখেন। অজ্ঞতার কারণে লেখেন, না, জেনে-শুনে ইচ্ছে করে মুসলমানদেরকে অবদমিত বা হতাশ করার জন্য লেখেন তা জানি না।
চার
আমি প্রধানত কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টির বিষয়ে কাজ করি। ঐতিহাসিক পটভ‚মিকায় কয়েক খন্ডে যথাসম্ভব পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা একটা বিশাল বড় কাজ। আমার আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সে কাজ যেভাবে করা দরকার সেভাবে করতে পারি না। কাজটা ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের এই সমাজহীন মুসলমান সমাজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি।
আমি নজরুল চর্চা করি সমাজের এবং গণমানুষের প্রয়োজনে। মানুষ নজরুল আমার কাছে অত্যন্ত মহৎ, অনন্য ও বিস্ময়কর। পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। যথার্থ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন অত্যন্ত সৎ ও সহানুভ‚তিশীল মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ঔচিত্যবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। একটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর মন ছিল তাঁর।
তিনি অকৃত্রিম এবং নিখাদ সাম্যবাদী ও সহাবস্থানকামী মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো রকম জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। তাই যথার্থই সাম্য ও সহাবস্থানকামী হওয়ায় যথার্থই অসাম্প্রদায়িক কবি হতে পেরেছিলেন তিনি। এই দেশের, উপমহাদেশের এবং বিশ্বের জন্য সাম্য ও সহাবস্থানই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমি নিজেও অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ এবং মুসলমান। এই আমার পরিচয়।
নজরুলের প্রেম-প্রকৃতি বিষয়ক অনেক অসাধারণ লেখা আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী এই কবির স্বাধীনতাকামী লেখাগুলো অনন্য। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুরও খুব ভালো লাগতো এগুলো। সে কথা লিখেও গেছেন তিনি। সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতেই ইসলামী সাহিত্য ও সঙ্গীতেও নজরুলের আছে এক বিস্ময়কর অবদান। তামাম বিশ্বের মুসলিম সভ্যতাটাই উঠে এসেছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সঙ্গীতে এবং বিভিন্ন অভিভাষণে। তাঁর অভিভাষণগুলোও মহৎ ও আকর্ষণীয় সাহিত্য। ওসবই আমাদের বলে মনে হয় আমার।
নজরুল জীবন ও সৃষ্টি উপযুক্ত মর্যাদায় আমাদের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে চর্চার ব্যবস্থা হলে আমাদের সমাজের যে অবক্ষয় দেখছি তা আমাদের দেখতে হতো না। আমাদের সমাজের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা, আমাদের সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্যচর্চা, ইসলাম চর্চা, ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মেনে চলা আমাদের সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ এবং সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন।
পাঁচ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের পত্র-পত্রিকার পুরোনো ফাইল ঘেঁটে আমি দীর্ঘদিন যাবৎ আর্কাইভাল ওয়ার্ক করেছি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভ‚মিকা কীরকম ছিল সেটা দেখেছি, মুসলমানদের আশা-আকাক্সক্ষা কেমন ছিল সেটাও লক্ষ্য করেছি। পাকিস্তান আমলে এবং এই বাংলাদেশ আমলে বাঙলাভাষী মুসলমানদের যাঁরা ১৯৪৭ এর মধ্য আগস্টের আগের ও পরের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন তাঁদের কারো কারো স্মৃতিকথাও আমি পড়েছি। আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, ১৭৫৭-র ২৩ শে জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের পর সাধারণভাবে একশ নব্বই বছর যাবৎ, বিশেষভাবে অন্তত সোয়াশ’ বছর সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক সহায়ক জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে অধিকার-বঞ্চিত হয়ে থাকার কারণে ১৯৪৭-এর মধ্য আগষ্টে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গা নিয়ে (ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গা নিয়ে) সৃষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশটাকে উপযুক্ত মর্যাদায় আমরা ধারণ করতে পারিনি। এটাই বাস্তবতা।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের একশ’ নব্বই বছরের ইতিহাসটা আমাদের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে উপযুক্ত মর্যাদার পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীতও আমাদের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় উপযুক্ত মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এই ঈদ পুনর্মিলনী উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনার বন্দোবস্ত করা যায়। সমাজহীন মুসলমান সমাজটাকে ইসলামী নীতি আদর্শ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটা সুসংবদ্ধ সমাজ হিসাবে গড়ে তোলা দরকার। আমাদের বাঁচার জন্য, আমাদের সম্মানজনক অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য একটা ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত সমাজ অবশ্যই থাকা দরকার।
ছয়
জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি ছিলেন। মানুষ তাঁকে দেখতে তাঁর বাসার সামনে খুব সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই কবির জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ক চর্চা ১৯৪৭ এর মধ্য আগস্টের পর থেকে দুই জাতীয়তাবাদের চাপে পিষ্ট হয়ে আসছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ কায়েম করার আশঙ্কার চাপে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকায় মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত অচ্যুৎ হয়ে আছে এবং এই কর্মসূচীর অংশ হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এম. এ. ক্লাসের পাঠ্য তালিকায় নজরুল ও অচ্যুৎ হয়ে আছেন। কেউ কেউ মনে করেন এসব নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা এখনও আমরা অর্জন করিনি। সেটাই তো দেখা যায়।
আমাদের বাঙলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের অব্যবহিত পর থেকে শনাক্ত হয়ে আছেন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম প্রধান দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রধান মুসলিম প্রধান প্রদেশের মুসলমানরা কেবল নন, মুসলিম উম্মার ঐক্য ও সংহতি এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা। আমাদের এই বাঙলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রয়োজনে ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের এম.এ ক্লাসের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য সঙ্গীত। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন এবং বৈষ্ণব পদাবলীও অবশ্য পাঠ্য ছিল। কিন্তু নজরুল সাহিত্যও অবশ্য পাঠ্য ছিল না। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের মতো মানুষ ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের পরও এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি। এমনটা কী করে হলো সেটা নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়।
১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের বিভাজনটা ঘটনা হয়েছিল হিন্দুদের “উচ্চতর স্তরের সুবিধা ভোগ” করার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে এবং তামাম ভারতীয় উপমহাদেশের এক একটা জায়গায় এক একটা পদ্ধতিতে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত¡ কায়েম করার কাজটা অবাধ এবং মসৃণ করতে। সেই কর্মসূচীরই অংশ হিসাবে নজরুল চর্চায় এক এক জায়গায় এক একভাবে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। এ কথা যদি সত্য না হয় তাহলেও এ বিষয়ে লেখালেখি হওয়া দরকার, গবেষণা হওয়া দরকার। এগুলো কোনো গুরুত্বহীন বিষয় নয় যে, উপেক্ষা করা চলে।
অন্যদিকে ১৯৪২-এর অক্টোবরের ৯ তারিখে মানসিক আঘাতে অসুস্থ হয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বাভাবিক জীবন হারালেন। আর এই ১৯৪২-এর অক্টোবরেই প্রকাশিত হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফার নামে “বিশ্বনবী”।
এই “বিশ্বনবী” কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের নামে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কবি গোলাম মোস্তফা সাহেব তাঁর আগের বক্তব্য পুরোপুরিই পাল্টে ফেলেছিলেন। ১৭ই জুলাই ১৯৮৮ তারিখে ঢাকার বাংলা বাজারের মল্লিক ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত আমার লেখা “অজানা নজরুল” গ্রন্থে কবি গোলাম মোস্তফার নজরুল প্রশস্তি শিরোনামে একটা লেখা আছে। সেখানে এক জায়গায় গোলাম মোস্তফা সাহেব বলেছেন :
“নজরুলের আর একটি বিশিষ্ট দান- ইসলামী সঙ্গীত। আমি যখন ইসলামী গান রচনা করতাম, তখন অতি আধুনিক কোনো কোনো সাহিত্যিক বন্ধু আমাকে মিশনারী কবি বলে বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু নজরুলের প্রথম ইসলাম গান “ওমন, রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ” যখন রেকর্ডে প্রকাশিত হলো তখন বন্ধুগণ নীরব হলেন। ইসলামী ভাবধারা বজায় রেখে যে বাংলায় সঙ্গীত রচনা করা চলে, এ বিশ্বাস তখন তাঁদের এলো। সেই থেকেই ইসলামী গানের প্রচলন হলো। মুসলিম বাংলা সাহিত্যে নজরুলের এ এক অমর অবদান।
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনের জলসা অধিনায়কের অভিভাষনে কবি গোলাম মোস্তফার বিবৃতি যা একটি দুষ্প্রাপ্য তথ্য, সেটির কিয়দংশ মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীর ১২শ’ বর্ষ : ৮ম সংখ্যা : জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬ থেকে সংগ্রহ করে আমার “অজানা নজরুল” গ্রন্থে পরিবেশন করেছিলাম। কবি গোলাম মোস্তফা সাহেব তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামের আত্মীয়া এবং আসানসোলের মেয়ে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মাহফুজা খাতুনকে নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাসায় যেতেন। আত্মীয় বলেও পরিচয় দিতেন।
১৯৪২-এর অক্টোবরে “বিশ্বনবী” প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৪৭ এর ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান হওয়ার পর তাঁর এই দ্বিতীয়া স্ত্রী মাহফুজা খানমেরই সম্পাদনায় প্রকাশিত “নও বাহার” পত্রিকায় নজরুল কাব্যের অপরদিক” শীর্ষক দীর্ঘ নিবন্ধে আগের বক্তব্য বিস্মৃত হয়ে ১৯৫০ সালে তিনি লিখলেন :
“নজরুল ইসলাম ইসলামী দর্শন ছাড়িয়া বেদান্ত দর্শনকেই সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। গভীর গোপনে তিনি ইসলামের এই শরাবন তহুরার মধ্যে বিষ মিশাইয়াছেন।”
[৩৮/৩ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০, সুহৃদ প্রকাশন, নাসির হেলাল সম্পাদিত “গোলাম মোস্তফা সমগ্র : প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ২১০]
এই ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিবার কায়েদে আজম ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে চেয়েছিলেন এবং স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় চলে আসতে চেয়েছিলেন। কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের এই ধরনের মিথ্যা, নিন্দা, অপবাদ এবং কুৎসাপূর্ণ অপপ্রচারের কারণে কায়েদে আজম ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি কবি পরিবারের ঢাকায় আসাও সম্ভব হয়নি। এ সবের কোনো প্রতিবাদ নজরুল সান্নিধ্য ধন্য ব্যক্তিদেরও কেউ তখন করেননি কেন সে সব বিষয়ে ডিসেম্বর ১৯৯৮-এ ৯২, নিউ সার্কুলার রোড, সিদ্ধেশরী, ঢাকা। এই ঠিকানা স্থিতী কবি গোলাম মোস্তফা স্ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত নাসির হেলাল সাহেবের গ্রন্থ “জাতীয় জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফার পেয়েছি। যাঁরা প্রতিবাদ করতে পারতেন এমন চল্লিশজনের মতো লোককে কবি গোলাম মোস্তফা সাহেব মাঝে মাঝে দাওয়াত করে “পোলাও-বিরিয়ানী খাওয়াতেন, তাঁর রুচিশীল বৈঠকখানায় যে কোনো দিন যে কেউ গেলে শাহী নাস্তা খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতেন। অনুষ্ঠানের জন্য চাঁদা চাইতে গেলে পোলাও-বিরিয়ানী খেয়ে একশ’ টাকার দুটো নোট পাওয়ার সৌভাগ্য হতো। এছাড়া সেই পাকিস্তান আমলে তাঁর জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় শিক্ষাঙ্গনের ও সাহিত্য-সংস্কৃতির আঙিনায় যে কোনো মানুষকে অনুগ্রহ বিতরণের সমর্থ্য তাঁর ছিল। সেই ক্ষমতা বলে পাকিস্তান আমলে নজরুল চর্চায় তিনিও অবরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। করাচীতে নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। করাচীর নজরুল একাডেমীকে পাকিস্তান সরকার এক বিঘা জমিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় ঢাকায় নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। নজরুল এবং নজরুল সাহিত্যের প্রতি মিথ্যা, নিন্দা, অপবাদ এবং কুৎসা প্রচার তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকার সময়েই শুরু হয়। এসব বিষয়ে তারিখ তথ্যভিত্তিক গবেষণামূলক কাজ হওয়া দরকার। সত্য গোপন করা, সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে ফেলা কিংবা সত্য আড়াল করা কোনো মুসলমানের কাজ হতে পারেন না। এটা কোনো মানুষের কাজও হতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন