এম.আর. মাহবুব
১৯ মে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় দিন। ১৯৬১ সালের এই দিনে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে ১১ জন শহীদ হন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল এক রক্তস্নাত অধ্যায়ের মহান দৃষ্টান্ত। ঠিক তেমনি ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে আসামে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯ মে’র রক্তস্নাত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে।
শুধু বাংলাদেশের বাঙালিরা নয়, আসামের বাংলাভাষী বাঙালিরাও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবনদান করেছে। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অমর ইতিহাস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১৯ মে বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের ঘটনাটি বাঙালির ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উপেক্ষিত এবং বিস্মৃত অধ্যায়। এখনো অনেক বাংলাদেশের বাঙালিরা মনে করেন, বাংলাভাষার জন্য জীবনদানের ঘটনা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ঘটেনি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশে যেমন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিক, অহিউল্লাহসহ আরো অনেকে জীবনদান করেছেন ঠিক তেমনি আসামের শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন ১১ জন ভাষাবীর।
দেশবিভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বিশেষ করে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জনপদ। তাদের মুখের ভাষা এবং সাহিত্য, সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বাংলা ভাষা আসামের সমাজ ও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৫০ সালে আসামে এক সময় গড়ে ওঠে ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলন। এর নেতৃত্ব প্রদান করেন উগ্রবাদী অসমিয়া সম্প্রদায়। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি এবং অসমিয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারি ভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার ইন্ধন যোগাতে ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯৪৮ সালের মে মাসে গোহাটি শহরে তারা বাঙ্গালিদের উপর আগ্রাসন চালায়। ১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধান সভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানান। উক্ত ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ এপ্রিল শিলচরে বাংলাভাষা-ভাষী বাঙালিরা এক নাগরিক সভা আহ্বান করেন। উক্ত সভা শেষে সরকারি ভাষা-প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথ।
তাছাড়া শিলচরে ২ ও ৩ জুলাই চপলাকান্তের সভাপতিত্বে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’ নামে ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানানো হয় এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাপার’ গান গেয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। এভাবেই বাংলা ভাষার স্বপক্ষে আসামে চলতে থাকে নানা কর্মসূচি। এতদসত্ত্বেও ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্যের সবর্ত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধান সভায় ভাষা বিল উত্থাপন ও পাস হয়। এভাবে আসামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লক্ষ লক্ষ বাঙালি এবং সেই সঙ্গে অনসমিয়া গোষ্ঠীর বাংলাকে সরকারি ভাষা করার মৌলিক অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করা হয়। এই আইনের প্রতিবাদে বাংলা ভাষার স্বপক্ষ শক্তি আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। বাংলা ভাষার দাবিতে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। এই আইনের প্রতিবাদে প-িত রাজমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল সম্মেলন। সম্মেলনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, “যদি এই আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা দেয়া না হয় তবে বাঙালি সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষার্থে আসামের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে।” পরে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে সরকারকে চরমপত্র দেয়া হয় এই ভাষায় : ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের ৩০ চৈত্রের মধ্যে ভাষা আইন যথাযথ সংশোধন করে বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদা যদি না দেয়া হয় তবে কাছাড়ের জনসাধারণ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ থেকে অহিংস গণ-আন্দোলনের সূচনা ঘটাবে। উল্লেখ্য, এই চরমপত্র প্রদানকারীরা তারিখ ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় খ্রিস্টাব্দের পরিবর্তে বঙ্গাব্দ ব্যবহার করেন। সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৬১ সালের ১৯ মে থেকে সমগ্র কাছাড়ে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবিতে অহিংস অসহযোগ গণ-আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২ টার পর থেকে প্রায় ১০ হাজার তরুণ-তরুণী বিভিন্ন বয়সের মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে।
অবশেষে আসে ১৯ মে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকারের বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দফায় লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে অনেক রেলকর্মচারীও। বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফ-এর সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শহীদ হন ৯ জন। তারা হলেন- সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটবিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষাশহীদদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জন।
১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ও ঘটনাবহুল। প্রশাসন এর কার্ফ্যু জারি করে, গ্রেফতার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের উপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা-আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধান সভায় স্বীকৃতি পায়।
ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯ মের ঘটনা একটি স্মরণীয় অধ্যায় হওয়া সত্ত্বেও আমরা অনেকেই এ ব্যাপারে বেখবর রয়ে গেছি। ২০০৩ সাল থেকে ভাষা-আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদ এই দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতি বছর ১৯ মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশে এরাই সর্বপ্রথম এই দিবসটিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১১ জন ভাষাশহীদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে আসছে। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতিসেবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নন্দিনী সাহিত্য পাঠচক্র, পূর্ণিমা সাহিত্য বাসর এবং ভাষা-আন্দোলন স্মৃতিরক্ষা পরিষদের আমন্ত্রণে প্রতিবছর বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিরাও ভারত সফর করেন। প্রতিবছর ১৯ মে ও ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় ভারত ও বাংলাদেশের আমন্ত্রিত অতিথিরা যোগ দেন। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে সকল প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে ১৯ মে ভাষা দিবস উপলক্ষে মত বিনিময় সভা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন: শিলচরে ভাষা-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক পরিতোষ পাল, বরুন চক্রবর্তী, জয়ন্ত বাদুড়ী, কবি দেবকন্যা সেন, রমা পাল, নির্মলকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, মনিষা ভট্টাচার্য, হরেন্দ্রনাথ জ্যোতিষশাস্ত্রী, দীপিকা মুখোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা দত্ত, শিখাদাস গুপ্ত, মুজিদ স্বদেশী প্রমুখ। ভাষা আন্দোলন স্মতিরক্ষা পরিষদের আহ্বানে ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় এবং দেশের বাহিরেও আসামের ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয়।
বাংলাদেশের অহংকার অমর একুশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সকল মাতৃভাষা প্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে অহংকার এবং গর্ব করে। এ গর্বের গর্বিত অংশীদার আসাম রাজ্যের ১১ জন ভাষাশহীদ। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের মতোই আসামের ভাষা-আন্দোলন ঘটনাবহুল ও ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি, আসামের ১৯ মে একই সূত্রে গাঁথা। ১৯ মে’র গুরুত্ব প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘১৯৬১ সালের ১৯ মে ভাষাশহীদদের বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষাশহীদদের মতো সম্মান জানাতে হবে। কেননা বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আসামের ভাষাশহীদদের অবদান খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।’
লেখক : রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের তথ্য সংগ্রাহক, গবেষক
নজরুল কেন জাতীয় কবি
সায়ীদ আবুবকর
বাংলা ভাষায়, এখনও পর্যন্ত, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চেয়ে বড় কবিÑজনপ্রিয়তা ও কবিত্বশক্তির দিক থেকেÑআবির্ভূত হননি একজনও, যদিও সুবিধেবাদী কিছু অধ্যাপক-সমালোচক এদের বিরুদ্ধে কথা বলে মাঠ গরম করতে চেয়েছেন বহুবার কিন্তু তাদের সে অপচেষ্টা হালে পানি পায়নি কখনও, এদেশের মানুষ তা ময়লা ত্যানার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। নজরুলের জীবদ্দশাতেই তার আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে লিলিপুট কবিরা শনিবারের চিঠি-তে একের পর এক আক্রমণ করে ঘায়েল করতে চেয়েছিল তাকে, কিন্তু ‘ম্যান-মাউন্টেন গালিভার সদৃশ নজরুলে’র পশমও ছিঁড়তে পারেনি তারা। রবীন্দ্রনাথের আকাশ থেকে বের হয়ে এসে স্বকীয় আলোয় জ্বলে ওঠা প্রথম বিদ্রোহী সূর্য ছিলেন নজরুল; তিরিশের কবিরা ছিলেন মূলত তারই মানস-সন্তান, তারই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপগ্রহ। এসব উপগ্রহের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দ দাশেরই আলো ছিলো চাঁদের মতো উজ্জ্বল ও কমনীয়। তিরিশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ছাড়া আর কাউকে নজরুল সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি। বুদ্ধদেব বসু নজরুলকে ‘মেধাবী বালক’ বলে এক চোট নিয়েছিলেন এক সময়। কারণটা যত না সাহিত্যিক, তার চেয়ে বেশি পারিবারিক। নজরুল-প্রতিভা বসুর সম্পর্কটাকে সহজভাবে তিনি মেনে নিতে পারেননি কখনোই। তার নিজেরই স্ত্রী তার চেয়ে নজরুলকেই বড় কবি মনে করতেন। এর শোধ তিনি নিয়েছেন নজরুলকে মেধাবী বালক বলে। তার কথা না বিশ্বাস করেছেন তার স্ত্রী, না বাঙালি জাতি। হাল আমলে এসে নজরুলের উপর বিরূপ মন্তব্য করে যিনি নিজেকে মহাপ-িত হিসেবে জাহির করতে চেয়েছিলেন, তিনি হুমায়ুন আজাদ। হাতি ঘোড়া গেল তল গাধা বলে কত জল! তার উক্তি কী ঔদ্ধত্য মূর্খতায় পরিপূর্ণ তা বুঝা যায় যখন তিনি বলেন: ‘বাঙালি মুসলমানের কাব্যচর্চা ছিলো স্বল্পশিক্ষিতের স্বভাবকবিত্বের সাধনা। বাঙালি মুসলমান পেয়েছিলো এক বড়ো প্রথাগত পদ্যকার নজরুল ইসলামকে, যাকে নিয়ে আজো তারা অন্ধ হয়ে আছে...’ বিশ্বসাহিত্য নিয়ে এই সার্টিফিকেটধারী ভদ্রলোকের যে তেমন কোনো লেখাপড়া ছিলো না, তা তার আরোপিত উক্তিই প্রমাণ করে। তার কী করে এ বিশ্বাস জন্মেছিল, বোধগম্য হয় না, যে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পারলেই কেউ বিশাল শিক্ষিত ও জ্ঞানী প-িত হয়ে যায়। হোমার কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, সফোক্লিস কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র? তার ভাষ্য অনুসারে তাহলে শেক্সপিয়ার যেহেতু স্বল্পশিক্ষিত ছিলেন সেহেতু তিনিও, নজরুলের মতোই, মহান কোনো কবি বা নাট্যকার হতে পারেন না। কিন্তু একথা গাড়লেও বোঝে যে, শেক্সপিয়ার এমন এক অমর কবি ও নাট্যকার, যে এমনি এমনিই জন্মে; কেমব্রিজ কি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কী সাধ্যÑশত বৎসরেও এরকম একটি মহীরুহ তৈরি করে! তদ্রƒপ নজরুল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এমনই এক মহীরুহ, কয়েক হাজার হুমায়ুন আজাদও যার ছোট্ট একটি ডালের সমান হবে না।
তবে এটা সৌভাগ্যের কথা যে, এদেশের আপামর জনসাধারণ এ শ্রেণির অর্বাচীন লোকদের কথায় কখনও কর্ণপাত করেনি; নজরুলকে তারা তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় বসিয়ে রেখেছে তার মূল্য বুঝেই। হুমায়ুন আজাদ এ মাটিরই সন্তান; বাঙালি জাতি কেন তার মতো স্বঘোষিত এত বড় একজন অধ্যাপক-প-িতকে নিয়ে নাচানাচি করে না? তিনিও তো একজন কবি; তবে জাতি কেন নজরুলের মতো প্রথাবদ্ধ পদ্যকারকে বাদ দিয়ে তাকেই জাতীয় কবি বানায় না? এখানেই প্রশ্ন উঠছে যে, তাহলে নজরুল কেন আমাদের জাতীয় কবি।
জাতীয় কবিই তো হলেন মূলত একটি জাতির ইমাম। নজরুল কৈশোরে মক্তবের ইমাম ছিলেন। ইমাম মানে নেতা। আর ইমাম তো তিনিই, যিনি মুক্তাদিরেকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিয়ে যান, তাদেরকে গাইড লাইন দেন, তাদের হৃদয় হরণ করেন, প্রার্থনার সময় চোখে জল ঝরিয়ে ছাড়েন। নজরুল যে বাঙালি জাতির দিক নির্দেশনাকারী তা তার কণ্ঠ শুনলেই বুঝা যায়:
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কা-ারি! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
বাঙালি এমন একটি জাতি, মুসলমান ও হিন্দুই যার প্রধান উপাদান। সুতরাং দেশ যখন দুর্যোগে নিপতিত, জাতি যখন বিপদগ্রস্ত, তখন শুধু হিন্দু কিংবা মুসলমানকে বাঁচালেই জাতি বাঁচবে না, জাতি বাঁচবে দুজন বাঁচলেই। এমন অসাম্প্রদায়িক, দেশদরদী, স্বজাতির হিতাকাক্সক্ষী কবি, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে শুধু কেন, বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ।
“প্রভাতী” কবিতাটি একটি অসাধারণ রূপকধর্মী কবিতা নজরুলের।
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ওই ডাকে
যুঁই-শাখে
ফুল-খুকি ছোট রে!
কবিতাটি একটি অমর চিত্রশিল্পের মতো, যেদিকে অর্থ করা হয় সেদিকেই সে ঝুলে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এটি শিশুদের ঘুম ভাঙানোর ছড়া। কিন্তু এর তাৎপর্য বড় গভীর। কবি খুকুকে জাগানোর নাম করে মূলত জাগাতে চাচ্ছেন পরাধীন দেশমাতৃকাকে। কিন্তু কবি কেন দেশকে মাতা না বলে খুকি বলে সম্বোধন করছেন? কবি খুকি বলছেন এই কারণে যে, তার দেশ যেন ছোট্ট শিশুর মতো ঘুমকাতুরে, পৃথিবীর সর্বত্র যখন আলোর ছড়াছড়ি তখনও তার ঘুম ভাঙছে না। কিন্তু তাকে যে জাগতেই হবে; কবিও আশাবাদী:
খুলি’ হাল
তুলি পাল
ঐ তরী চলল,
এইবার
এইবার
খুকু চোখ খুললো!
না, কবির ডাক বৃথা যায়নি; দেশ শেষ পর্যন্ত জেগেছে, স্বাধীনতার মধুর আলোয় স্নান করে সে নেমে পড়েছে ঠিকই পৃথিবীর অন্যান্য স্বাধীন জাতির সাথে উন্নতির প্রতিযোগিতায়।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার কোকিল মূলত নজরুল। পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার রক্তাক্ত রাস্তার দিকে উদাত্ত আহ্বান করে গেছেন তিনি সার্বক্ষণিক, তার জাতিকে। তাই তার কণ্ঠে বজ্রের মতো বেজে ওঠে এই গান:
কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল, র্ক রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী।
----------------------------
লাথি মার, ভাঙ রে তালা!
যত সব বন্দীশালায়
আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।
কবি নিজের জন্যে কখনও চিন্তিত নন, তার মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু স্বদেশের চিন্তা, মাতৃভূমির পরাধীনতায় তিনি ব্যাকুল, ক্ষুব্ধ, তাই তিনি বিদ্রোহী। নজরুল যেন কোরানে বর্ণিত সেই পিঁপড়ার মতো, যে-পিঁপড়াটি তার জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিল: ‘হে পিঁপড়াসকল, তোমরা গর্তের ভেতর প্রবেশ করো কারণ সোলাইমানের বাহিনী নামছে, তারা পায়ে পিষ্টে তোমাদের মেরে ফেলবে।’ পিঁপড়াটি তো নিজেই পালিয়ে গেলে পারতো, কিন্তু সে তা করলো না, বরং সে তার জাতির উদ্দেশ্যে হায়দরী হাঁক ছাড়লো। যে-কবি এক হাতে রণতূর্য আর এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরি নিয়ে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন, জাতিকে জাগানোর গান গাইতে গাইতে যিনি নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন চিরতরে, তিনি এ জাতির জাতীয় কবি হবেন না তো, কে হবে এই বাংলায়? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই, এ জাতির কর্ণধাররাও ভুল করেননি, জাতীয় কবি হিসেবে তারা ঘোষণা দিয়েছেন যার নাম, তিনি নজরুল।
নজরল ছিলেন বাঙালি জাতির জন্যে ডাক্তারের মতো এক নিষ্ঠুর দরদীপুরুষ। কসাই আর ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কসাইও কাটে, ডাক্তারও কাটে; কিন্তু দুজনের মধ্যে পার্থক্য হলো, কসাই মেরে ফেলতে চায় আর ডাক্তার বাঁচাতে চায়। হুমায়ুন আজাদরা ছিলেন এ জাতির আত্মঘাতী কসাই যেখানে নজরুল বাঙালি মুসলমানের দরদী মনোচিকিৎসক। নজরুল বাঙালি মুসলমানকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ও চাবুকের আঘাত মেরে মেরে নাস্তানাবুদ করেছেন কেবলি তাকে বাঁচানোর জন্যে। কারণ তিনি যে ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা, তিনি জানেন, আঘাত না করলে এ জাতি জাগবে না। তাই যখন তিনি তার বিখ্যাত ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’ কবিতায় এভাবে বলেন:
চার হাত মাটি খুঁড়িয়া কবরে
পুতিলে হবে না শাস্তি এর
পৃথিবী হইতে রসাতল পানে
ধরে দিক কেউ ছুঁড়ে এদের।
তখন বাঙালি ক্ষুব্ধ হয় না, বরং লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠার জন্যে প্রস্তুত হয় মনে মনে। একই সাথে তিনি কি মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক কবিও। তিনি যখন বলেন:
গাহি সাম্যের গানÑ
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
------------------------------------------
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
------------------------------------------
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।
তখন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বলে ওঠে সমস্বরে: ‘ইনিই তো নজরুল, আমাদের হৃদয়ের ফুল।’ এ ফুল ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাবেই যুগে যুগে অনাগত সব বাঙালির নাসিকায়, দেশ ছাড়িয়ে সমুদ্রপাড়ের সুদূর জনপদেও, সব মানুষের কাছে সমানভাবে, কারো তাতে ঈর্ষায় কলজে ফেটে গেলেও বা কি, না গেলেও বা কি।
লেখক : কবি, কলেজ অধ্যাপক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন