শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বদলে গেল পদ্মা নামের নদীটি

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু
নদীমাতৃক বাংলাদেশের বড় বড় নদীগুলোর মধ্যে যে নাম সবার আগে চলে আসবে সেটি হলো পদ্মা। যার রয়েছে গৌরব করার মতো ইতিহাস। জীববৈচিত্র্য, মানববসতি পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক কর্মকা- সব মিলিয়ে পদ্মার মতো বহুমাত্রিক ঐতিহ্য ধারণ করে ক্রমেই প্রবাহমান নদী আছে খুব কম। যার ভর যৌবন আর দুরন্তভাবে ছুটে চলাকে কেউ বলেছে সর্বনাশা আবার কারো কণ্ঠে কীর্তিনাশা। তার বিশালত্ব দেখে শিল্পীরা খুঁজেছেন কূলকিনারা। পদ্মা নিয়ে যত গান কবিতা রয়েছে, এমনটি অন্য কোনো নদীর ভাগ্যে আর হয়নি। কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের কাছে এটি ছিল স্বপ্নময় পদ্মা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ বজরা ভাসিয়ে পদ্মার বুকে বসে লিখেছেন গান-কবিতা। গর্ব করার মতো এ পদ্মা নদীর তীরে আমার জন্ম। বাপ-দাদার ভিটেও পদ্মার তীরে। তারাও জন্মেছেন এখানেই। নগরীর হাদীর মোড়ের ঠিক দক্ষিণে ছিল বাপ-দাদার ভিটে। বাঁশবাগান, পেয়ারা, আম, লিচু আর ছোট একটা পুকুর মিলে বিঘে পঞ্চাশ এলাকা জুড়ে ছিল এ নিবাস। এর দক্ষিণ দিয়ে পদ্মা বয়ে যেত নিরবধি। এক সময় প্রমত্ত পদ্মা শহররক্ষা বাঁধ রাস্তা জনপদ গ্রাস করতে করতে উত্তরে চলে আসে। বেশির ভাগ জমি পদ্মাগর্ভে চলে যাওয়ার পর বাধ্য হয়ে সেখান থেকে একটু পশ্চিমে আহমেদপুর এলাকায় হয় নতুন ঠিকানা। যদিও পুরাতন ভিটে, ঘরবাড়িসহ বিঘে দশেক জমি টিকে ছিল স্বাধীনতার দুই বছর পর পর্যন্ত। নতুন নিবাসে আমার জন্ম। ঘর থেকে একশো গজ দূর দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা সব সময় টানত। এর মৃদুমন্দ বাতাস ঘোলা আর স্বচ্ছ পানি কাদাবালি গায়ে মেখে বাল্যকাল, শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য ভরা দিনগুলো উপভোগ করে বেড়ে উঠেছি পদ্মার রূপ রস নিয়ে। ভরা বর্ষায় নদীর কী ভয়ংকর রূপ। বাতাসের সাথে লড়াই করে বড় বড় ঢেউ তুলে ছুটে চলেছে সাগর পানে। বড় বড় স্টিমার, জাহাজ, মালবাহী বিশাল বিশাল নৌকা পদ্মা বেয়ে উজান ভাটিতে যাতায়াত করছে। ঘড়িয়াল শুশুকের ভুশ করে ভেসে উঠে ফের হারিয়ে যাওয়া। ঢেউয়ের মাথায় পাল তোলা নৌকা নিয়ে জেলেদের সাহসী লড়াই। ইলিশের সাথে নানা প্রজাতির মাছ ডোঙ্গায় ভরে তীরে ফেরা। শীতকালে পদ্মার ঢেউয়ের নাচন থেমে যেত শান্ত ¯িœদ্ধ টলটলে পানি নিয়ে বয়ে যেত ধীরলয়ে। বালিহাঁসসহ কত প্রজাতির পাখপাখালি আসত তার ইয়াত্তা নেই। পদ্মার বিভিন্ন রূপ আর আচরণের সাথে মানিয়ে নিয়েছিল এখানকার মানুষ। ভরা বর্ষায় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত তার বয়ে যাওয়া দেখতে। বিকেল বেলা কর্মক্লান্ত মানুষ একটু জিরিয়ে নেবার জন্য কিংবা নিছক আড্ডা জমাত নদীর তীরে। ছাঁকনা জাল ঘুরিয়ে ইলিশ ধরার আনন্দ ছিল অন্যরকম। অনেকে শৌখিনতার জন্য জাল বসাতেন নদীর তীরে। এসব জালে বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ত। কি যে আনন্দের ব্যাপার ছিল তা বলে বোঝানোর নয়। বেড়াতে আসা মানুষের অনেকে জেলেদের কাছ থেকে টাটকা মাছ কিনতেন দেড়-দু’টাকা কেজি দরে।
সে সময়কার ইলিশের স্বাদ আর গন্ধ এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখনকার পদ্মায় ধরা পড়া ইলিশেও না। সে সময় এক বাড়িতে ইলিশ রান্না হলে অনেক দূর থেকে তার মন মাতানো গন্ধ ভেসে আসত। ৬০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও ধূসর স্মৃতিতে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেসব দৃশ্য। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী ভুপেন হাজারিকা গেয়েছেনÑ গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা। নদীকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। গঙ্গা আর পদ্মা নদী কিন্তু একটাই। শুধু স্থানের ভিন্নতায় নাম গেছে বদলে। গঙ্গার প্রকৃত সীমা ধরা হয় হিমালয় পর্বতমালার গাঙ্গোত্রী নামক হিমবাহ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের গোয়ালন্দ পর্যন্ত। যার দৈর্ঘ্য ছাব্বিশশো কিলোমিটার। গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের পাশ দিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে। রাজশাহী পাবনা কুষ্টিয়া রাজবাড়ি জেলা অতিক্রম করে গোয়ালন্দ এসে মিলেছে উত্তর দিক থেকে আসা যমুনাকে ধারণ করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে গঙ্গার তীর্থ মাহাত্ম্য অপরিসীম। গঙ্গাকে তারা মা বলে ডাকে। আমরা বলি নদী মাতৃক দেশ। মাতৃক শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের মতো প্রতিপালন আশ্রয়দান নিরাপত্তা মায়া মমতা। নদীনির্ভর আমাদের দেশের নদীগুলো কৃষি নৌ যোগাযোগ অর্থনীতি পরিবেশ প্রকৃতি সবমিলিয়ে এক বিশাল কর্মকা-ের আধার হয়ে আছে। একেকটি নদী আমাদের লাইফ লাইন। আর এই লাইফ লাইনের ওপর আঘাত হানা মানে সেখানকার বিশাল এলাকায় জনগোষ্ঠীর বিপর্যয় ডেকে আনা। মা নামে অভিহিত পদ্মার বুকে খড়গ চালাতে একটুও দ্বিধা করেনি ভারতের পানি জল্লাদরা।
পদ্মা ছিল এ অঞ্চলের লাইফ লাইন। এখানকার বিশাল শ্রোতধারা আমাদের করত সঞ্জীবিত, সিক্ত। কৃষি মৎস্য নৌ যোগাযোগ জীববৈচিত্র্য আর ছিল সবুজতা। সে কারণেই এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব যেমন ছিল তেমনি পদ্মাকে নিয়ে বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক লোকসঙ্গীত। যার মধ্যে রয়েছে বল আমারে তোর কিরে কূলকিনারা নাই...। কিংবা পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যারে...। পদ্মা এখন আর শূন্য হৃদয় নিয়ে যায় না। খর¯্রােত পদ্মার পানির মায়াবি ডাক আর মানুষের ঘুম ভাঙায় না। এখন যেদিকে চোখ যাবে সেদিকে শুধু বালিচর। যেন মরুভূমির আরেক রূপ। যা দেখে শূন্য হৃদয়টা আরো শূন্য হয়ে যায়। সেই কাব্যের প্রাণের পদ্মা বিশাল বালিচরের তপ্ত কড়াইয়ে ভাজা ভাজা হয়ে গেল। পদ্মার পানি বিশালতা উথাল-পাতাল করা ঢেউ দেখে যে সর্বনাশা পদ্মার কথা শিল্পী গেয়েছিলেন সেই পদ্মার দফারফা করে দিয়েছে মরণ বাঁধ ফারাক্কা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝিরা আজ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে পানিশূন্য ধু ধু বালিচরের দিকে।
এককালের প্রমত্ত পদ্মার বর্তমান রূপ দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। যারা প্রমত্ত পদ্মা দেখেননি তারা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠবেন এই কি আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্নময় পদ্মা। এ যেন নদী নয়, নদীর ফসিল জীবাস্ম। যা দেখে হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। পদ্মার মরণদশা শুরু ১৯৭৪ সালে। ভারতের পানি জল্লাদরা গঙ্গা পদ্মার বুকে ফারাক্কা নামক ব্যারেজের খড়গ দিয়ে পানি আটকে রাখার পর থেকে। ১৯৭২ সালেও যে পদ্মায় ভারত থেকে বড় বড় জাহাজ এসে শেষবারের মতো ফুদকিপাড়া ঘাটে নোঙ্গর করতে দেখেছি। সাতবাড়িয়া জাহাজঘাট, তালাইমারীঘাট, আলুপট্টিঘাট, ফুদকিপাড়াঘাট, গোদাগাড়ী রেলঘাটে ভিড়ত জাহাজ আর মালবাহী বড় বড় নৌকা। এগুলো এখন নাম নিয়ে বেঁচে আছে।
ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর পর একটু একটু করে কীর্তিনাশা পদ্মার অথৈ নাচন কমতে থাকে। পদ্মার বুকে বিস্তৃতি ঘটতে থাকে বালিচরের। পদ্মার মরণদশার সাথে অসংখ্য শাখা নদ নদী খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে। টান পড়ে ভুগর্ভস্থ পানির স্তরে। আগে খাবার পানির ভরসা ছিল টিউবওয়েল ও পাতকুয়া। বাড়িতে বাড়িতে ছিল এসব। যে টিউবওয়েলে হাতল চাপলে গলগলিয়ে পানি আসত তাতে টান শুরু হয়। পাতকুয়াগুলো তলানীতে ঠেকে। স্বচ্ছ পানি নয় কাদাপানি আসতে শুরু করে। টিউবওয়েলে টান ধরায় পানি উঠাতে গিয়ে হাতলের আঘাতে কতজনের থুঁতনি কপাল আর হাত ভাঙতে দেখেছি তার ইয়াত্তা নেই। আগে এক চাপে পানি পাওয়া গেলে পরবর্তীতে তিন চার চাপে পানি আসত খুব কম। এরপর ধীরে ধীরে এসব টিউবওয়েল ও পাতকুয়া অচল হয়ে গেল। পানি উঠানোর জন্য দশ-পনের ফুট গর্ত করে সেখানে টিউবওয়েল বসিয়েও ঠিকমতো পানি পাওয়া যায়নি। যে পানি আসে তা আয়রন আর আর্সেনিকযুক্ত। অনেক পরে যোগ হলো সেমি ডিপ টিউবওয়েল। পৌর কর্তৃপক্ষ বাড়ালো পানি সরবরাহের লাইন।
পদ্মার মরণদশা শুরু হওার সাথে বন্ধ হয়ে গেল নৌ যোগাযোগ। জাহাজ তো দূরে থাক বড় বড় মহাজনী নৌকাও আর চলেনি। পদ্মা মরে যাবার সাথে মরণদশা শুরু হলো এ অববাহিকার মানুষের। বদলে গেল আবহাওয়ার রূপ। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে গেল সবুজতা। ভর করলো আবহাওয়া রুক্ষতা। ধাবিত হলো মরুময়তার দিকে। যে নদীর বুকে নৌকা চলার কথা সেখানে চলে গরু-মহিষের গাড়ি বালির ট্রাক আর চাষাবাদের ট্রাক্টর। হারিয়ে গেল সেই স্বাদের ইলিশ আর নানা প্রজাতির মাছ। ঘড়িয়াল দেখতে এ প্রজন্মকে এখন রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যানে যেতে হয়। আর ইলিশ বলতে সমুদ্রের। পদ্মার সেই সময়কার ইলিশের সাথে যার তুলনা হয় না। নদীকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে গেল। জেলে মাঝিমাল্লা বেকার হয়ে চলে গেল অন্য পেশায়। সমস্ত জীবন ধারায় পাল্টে গেল। শহররক্ষা বাঁধ আর তার নিচের ফাঁকা জমিতে এক দুই করতে করতে গড়ে উঠল বস্তি। এসব স্থানের মালিক পানি উন্নয়ন বোর্ড। এক সময় যে বাঁধে ঘর দুয়ার তোলা দূরে থাক সাইকেল চালানো কিংবা গরু-ছাগল উঠলে ধরে চালান করা হতো খোঁয়াড়ে, পাহারাদারদের হাতে নাজেহাল হতে হতো সাইকেলচালকদের। পূর্ব-পশ্চিম জুড়ে সতের কিলোমিটার বাঁধ ছিল সুরক্ষিত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি আর দুর্নীতির কারণে এখন পুরো বাঁধ আর তার নিচের এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার স্থাপনা। শেষ হয়ে গেল সাধারণ মানুষের বৈকালী ভ্রমণ আর নদী তীরে বসে বৈঠকি আড্ডা। এসব বস্তি এখন নগরবাসীর বিষফোঁড়া। এখানে গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তাছাড়া ভারত পদ্মায় পানি না দিলেও এ পদ্মার চর পেরিয়ে বানের মতো ঠেলে দেয় মদ-ফেনসিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য। নদীর ওপারে ভারত সীমান্তে বানানো হয়েছে মাদকের কারখানা। যার সর্বনাশা ছোবল ধ্বংস করেছে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষকে। মাদকের ছোবলে কত মেধাবী সন্তান আর কত পরিবার যে ধ্বংস হয়ে গেছে তার হিসাব নেই। এমন বহু পরিবারের কথাই জানি। পদ্মা বাঁধ আর নদী তীরে ঘরবাড়ি আর স্থাপনা গড়ে ওঠায় চোখের আড়াল হয়ে গেল পদ্মা। আর জানালা দিয়ে কিংবা বারান্দায় গিয়ে দেখা যায় না। চারতলার ছাদে গিয়ে দেখতে হয় পদ্মাকে। যে দিকে চোখ যায় শুধু বালিচর। মাঝে-মধ্যে খানিক সবুজতা দেখে মনে হয় যেন মরুদ্যান। বছরের নয় মাস পানি আটকে পদ্মাকে শুকিয়ে মারলেও বর্ষার সময় ওপারের বন্যার চাপ সামলাতে পাষাণ ফারাক্কার সবকটি গেট খুলে দিয়ে একসাথে বিপুল পরিমাণ পানি ঠেলে দেয় এপারে। নদী মরে যাওয়ার ফলে নাব্যতা হারিয়েছে। একসাথে এত পানি ধারণ করতে পাওে না। দুকূল ছাপিয়ে চলে। ভাঙে দূতির সাজানো সংসার ফসলের ক্ষেত। ওপারের বন্যার চাপ কমে গেলে আবার পাষাণ কপাট বন্ধ হয়ে যায়। পানি কমে গেলে বালিতে যেমন চরের পুরুত্ব বাড়ে, তেমনি কিছু পলি পড়লে তাতে নদী তীরবর্তী মানুষ চাষাবাদের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সেচের জন্য মাঝ নদীতে শ্যালো মেশিন বসায়। বর্ষার সময় নদীতে পানি এলে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটায় এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। আর শুকনো মৌসুমের বিকেল বেলায় পদ্মার বালিচরে ভিড় জমায় বিভিন্ন বয়সী মানুষ। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোয় মানুষের ঢল নামে মরা পদ্মার বালিচরে।
বিপন্ন চইর‌্যা : পদ্মার দক্ষিণে রয়েছে বিশাল মানব বসতি। চরআষাড়িয়াদহ, চরখিদিরপুর, চরমাঝারদিয়ার, চর খানপুর, উজিরপুর, চরবিদিরপুর নামে অসংখ্য গ্রাম। সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক মানুষের বাস। রয়েছে তাদের ফসলের ক্ষেত সাজানো ঘর গেরস্থালি। শহরের মতো সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও তাদের দিন ভালোই কাটছিল জমিজিরাত চাষবাস আর মাছ ধরে। শহরের মানুষ ওদের চইর‌্যা নামে অভিহিত করত। সুঠাম আর লম্বা চওড়া দেহের অধিকারী। ভাষায় অন্যরকম একটু টান ছিল। নদীর ওপারে ঘরবসতি হলেও উৎপাদিত ফসলের বেচাকেনা কাপড়-চোপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস চিকিৎসা সবই নিতে হতো এপার থেকে। পদ্মার উথাল-পাতাল করা ঢেউ মাড়িয়ে নৌকা ভাসিয়ে চলে আসত সকালে আর ফিরে যেত বিকেলে। এখনকার মতো নৌকায় ইঞ্জিন লাগানো ছিল না। শ্রোত আর ঢেউয়ের সাথে লগি বৈঠা নিয়ে লড়াই করে যাওয়া-আসা করত নৌকাগুলো।
নদী পারাপার ছিল এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার। নদী মরে যাওয়ার সাথে তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। খানিকটা খাল নামক নদী পেরিয়ে আবার বিশাল বালিচর হেঁটে যাতায়াত করতে হয় বছরের নয় মাস। ভরা বর্ষায় চরগুলো ঠিকমতো ডোবে না। ফলে যাতায়াতের দুঃখ তাদের বারো মাস। এপার-ওপারের মধ্যে সোজাপথে দূরত্ব চার কিলোমিটার। নব্বই দশকে তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী কবির হোসেন তার নির্বাচনী এলাকা বলে চরাঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প নামে কিছু ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, গুচ্ছগ্রাম বানিয়েছিলেন। তাদের বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সয়নি। ভারতের পানি নিয়ে চ-নীতির কারণে বর্ষার সময় একূল-ওকূল দুকূল ভাঙতে থাকে। একের পর এক গ্রাম বিলীন হয়। হাজার হাজার মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ছিন্নমূলের খাতায় নাম লেখায়। সব ফেলে ছড়িয়ে পড়ে শহরে। একদিন যার সব ছিল সে হয়ে যায় ফকির। চর ভাঙতে ভাঙতে এখন অনেক স্থানে ভারতীয় সীমানা ছুঁইয়েছে। সেখানে আধিপত্য বিস্তার করেছে বিএসএফ। চরের মানুষ নিজ গৃহে পরবাসীর জীবনযাপন করছে। রেডক্রিসেন্টের সাথে জড়িত থাকার কারণে বেশ কবার ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছি এসব মানুষের কাছে। তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে তাদের প্রিয় খাবার মাশকলাইয়ের আটার রুটি আর মরিচ পেয়াজের ঝাল ভর্তায়। এর স্বাদই ভিন্ন রকমের। গত বছরও ভাঙনের সময় ছুটে গিয়েছিলাম। ভাঙনের তা-ব আর চরের বাসিন্দাদের অসহায়ত্ব বড্ড বুকে বিঁধছিল। গতবারও কয়েক হাজার চর বাসিন্দা উদ্বাস্তু হয়েছে।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ১৯৭৬-এর এপ্রিল মাস থেকে রাজশাহীতে তোড়জোড়। সারা বিশ্বের মজলুম মানুষের প্রিয় নেতা মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছেন ফারাক্কা লংমার্চের। চারদিকে এক আওয়াজ মরণবাঁধ ফারাক্কা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। এখন ঢাকা থেকে রাজশাহী আসার পথ এত সহজ ছিল না। মূলত ট্রেনই ভরসা। ১৬ মে রাজশাহীবাসীর জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে। সবার মুখে এক কথা মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছেন। সারা দেশ থেকে বাস-ট্রেন-ট্রাক বোঝাই মানুষ আসছে। আর সবাই ছুটছে ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানের পানে। রাজশাহীবাসী তাদের অতিথি মনে করে যথাসাধ্য চেষ্টা করে আগতদের ক্ষুধা পিপাসা নিবারণের জন্য। মনে পড়ে আম্মা কিছু রুটি সুজির হালুয়া আর কাচের এক বোতল পানি দিয়েছিলেন লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের দেবার জন্য। বাড়ির সামনে দিয়ে জনতার কাফেলা ছুটছিল। দৌড়ে গিয়ে তাদেরই কারো হাতে তুলে দিয়েছিলাম এগুলো। পরে ছুটেছিলাম মিছিলের পিছে পিছে। তবে মাদ্রাসা ময়দানে ঢুকতে পারিনি। মাঠ ছাড়াও বাইরের অনেক দূর জুড়ে ছিল খালি মানুষ আর মানুষ। চারদিকে এক আওয়াজÑ চল চল ফারাক্কা চল। সেদিন ফারাক্কা লংমার্চের তাৎপর্য ততটা বুঝতে না পারলেও এখন জীবনের পরতে পরতে তা অনুভব করি। ফারাক্কার ব্যারেজের কী ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা সে সময় কীভাবে বুঝেছিলেন এ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা। তার সেদিনের পনের মিনিটের দিকনির্দেশনা ও উদ্দীপক ভাষণ আজো এখানকার আকাশে-বাতাসে বাজে। এর পরেও অনেক লংমার্চ রোডমার্চ হয়েছে কিন্তু সেদিনের মতো সবশ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূত অংশগ্রহণ আর দেখা যায়নি।
ফারাক্কা ব্যারেজের ভয়াবহতা নিয়ে দেশের প্রথিতযথা কবি-সাহিত্যিক-গবেষক মরহুম আহমদ সফা তার এক নিবন্ধে বলেছেন, ফারাক্কা বাংলাদেশের ওপর নামিয়েছে নাগাসাকি হিরোশিমার চেয়েও ভয়ংকর বিভীষিকা। ফারাক্কা ব্যারেজের ওপর দাঁড়িয়ে বন্ধুবর কবি আব্দুল হাই শিকদারের অনুভূতি ছিলÑ এত ফারাক্কা বাঁধ নয়, এ হলো মানব সভ্যতার বধ্যভূমি। দক্ষিণ এশিয়ার কসাইখানা। হিটলারের নাজিক্যাম্প। এ হলো সীমারের ছুরিকা ক্লাইভের খঞ্জর। এ এক নতুন কারবালা। ফারাক্কা ব্যারেজের এপার-ওপার দেখে আব্দুল হাই শিকদারের কাতর ক্রন্দন ধ্বনি ফারাক্কা সৃষ্ট বিপন্ন মানবতার ক্রন্দনধ্বনি। এ কান্না শুধু কবির নয়, দেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর এ কান্না। ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর সময় বলেছিল পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলো। এ পরীক্ষা আজো শেষ হয়নি। পদ্মা অববাহিকার মানুষকে নিয়ে কুৎসিত খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে শুকিয়ে মারা আবার ডুবিয়ে আর ভাঙনে সব হারানো খেলার পরীক্ষায় তারা আপতত সফল হয়েছে। তবে এটা মনে রাখা দরকার, পানির অভাবে এদেশে যে বিপর্যয় ও সামাজিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা পার্শ্ববর্তী দেশকে আক্রান্ত করতে পারে। পদ্মা নিয়ে লেখাটা শেষ করতে গিয়ে বার বার হুমায়ুন কবিরের কালজয়ী উপন্যাস নদী ও নারীর কটি লাইন সামনে ভেসে আসছিল। ভরা পদ্মার দিকে তাকিয়ে নজু মিয়ার মনও যেন ভরে উঠল। বর্ষার পদ্মার উদ্দাম শ্রোত আজ শান্ত। আশ্বিনের শেষে এখনো জলের ভাব রয়েছে কিন্তু ধার এসেছে কমে। তাকিয়ে তাকিয়ে নজু মিয়ার মনে হলো পদ্মা যেন তার ঘরের বউ। কতদিন কত সন্ধ্যা একসাথে কেটেছে কত ঝড়-ঝাপটা বিপদ-আপদ একসঙ্গে সয়ে আজ মাথার চুলে পাক শুরু হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক, রাজশাহী ব্যুরো প্রধান, ইনকিলাব

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন