শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজনে

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শেখ দরবার আলম
॥ এক ॥
পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে ছাপা এবং বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমে, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে এবং অনেকের আলাপ-আলোচনার সময় এ রকম একটা আক্ষেপ প্রায়ই শোনা যায় যে, পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল-জীবনী এখনো প্রণীত হয়নি। গত তিন দশক আগে যারা পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন বলে দাবি করতেন তারাও এখন এই কথাটা নীরবে স্বীকার করছেন যে, পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ এখনো প্রণীত হয়নি। ইতোমধ্যে গত তিন দশকের মধ্যে নজরুল জীবনীবিষয়ক যেসব গ্রন্থাদি প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর তথ্যাদিও কোনো নজরুল জীবনী গ্রন্থে ধারণ করার মতো কোনো উপযুক্ত নজরুল গবেষকের আবির্ভাব এ যাবৎ এ আঙিনায় হয়েছে কিনা সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় আলোচনা এখনো হয়নি।
এদেশের নজরুল চর্চাকেন্দ্রিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমি এ বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ না নিলেও নজরুল চর্চাকেন্দ্রিক সরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট একটা পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের লক্ষ্যে অন্তত দুবার দুজন কবি-অধ্যাপককে দায়িত্ব দিয়ে কিছু টাকা-পয়সা খরচ করেছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু তারা উভয়েই কাজ কী করেছিলেন তা জানার সুযোগ এ যাবৎ নজরুলভক্ত জনসাধারণের হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কেননা, সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন অনুযায়ী গ্রন্থের পা-ুলিপি এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হয়। এই পদ্ধতি মেনে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি সম্বলিত নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করতে গেলে তা এই একই বিষয়ে ইতোপূর্বে কাজ করেছেন, এমন রিভ্যুয়ারের অসুয়াপ্রবণতার শিকার হতে পারে! এটা হলো সমস্যার একটা দিক।
সমস্যার আরেকটা দিক হলো খোদ নজরুল জীবনীকারের তরফে যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব। একটা যথার্থ পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হলে নজরুলের জন্মকাল থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রতিটি বছরের, প্রতিটি মাসের বাংলা, ইংরেজি ও হিজরি তারিখ, বার এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অনুষ্ঠানাদি কখন কী ছিল তা বড় বড় খাতায় চোখের সামনে থাকতে হবে। প্রকাশিত হোক কিংবা অপ্রকাশিত অথবা দুষ্প্রাপ্য হোক, নজরুল জীবন ও সৃষ্টির উপাদানাদি এই কাঠামোর মধ্যে বিন্যস্ত করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এভাবে কাজ না করলে নজরুল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিতভাবে জনমনে যেসব ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে সেসবের নিরসন ঘটানো সম্ভব নয়। তদুপরি নজরুলের যথার্থ একটা পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ লিখতে হলে নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিকে কেবল নয়, নজরুলের পূর্বপুরুষের অবস্থার বিবরণও কালানুক্রমিকভাবে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রেখে জানতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের আর্থ-সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের এই কবিকে সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে হলে ১৭০৭-এর ৩রা মার্চ স¤্রাট আওরঙ্গজেবের ইন্তেকালের পর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অবস্থার কথাটা যেমন জানতে হবে, তেমনি জানতে হবে ১৭৫৭-র ২৩ শে জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসন পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুণ্ঠন, শোষণ ও উৎপীড়ন চলাকালে, ১৭৭২ থেকে ১৮৫৮-র ৩১ শে আগস্ট পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসনামলে এবং ১৮৫৮-র ৩১ শে আগস্ট থেকে ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের, বিশেষ করে সুবাহ্ বাঙলা বিহার ও উড়িষ্যার দুই প্রধান সমাজের একটি যে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে একচেটিয়াভাবে এগিয়ে গেল এবং আর একটি সমাজ যে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হয়ে অধোগতিপ্রাপ্ত, অধঃপতিত, অসচেতন, অদূরদর্শী, লক্ষ্যভ্রষ্ট, লক্ষ্যহীন, হীনমন্য ও সমাজহীন সমাজে পরিণত হলো সেই ইতিহাসকেও। এটা না জানলে নজরুল জীবন ও সৃষ্টির পটভূমি হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকেও সঠিকভাবে জানা যাবে না। এর পাশাপাশি জানা আবশ্যক জাতীয়তাবাদ, একজাতিতত্ত্ব এবং সাম্প্রদায়িকতার ও ফ্যাসিবাদের ইতিহাস ও এসবের তাত্ত্বিক দিকগুলোও।
॥ দুই ॥
নজরুল জীবন ও সৃষ্টিকে সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে হলে তা জানতে ও বুঝতে হবে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের, বিশেষ করে হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই প্রধান ধর্মীয় সমাজের সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমিকায়। তা না হলে নজরুলের সাম্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের আর্থ-সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানমূলক কাজকর্মের ক্ষেত্রে অবদানটা যে কত গভীর, ব্যাপক ও মহৎ ছিল, কত আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল সেটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যাবে না। সাম্য ও সহাবস্থানমূলক নজরুলের এই অনন্য সাধারণ অবদানের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসতে পারে কেবল একটা যথার্থ পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল-জীবনীতেই।
॥ তিন ॥
নজরুল-জীবন ও সৃষ্টির অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য তারিখ-তথ্য, উপাদানাদি, নজরুলের অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য রচনাদি অনুসন্ধান, উদ্ধার ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত কাজ আমি করছি সেই ১৯৭৩ সাল থেকে। অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি সম্বলিত আমার যে চারটি একক প্রচ্ছদ নিবন্ধ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের তখনকার সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষের সম্পাদনায় ছাপা হয়েছে সেগুলো হলো যথাক্রমে “বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি ও কবি সৈনিক” (২রা জানুয়ারি ১৯৮২), “রাজবন্ধী কবি” (২৯শে মে ১৯৮২), “নজরুলের পরিচালনায় লাঙল” (২৫শে আগস্ট ১৯৮৪) এবং “ঢাকায় নজরুল” (৩১শে আগস্ট ১৯৮৫)।
ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকায়, নজরুল একাডেমি পত্রিকায়, নজরুলের বিভিন্ন জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গ্রন্থে ও পত্রিকায় এবং পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের আরো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নজরুল জীবন ও সৃষ্টির বিষয়ে প্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি সম্বলিত আমার অনেক লেখা ছাপা হয়েছে।
এ যাবৎ প্রকাশিত-অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য অনেক তথ্যাদি সম্বলিত আমার নজরুল জীবনী বিষয়ক গ্রন্থগুলো হলো : “অজানা নজরুল” (১৯৮৮), “নবযুগ ও নজরুল জীবনের শেষ পর্যায়” (১৯৮৯, তৃতীয় সংস্করণ ২০০৬), “নজরুল জীবন ও পালিত কন্যার স্মৃতিকথা” (১৯৯৮), “নজরুলের অসুস্থতা ও চিকিৎসা” (২০০২) এবং “নজরুলের নানান দিক” (২০০৪)।
নজরুল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে কেবল অপ্রকাশিত ও দুষ্প্রাপ্য তারিখ-তথ্য নয়, কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টিকে এই গ্রন্থগুলোতে সঠিকভাবে দেখার বিষয়টিও আছে। এ লক্ষ্যে এই গ্রন্থগুলোতে নজরুল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণারও অবসান ঘটানো হয়েছে। নজরুল জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ে কিছু লোকের মনে যেসব ভ্রান্ত ধারণা আছে সেসবেরও নিরসন ঘটানো হয়েছে এসব গ্রন্থে তারিখ-তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে এসে। এ কাজগুলো আমি করেছিলাম নজরুল জীবন ও সৃষ্টিবিষয়ক তারিখ-তথ্য ঐতিহাসিক পটভূমিকায় কালানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করে অন্যূন আট খ-ে যথাসম্ভব পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণ্য নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের প্রস্তুতি গ্রহণকালে। এ জন্য আমি দীর্ঘদিন যাবৎ আর্কাইভাল ওয়ার্ক করেছি কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এবং ঢাকায়।
কিন্তু ঐতিহাসিক পটভূমিকায় বিভিন্ন খ-ে নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য কেবল এত কিছু জানাই এবং এত কিছু করাই যথেষ্ট নয়, গ্রন্থ প্রণেতার আর্থিক সামর্থ্য, আর্থিক নিরাপত্তা কিংবা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাও থাকা দরকার।
ঠিক সেটারই অভাব প্রয়োজনীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ইতিহাসর্চচার ক্ষেত্রে আমাদের এই অসচেতন ও পিছিয়ে পড়া সমাজে। সমাজহীন মুসলমান সমাজে।
॥ চার ॥
আমাদের কোথাও কোনো সমাজ নেই। তাই সমাজের প্রয়োজনে, গণমানুষের প্রয়োজনে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সম্পর্কিত পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর সমাজহীন মুসলমান সমাজের চালাক-চতুর লোকগুলো ভাগ্যান্বেষণে চলে গেছে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে নতুন নতুন সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে। এভাবে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর সমাজহীন মুসলমান সমাজ এতিম হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। ফলে সমাজহীন মুসলমান সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতির ও ইতিহাস-চর্চার কাজ কোথাও তেমন কিছু হচ্ছে না। মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা বিরোধী এ মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পবিরোধী এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাসবিরোধী যেসব রাজনৈতিক সংগঠন আছে সেসব রাজনৈতিক সংগঠনের লোকদের পছন্দমতো সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চা হচ্ছে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে নজরুল সাহিত্য অবশ্য পাঠ্য হয়নি। কেবল নজরুল-সাহিত্য নয়, মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীতের কোনো কিছুই পাঠ্য হতে দেওয়া হয়নি ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলেই। অথচ সেই পাকিস্তান আমলেই অবশ্য পাঠ্য ছিল কেবলমাত্র হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পর যারা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” এবং “বৈষ্ণব পদাবলী” সেই পাকিস্তান আমলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ ক্লাসে অবশ্য পাঠ্য ছিল। এসব কীভাবে হতে পেরেছিল এ নিয়ে কোনো গবেষণা, এমনকি লেখালেখিও হয়নি। কেন হয়নি সে বিষয়েও কোথাও লেখালেখি হয়নি।
নজরুল সাহিত্য ও অন্যান্য মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের লেখা মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা ও এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর খোদ পাকিস্তান আমলেই অস্পৃশ্য বা অচ্ছ্যুৎ হওয়ার কারণে গত ৬৯ (ঊনসত্তর) বছরে সেসবই প্রায় বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। “বাংলা একাডেমি চরিতাভিধানে” সেসবের কিছু কিছু হদিস পাওয়া যায় মাত্র। ফলে এই মুসলিমপ্রধান দেশের সমাজহীন মুসলমান সমাজের যারা বিভিন্ন আঙিনায় প্রতিষ্ঠিত তাদের কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি যে, কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া মুসলমানদের কবি-সাহিত্যিক আর কে আছেন? আবার এই নজরুল বিষয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারেও তাদের আলস্যের অন্ত নেই।
॥ পাঁচ ॥
খোদ পাকিস্তান আমলেও অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতিতে হিন্দু ও খ্রিস্টান কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যও যদি সমান গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতো তাহলে মুসলমান সমাজের প্রতি এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার প্রতি সুবিচার করা হতো। কিন্তু অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের ও যুগান্তর দলের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের ও যুগান্তর দলের সভ্যদের প্রভাবে সেটা করা হয়নি। কারণ তামাম ভারতীয় উপমহাদেশকে এক হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র করার কর্মসূচি নানান জায়গায় বাস্তবায়নের কাজ নানাভাবেই চলছে। মুসলিম প্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলা এবং মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম ভাগ করে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গায়, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশের মতো জায়গায় ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পর এই মুসলিমপ্রধান দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রধান মুসলিমপ্রধান প্রদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ জন্ম দিয়ে একদিকে এই মুসলিমপ্রধান দেশের মুসলমানদেরকে যেমন মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা থেকে সরিয়ে আনার একটা পাকা বন্দোবস্ত করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করানো হয়েছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-১৯১৮ চলাকালে তুর্কিভাষী খলিফার খিলাফতের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে যা করা হয়েছে, সেটাই করার কর্মসূচি জারি করা হয়েছে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব ভাগ করে, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলা ভাগ করে এবং মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম ভাগ করে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গা নিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশের মতো জায়গা নিয়ে সৃষ্ট মুসলিমপ্রধান দেশে।
॥ ছয় ॥
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের একজাতিতত্ত্বের এই কর্মসূচি জারি থাকার কারণে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলেও ১৭৫৭-র ২৩ জুন থেকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত এই একশ নব্বই বছরের একটা ইতিহাস গ্রন্থ লেখা হয়নি। এত সব বিশ্ববিদ্যালয় এবং এত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এতসব ইতিহাস বিভাগ থেকে কী হলো? প্রয়োজনীয় কাজ কী হলো?
অন্যান্য অনেক দিকে কিছু লোকের যে ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে সেটা স্বীকার করেও বলছি, ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের বিভাজনটা যদি না ঘটত তা হলে নজরুলবিষয়ক গঠনমূলক কাজকর্মসহ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার আঙিনায় মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায় সৃষ্টির আত্মঘাতী এই সর্বনাশটা হতো না। মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলা এবং মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম ভাগ করে ব্রিটিশ ভারতের আশি শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু সমাজ-প্রধান যে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র, সেটার সঙ্গে ৫৬২টির মতো দেশীয় রাজ্যের প্রায় সবগুলো যুক্ত হওয়ার ফলে এখন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় নব্বই শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে হিন্দু সমাজপ্রধান স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র। হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকামীরা এবং হিন্দু ধর্মীয় একজাতিতত্ত্ব আরোপকামীরা ইরান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া নিয়ে পরে কী করতে পারবেন তা উপলব্ধি করার মতো এলেম আমার নেই। কিন্তু তামাম ভারতীয় উপমহাদেশকে এক হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে তাদের ঘোষিত কর্মসূচির কথাটা তাদের বইপত্রের বিভিন্ন লেখাতেই যেভাবে পাওয়া যায়, বাস্তবেও সেসবের অনেক কিছুই লক্ষ্য করা যায়।
॥ সাত ॥
আমাদের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশেও মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প ইত্যাদি চর্চা করতে না দেওয়ার একটা অংশ হিসেবেই স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তো বটেই, এমনকি গণমাধ্যমেও উপযুক্ত মর্যাদায় নজরুল চর্চা করতে না দেওয়ার জন্য যেভাবে যা কিছু করার দরকার তা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা সেসব কর্মসূচিরই অংশ যেসব কর্মসূচির মাধ্যমে এই ভারতীয় উপমহাদেশে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় এক একটা ধর্মীয় সমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে সম্পূর্ণভাবে কিংবা প্রায় সম্পূর্ণভাবে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশের সমাজহীন মুসলমান সমাজের শাসক শ্রেণীর একটা উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশের মনোযোগটা ঠিক কোনদিকে সেটা উপলব্ধি করা যায় যখন দেখা যায় হরেক রকমের চেতনার স্লোগান দিতে দিতে দেশের ভিতর লুটপাট চালিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে টাকা পাচার করে সেসব জায়গায় বেগমপাড়া সৃষ্টি করে সেসব দেশে সেকেন্ড সিটিজেন হয়ে নিজেদের বউ-বাচ্চা ও টাকা-পয়সা রাখার, দোকান পসার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার বন্দোবস্তও করেছেন। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের আগে সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে সমাজহীন মুসলমান সমাজে সচেতনতা, ঐক্য সংহতি ও জাগরণ সৃষ্টির জন্য যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তাদের সাহিত্য-সঙ্গীত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে দেওয়ার অনেক রকমের পাকা বন্দোবস্ত হয়েছে। এটা সমস্যার মস্ত বড় একটা দিক।
সমস্যার আরো একটা দিক আছে। সেটা কম বড় দিক নয়। যারা বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীতের অস্তিত্ব বজায় থাকুক, এটা চান তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিতজনদের কারো কারো অসূয়াপ্রবণতাও এসব কাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার ব্যাপারে অন্তরায় সৃষ্টি করে। তাদের মানসিকতা এ রকম যে “কাজটা তো খুবই ভালো। কিন্তু কাজটা কেবল আমি করতে পারলে খুবই ভালো। কাজটা করার ফলে যদি অন্য কারো সুনাম হয় তাহলে তো সেটা আদৌ ভালো নয়। অন্য কারো সুনাম হবে এমন কাজে সহযোগিতা করে আমার কী লাভ?” এরকম মানসিকতা একটা বড় সমস্যা। লেখাপড়া জানা মুসলিম জনসাধারণ যদি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতিÑ এসবের ইতিহাস বিষয়ে যদি পড়াশোনা করেন, মুসলিম মনীষী ও দানবীরদের যদি জীবনী পড়েন তাহলে সমাজে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সহায়তা দেওয়ার উৎসাহ ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হবে। নজরুল বিষয়ক কাজসহ এ ধরনের কাজকে সমাজের কাজ গণমানুষের কাজ হিসেবে না দেখলে কারো মনে সহযোগিতার মানসিকতা আসবে না। নজরুল জীবনী গ্রন্থ প্রণয়ন প্রসঙ্গেই এসব লেখলাম।
॥ সাত ॥
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশে মুসলমান সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ও এই মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্প উৎখাতের লক্ষ্যে অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যরা ও যুগান্তর দলের সভ্যরা যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে দাঁড় করিয়েছিলেন সেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার পথে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল নজরুল সাহিত্যের একটা বিরাট অংশকে এবং এক জাতিতত্ত্বের পরিপন্থী নজরুলের সাংস্কৃতিক সহাবস্থানকামী চিন্তাভাবনাকে। লেনদেনের ভিত্তিতে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এই চিন্তাভাবনা বাস্তবায়নের কাজ করে আসছেন।
আরেকটা কঠিন বাস্তবতা নজরুল চর্চার অন্তরায় হিসেবে কাছ করছে। আমরা জানি যে, ১৭৫৭-র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের পর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণীর এবং বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী, মনুসংহিতার সমাজের জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু সমাজ হিসেবে শনাক্ত হওয়ার কারণে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার-বঞ্চিত হয়ে হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন, অসংগঠিত, অপরিণামদর্শী ও লক্ষ্যহীন একটা সমাজহীন সমাজে পরিণত হয়েছেন। ১৭৫৭-র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের একশ নব্বই বছর পর ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশে সাময়িকভাবে একটা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা সুবিধাভোগী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ভোগবাদী হয়ে এমন আত্মকেন্দ্রিক হয়েছেন যে, গ্রন্থপ্রণয়ন ও প্রকাশ করাকে তারা সমাজের কাজ, গণমানুষের কাজ হিসেবে দেখার মানসিকতা পোষণ করেন না। তারা মনে করেন যে, এতে লেখকের নাম হবে। অন্যের নাম হওয়ার জন্য তারা সহযোগিতা করবেন কেন?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন