দেশে এখন কী ধরনের রাজনীতি চলছে? এ প্রশ্ন যদি কাউকে করা হয়, এর সঠিক জবাব পাওয়া মুশকিল। কেউ বলবেন দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। কেউ বলবেন দেশ এখন বিরাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে চলছে। শুধু সরকারী দল আছে, বিরোধী দল বলতে কিছু নেই। নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আক্ষরিক অর্থেই আমাদের দেশের ধারা অনুযায়ী বর্তমানে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। সাধারণত গণতান্ত্রিক রাজনীতি হয় সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে। প্রচলিত এ রাজনীতি এখন বিলুপ্ত প্রায়। সরকারি দলের একচ্ছত্র আধিপত্যে রাজনীতি একপেশে হয়ে গেছে। অক্ষরিক অর্থেই রাজার যে নীতি নিয়ে রাজনীতি তা এখন রাজা তথা সরকারি দলের রাজনীতি চলছে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন এবং নির্বাচিতদের রাজনীতি দুর্লভ হয়ে উঠেছে। জনগণ যে তার ভোট দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে রাজনীতির সূচনা করবেÑবিগত এক দশকে চিরায়ত এই ধারাটি মৃয়মাণ হয়ে পড়েছে। এজন্য ক্ষমতাসীন দলের পাওয়ার পলিটিক্স এবং মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চরম ব্যর্থতা দায়ী। রাজনীতির মাঠ খালি করে দেয়া বা খালি করে নেয়াÑএই দুই প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজনীতি হারিয়ে গেছে। এখন একজন সাধারণ মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কি ভোট দিয়েছেন? তবে তার উত্তর হচ্ছে, এখন ভোট হয় না। ভোট দিতে হয় না, এমনিতেই হয়ে যায়। এমনকি যারা সরকারি দলের ঘোর সমর্থক তাদের মধ্যেও এখন ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ দেখা যায়। অথচ সুষ্ঠু উদ্দীপনামূলক ভোট হলে নিশ্চিতভাবেই তারা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিত। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে যে ভোটের রাজনীতি এবং এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক যে প্রক্রিয়া তা হারিয়ে গেছে। কবে ফিরবে কেউ জানে না। ভোট যে হচ্ছে না তা নয়। তবে তা অভিনব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোক দেখানো ভোট। গত জাতীয় নির্বাচনে এবং তার আগের নির্বাচনে এ চিত্র দেখা গেছে। এসব নির্বাচনের আগেই মানুষ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল কে জিতবে। আগাম বলে দেয়া এই ভোটের চিত্র এবারের ৪৫৫টি উপজেলা নির্বাচনেও দেখা গেছে। গত সপ্তাহে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রেকর্ড সংখ্যক উপজেলায় বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দল না থাকায় প্রতিদ্ব›দ্বীতা হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে। ক্ষমতাসীন দল তিন শতাধিক উপজেলায় পাশ করেছে। আর স্বতন্ত্র পাশ করেছে দেড়শ’র মতো উপজেলায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় শতভাগই ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। যেখানে এসব নির্বাচনে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ ভোট পড়ে, সেখানে তা অর্ধেকেরও কম পড়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে ভোট হয় শুধু দেখানোর জন্য। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নিজেরা নিজেরাই ঠিক করে নেয় কে পাস করবে। বিষয়টি অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে, জন্মদিনে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ বলে শুভেচ্ছা জানানোর কেউ না থাকলে নিজে নিজেকে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’ বলে শুভেচ্ছা জানানোর মতো। ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে দেশে এখন চলছে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি।
দুই.
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ক্ষমতাসীন দল ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি বেশ উপভোগ করছে। এ সুযোগ দলটি নিজ যোগ্যতা এবং দক্ষতায় অর্জন করেছে। পৃথিবীতে যোগ্য এবং সবলরাই টিকে থাকে। সার্ভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট। অযোগ্যরা ঝরে পড়ে কিংবা ঝিমোতে থাকে। দেশে সবচেয়ে বড় যে বিরোধী দল আছে, তার রাজনৈতিক ভুল, সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদূরদর্শীতা এবং সুবিধাবাদীদের আধিপত্যের কারণে ক্ষমতাসীন দলকে মহাপরাক্রমশালী করে তুলেছে। এটা ক্ষমতাসীন দলের দোষ নয়। বরং রাজনীতির মধ্যে অণু-পরমাণু রাজনৈতিক কৌশলে বিরোধী দলকে হারিয়ে দিয়েছে। এটা সুষ্ঠু কি অসুষ্ঠুÑতা বিচার করা অর্থহীন। এভরিথিং ইজ লিগ্যাল ইন ওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স। এ যুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল ওভার হেলমিং ভিক্টরি পেয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দল তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক দলটির উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, দলটির যদি সেই সক্ষমতা থাকে, সাহস থাকে, আন্দোলন করে দেখাক। ১০ বছরে তো ১০ মিনিটের একটি আন্দোলন দেখাতে পারেনি। তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে যথার্থ কথাই বলেছেন। অবশ্য হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি নিরঙ্কুশ হলে এ কথা বলা কোনো ব্যাপারই না। এক সময় বৃহৎ বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা সান্ত¦না পাওয়ার জন্য বলত, হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। অনেকে হয়তো তা বিশ্বাসও করেছেন। ভেবেছেন, হাতি একদিন গর্ত থেকে উঠে দাঁড়াবে। দেখা গেল, হাতি সেই যে গর্তে পড়েছে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। গর্তেই রয়ে গেছে। দলটি ঐক্যফ্রন্ট করে বেশ তর্জন-গর্জনের মাধ্যমে গত জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভেবেছিল উঠে দাঁড়াবে। ফলাফলে দেখা গেল গর্তের আরও গভীরে চলে গেছে। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংসদে যাবে না বলে গোঁ ধরে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলকে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ বলে সংসদে যায়। এখানেও ক্ষমতাসীন দলের যে অণু-পরমাণু রাজনৈতিক কৌশল, তার কাছে দলটিকে হার মানতে হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দলটি তার নির্বাচিত ছয় সদস্যকে সংসদে পাঠিয়ে মহাসচিব যাননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, যদি সংসদেই যাবে তবে মহাসচিব গেলেন না কেন? না গিয়ে তার শূন্য আসনেই বা কেন প্রার্থী দিল? এখন এ আসন থেকে দলটির প্রার্থী জিতেছে। ধরে নেয়া যায় তাকে সংসদে পাঠানো হবে। তাহলে মহাসচিবের যেতে অসুবিধা কি ছিল? এটি কি এখন পানি ঘোলা করে খাওয়ার মতো হয়ে গেল না? ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক দলটির এ রজনীতি নিয়ে যথার্থই বলেছেন, দলটি দ্বিমুখী বা স্ববিরোধী রাজনীতি করছে। দলটির সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের কাছেও তাই ঠেকছে। এতে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল তার প্রতিদ্ব›দ্বীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারে এবং সেÑই হচ্ছে সুপ্রিম অথরিটি অ্যান্ড কন্ট্রোলার অফ পলিটিক্স। ক্ষমতাসীন দল চাইলে দেশে রাজনীতি থাকবে, না চাইলে থাকবে না। এখন সে চাচ্ছে না, দেশে কোনো বিরোধী রাজনীতি থাকুক। চাচ্ছে, হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতিই চলুক। এখানে জনগণের দরকার নেই। আমরাই জনগণ। ইতোমধ্যে দলটির নিরঙ্কুশ এই আধিপত্যে আকৃষ্ট হয়ে তার হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতিতে অনেকেই ঢুকে পড়েছেন। এখন এমন অভিযোগও করা হয়, বিরোধী দলটি যাকে সামনে রেখে ঐক্য করেছিল, সেই তিনিই নাকি ক্ষমতাসীন দলের অণু-পরমাণু কৌশলের রাজনীতিতে শামিল হয়েছিলেন। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়নি, যখন দেখা গেল সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েও সবার আগে তার দলের দু’জন সংসদে যোগ দেয়। এ থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখে মুখে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা করলেও পর্দার আড়ালে বহু আগেই তিনি হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি আঁকড়ে ধরেছিলেন। অন্যদিকে বৃহৎ বিরোধী দলটির ছয় সংসদ সদস্য যোগ দেয়ার পেছনেও নাকি ক্ষমতাসীন দলের এই রাজনীতি রয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য তো ক্ষোভের সঙ্গে বলেই ফেলেন, ছয় সংসদ সদস্য লোভী এবং লোভে পড়ে সংসদে যোগ দিয়েছে। তার এ কথা থেকে প্রতীয়মাণ হয়, ছয় সংসদ সদস্যর ওপর দলটির কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। দল না চাইলেও তারা ঠিকই সংসদে যোগ দিতেন। তারাও হ্যাপি বার্থ যে টু মি’র রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তাদের এই আকৃষ্ট হয়ে পড়া থেকেই প্রতীয়মাণ হয়, তারাও দুর্বলের সঙ্গে থাকতে চায় না, সবলের সঙ্গই শ্রেয়। অথচ যে দল তাদেরকে মনোনয়ন দিয়েছিল সেই দলের প্রতি তাদের কোনো আনুগত্যই নেই। অন্যদিকে যে দল তার সদস্যদের মানাতে পারে না সে দল কীভাবে রাজনীতি করবে! এমন একটি দল দেশে থাকলে ক্ষমতাসীন দল তো হ্যাপি বার্থ ডে টু মি বলতেই পারে। তা নাহলে কি আর সাবেক তথ্যমন্ত্রী এবং যার নিজ দল থেকে জিতে আসার ক্ষমতা নেই, ক্ষমতাসীন দলের মার্কায় জিততে হয় তার মতো নেতাও বলতে পারে, এ বছর হবে দলটিকে নিঃশেষ করে দেয়ার বছর। গত সোমবার সংসদে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক আইনমন্ত্রী অনেকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই বলেছেন, আমাদের কে কী সমালোচনা করল এটা বড় বিষয় নয়। দলটি (বৃহৎ বিরোধী দল) ইজ নো মোর ফ্যাক্টর। তারা তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা কেন তাদের অ্যাটাক করছি? আমরা আমাদের কেন অ্যাটাক করছি না? তার এ কথা থেকে কি আর বুঝতে বাকী থাকে, দেশে যে এখন হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি চলছে!
তিন.
দেশে এ ধরনের রাজনীতি আরেকবার দেখা গিয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সময়। তখন এমন এক পরিস্থিতি ছিল যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ত্রাহি অবস্থা। দল দুটিকে সরকার দুই ভাগ করার প্রক্রিয়া শুরু করে। সেই প্রক্রিয়ায় দুই দলেরই কিছু বড় বড় নেতা যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের দিয়ে নতুন করে দল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যারা এই উদ্যোগের সাথে জড়িয়েছিলেন তাদেরকে বলা হয়েছিল সংস্কারপন্থী। তবে সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝেছিল যে তারা সংস্কারপন্থী নন, সুবিধাপন্থী। সরকার তাদের নানা সুবিধা দিয়ে দলের মূল নেতৃত্বকে মাইনাস করার উদ্যোগ নিয়েছিল। অর্থাৎ সংস্কারপন্থীরা হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। এর মাধ্যমে দেশে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দুই দলের কঠোর অবস্থান এবং সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের কারণে এ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন হয়নি। সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিপুল ভোটে বিজয়ী এবং বৃহৎ বিরোধী দলটি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ঐ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অবসান হলেও তার বীজ থেকে যায়। ক্ষমতাসীন দল সে বীজ যতেœ রেখে দেয় এবং সুযোগ বুঝে তা বেশ ভালোভাবে রোপন করে। সেই বীজ থেকে চারা হয়, চারা থেকে এখন বৃক্ষে পরিণত হয়েছে। তবে দলটি এমনভাবে কাজটি করেছে যে এ নিয়ে সমালোচনা হলেও তা উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন থাকলেও তার জবাবও রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বৈধতার মোড়কে এক অনাকাক্সিক্ষত শক্তিশালী অবস্থান এবং বল প্রয়োগের রাজনীতির সূচনা করে। শুরুতেই রাজনীতির অণু-পরমাণুর কৌশলে প্রধান বিরোধী দলকে গর্তে ফেলে দেয়। তারপর একের পর এক আচ্ছা মার দিয়ে দিশাহারা করে ফেলে। এই মারের মধ্যেই গণতন্ত্রের মোড়ক তৈরি করে। জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনকে লোকদেখানো নির্বাচনে পরিণত করে। এসব নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কেমন হয়েছে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও তর্ক-বিতর্ক থাকলেও নির্বাচন যে হয়েছে তা দলটি দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ দলটি ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা দেখাতে কোনো ধরনের কসুর করেনি। যখন দেখা গেল এই ক্ষমতার দাপট এবং তেজ দীর্ঘস্থায়ী হবে, তখন অনেক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গনের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এর মধ্যে যুক্ত হতে লাইন ধরেন। হই হই রৈ রৈ করে সবাই হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র মিছিলে যুক্ত হন। ক্ষমতাসীন দল পুনরায় ক্ষমতায় আসছেÑএ বিষয়টি আগে নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় মৌমাছির মতো ভনভন করে ভিড়তে থাকে। হিসাব খুব সিম্পল, শক্তের ভক্ত হওয়া। সবলের হাত ধরা। এতে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে প্রার্থী হতে চুনোপুটি ধরনের লোকজনও ক্ষমতাসীন দলের নমিনেশন পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ওঠে। তারা ভাল করেই জানেন, নমিনেশন পাওয়া মানেই নিশ্চিত পাস। এমন নিশ্চয়তা পেলে কে না ভিড়বে? অন্যদিকে গর্তে পড়া বিরোধী দল নিশ্চিতভাবেই গর্তে পড়ে থাকবে, তা জেনে কে যাবে তার কাছে? তার কাছে যাওয়া মানে তো গর্তে পড়া! অবশ্য হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতির বিষয়টি ক্ষমতাসীন দল থেকে অস্বীকারও করা হয় না। তার কথাবার্তা ও আচর-আচরণে এ মনোভাবই প্রকাশিত হয় যে, বিরোধী দলকে মানববন্ধন, সভা-সেমিনার করার মতো যেটুকু রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাই যথেষ্ট। এর বেশি রাজনীতি করার দরকার নেই। সাধারণ মানুষও সরকারের এ বার্তা বুঝতে পারে। ফলে তারা এখন আর আগের মতো রাজনীতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় না। এর কারণ হচ্ছে ভয়। কেউ কিছু বলতে গেলেই দেখা যাবে পিঠে এসে কিল-কনুই পড়ছে। কাজেই পিঠ বাঁচিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজে বাঁচলে বাপের নাম, প্রবাদটি মেনে চলাই ভাল। ক্ষমতাসীন দল তো বুঝিয়েই দিচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের উন্নতির জন্য যা করার দরকার তার সবই করা হচ্ছে। দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের রাজনীতিতে শামিল হও। উন্নয়নই রাজনীতি। এর বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।
চার.
তবে এ কথা সত্যি হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র রাজনীতি স্বৈরশাসন ব্যবস্থার চেয়ে ভয়ংকর। স্বৈরশাসন নিয়ে জনগণের সান্ত¦না পাওয়ার জায়গা থাকে। স্বৈরাচার জনগণকে তোয়াক্কা করে না, ক্ষমতার জোরে চলেÑএটা তাদের জানা। তবে গণতন্ত্রের লেবাসে হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র শাসন এমনই যে তাতে তাদের প্রতিবাদ বা বলার মতো অবস্থা থাকে না। গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র নেই-এমন এক গোলক ধাঁধাঁর চক্করে পড়ে হতোদ্যম হয়ে পড়া ছাড়া গতি থাকে না। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রকামী দেশে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তবে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশের মানুষ দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ আন্দোলনে যে রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিক না কেন, তাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। কারণ তাদের কাছে শুধু উন্নয়ন বড় কথা নয়, তারা গণতন্ত্রও চায়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে তাদের মিল রয়েছে। তারা চায়, শাসন এবং উন্নয়ন দুটোই করতে হবে গণতন্ত্রকে ধারণ করে। এর বাইরে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের চালাকিতন্ত্র বা হ্যাপি বার্থ ডে টু মি’র শাসন ব্যবস্থা চায় না। জনগণের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যকে সাময়িকভাবে অনেক শাসক দমিয়ে রাখতে পারলেও, শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছে। জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এ নজির স্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যে আপস করে না, রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে চায়, তা ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই জানে। কাজেই যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদেরকে বাংলাদেশের মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই দেশ শাসন করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ, এক দলের আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ বা গণতন্ত্রকে বিকৃত করে শাসন করা জনগণ যেমন গ্রহণ করে না, তেমনি তার পরিণতিও সুখকর হয় না। এক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই এবং এর বাইরে চিন্তা করারও সুযোগ নেই।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন