শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাস্থ্য

জন্মগত মেটাবলিক সমস্যা

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৮ এএম

জন্মগত মেটাবলিক সমস্যসমূহ ঃজন্মগত মেটাবলিক রোগসমূহ বংশগত ভাবেই বাহিত হয়। যাতে নবজাতক বা শিশুর দেহে এক বা একাধিক এনজাইমের ঘাটতি বা কাজের অস্বাভাবিকতার কারণে প্রোটিন সংশ্লেষ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফল:শ্রুতিতে কোন কোন দেহবর্জ ক্রমশ: দেহে জমা হতে থাকে কিন্তু এর পরবর্তী ধাপের উপাদানটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। একসময় ক্ষতিকারক উপাদানের পরিমাণ দেহে বাড়তে থাকে।

প্রধানত: জীনের মিউটেশন এর কারণে এ সমস্যাটি ঘটে। মিউটেশন জীনের একটি নির্দিষ্ট এনজাইমের নিয়ন্ত্রক অংশটিতে ঘটলে ঐ এনজাইম এবং তার কো-এনজাইম বা কো-ফ্যাক্টর কার্যকারীতা হারিয়ে ফেলে; তথ্য প্রবাহকারী প্রোটিন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সংবেদনশীল সিস্টেম এর কার্যকারীতা ব্যহত হয়।

পৃথিবীতে কমপক্ষে: তিনশত জন্মগত মেটাবলিক রোগ শনাক্ত হয়েছে। যাইহোক, দিনে দিনে আরো এ ধরণের নতুন রোগ শনাক্ত হচ্ছে। আবার এ দলভুক্ত অনেক রোগ শনাক্ত হওয়ার বাইরে আছে। বিভিন্ন দেশের প্রায় পাঁচ হাজার জীবিত শিশুর মাঝে একজন এ রোগে আক্রান্ত থাকতে পারে। তবে এ দলভুক্ত রোগগুলোর একেকটির প্রাবল্য একেক রকম। যেমন- ফ্যামিলিয়াল হাইপার কোলেষ্টেরোলেমিয়া প্রতি পাঁচশত জীবিত নবজাতকের একজনের মাঝে থাকতে পারে; ফিনাইল কিটোনরিয়া বার হাজারে একজনের থাকতে পারে; অর্গানিক এসিডোইউরিয়া পনের হাজারে এক জনের থাকতে পারে; গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ ষাট হাজারে এক জনের; গ্যালাকটোসেমিয়া পঁয়তাল্লিশ হাজারে একজনের; হমোসিস্টোনরিয়া এক লাখে একজন এবং ম্যাপলসিরাপ ইউরিন ডিজিজ দুই লক্ষ নব্বই হাজার নবজাতকের মাঝে এক জনের থাকতে পারে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এ রোগের প্রাদূর্ভাবের ভিন্নতাও রয়েছে। যেমন- ব্রাজিলের ১১,০০০ থেকে ১৫,০০০ শিশুর মাঝে ফিনাইল কিটোনরিয়া এবং ৪৩,০০০ শিশুর মাঝে ম্যাপলসিরাপ ইউরিন রোগটি থাকতে পারে। বাংলাদেশের নবজাতক-শিশুদের মাঝে এ রোগসমূহের প্রাবল্যের সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নাই।

এ জীনগত ত্রুটিসমূহ অটোসোমাল রিসেসিভ ট্রেইট হিসাবে পূর্ব পুরুষ হতে উত্তর পুরুষে বাহিত হয়। অর্থাৎ কোন এক জনের দেহে এ রোগ থাকলে পরবর্তী চারটি সন্তানের একজনের (২৫ শতাংশ) আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকবে। তবে এ দলভুক্ত কিছু রোগ এক্স-লিঙ্কড্ ; যেখানে মাতা বাহক, পুরুষদের ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক অথবা রোগাক্রান্ত। মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগগুলো যাদের আছে তাদের সবকটি (১০০%) সন্তানই এ রোগে আক্রান্ত হবে।

জন্মগত মেটাবলিক রোগসমূহকে দু’টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয় ঃ
ক্যাটাগরি ১ এর রোগসমূহে আক্রান্ত ব্যক্তির এনজাইম এর কার্যকারীতা ব্যাহত হয়। ক্যাটাগরি ২ এ দলভুক্ত রোগসমূহে মেটাবলিক পাথওয়ে আক্রান্ত হয়। ক্যাটাগরি ২ এর রোগসমূহকে আবার ১, ২, ৩ এ ভাবে ভাগ করা হয়।

এ রোগগুলোর শারীরিক লক্ষণ নবজানতক শিশু কোন কোন ক্ষেত্রে পরিনত বয়সেও দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট বিপাকীয় লক্ষণসমূহ দেখা দিতে পারে। যেমন, শিশুর খাদ্য গ্রহণে অনীহা, ঘন ঘন বমি হওয়া, পানি শুণ্যতা, খুব দূর্বল বোধ করা, মাংশপেশি থলথলে বা শক্তিহীন মনে হওয়া এবং খিঁচুনি। কোন কোন শিশুর শরীরে ইনফেকশনেও এ রকম দেখা দেয়। এ দলভুক্ত শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো জীবানু সংক্রমন। তবে কিছু কিছু শিশুর তীব্র শ্বাস কষ্ট হতেও দেখা যায়। কিছু কিছু নবজাতক এ রোগগুলোর লক্ষণ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। যদিও ভাল ভাবে লক্ষ্য না করলে তা শনাক্ত হতে সময় লাগতে পারে।
এ রোগগুলোকে শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে নবজাতকদের স্ক্রীনিং টেস্ট করার কোন বিকল্প নেই। এতে যাদের রোগ ধরা পড়বে তাদেরকে চিকিৎসা দিতে হবে এবং ভাল ফলাফল সেক্ষেত্রে আশা করা যেতে পারে। পরিণত বয়সে বা পরে কোন এক সময় এ রোগগুলো ধরা পড়লে চিকিৎসার পরও ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। অনেক ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত সন্তান ধারনকারিনী মার ও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- ফিনাইল কিটোনরিয়ায় আক্রান্ত মাকে সন্তান গর্ভে ধারণকারী সময়ে খাদ্যাভ্যাসে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়। গ্রাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ রোগীদের অসিদ্ধ ভ‚ট্রার শর্করা যথেষ্ট ভাল ফল পাওয়া যায়।

মেটাবলিক ত্রুটি সাপেক্ষে শৈশবে বা কৈশোরে রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া নির্ভর করে। যেমন-প্রোপাইওনিয়া এসিডেমিয়ায় আক্রান্ত বালকদের মাঝে মাঝেই ২-৩ দিন যাবৎ বমি হতে থাকে, যা খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকলেই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু এ রোগে আক্রান্ত পরিণত বয়সিদের হাত-পা কাঁপে এবং ক্রমশ: স্মৃতি শক্তি লোপ পেতে থাকে। যাদের ফ্রুকটোস জাতীয় খাদ্য হজমে এনজাইমের ত্রুটি থাকবে তারা ফ্রুকটোস জাতীয় খাবার খেলে মারাত্মক বিপাক জনিত সমস্যায় পড়বেন। এমনিয়া বিপাক জনিত সমস্যার রোগীরা সবচেয়ে মারাত্ম ভাবে আক্রান্ত হন এবং ঘন ঘন আইসিইউতে নিতে হতে পারে।

শৈশব বা কৈশোরে কিছু কিছু রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন- এলক্যাপটোনরিয়ায় আক্রান্তদের বড় বড় জয়েন্টগুলোতে ও মেরুদন্ডে ব্যথা শুরু হয় তৃতীয় বা চতুর্থ দশকে। হাইপোগ্লাাইসেমিয়া (রক্তে গ্লাকোজ বেশি কমে যাওয়া) পরে যে রোগগুলো সেগুলো সাধারণত শৈশবেই প্রতিভাত হয়। যে সব শিশু-কিশোর অল্প পরিশ্রমে কাতর হয়ে পড়ে, তাদেরও এ দলভুক্ত রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। উইলসনডিজিজ কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়সেই দেখা দেয়।

রোগ শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয়। যা রোগীর লক্ষণ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদির ভিত্তিতে নিরুপিত হয়। এ রোগগুলো অনেক সময়ই অগোচরে থেকে যায়। আর যখন তীব্র লক্ষণ দেখা দেয়, তখন রোগ শনাক্তকরণের চেষ্টা করা হয়। ইতোমধ্যেই হয়তো অনেকটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। তাই, সম্ভব হলে, প্রতিটি শিশুর জন্মগত মেটাবলিক রোগের স্ক্রীনিং করা উচিৎ। এ রোগগুলোর পরীক্ষা সমূহের মধ্যে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারো কারো আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে, সিটিস্ক্যান, এমআরআই ও বিশেষ জেনেটিক টেস্ট করা দরকার হতে পারে। টেস্টগুলো বিশেষ ধরণের হলেও বাংলাদেশেই এখন তা সম্ভব। এমনকি সন্তান মায়ের পেটে থাকা অবস্থাতেই স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করা যায়। যতদ্রুত রোগ শনাক্ত করা যাবে, চিকিৎসায় তত ভাল ফল আশা করা যেতে পারে।

জন্মগত মেটাবলিক রোগসমূহ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার বেশ ঘাটতি রয়েছে। যদিও রোগীর সংখ্যা খুব কম নাও হতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও অংশীদারিত্ব বাড়াবার উদ্দেশ্যে চিকিৎসক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সংস্থা সমূহের নীতিনির্ধারকগণ এবং অভিভাবকদের হাতে হাত মিলিয়ে এগোতে হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে।

ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যয়
Email:selimshahjada@gmail.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন