বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নিয়ন্ত্রণহীন রাজধানীর বায়ুদূষণ

০ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় অসহায় ০ ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

০ বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু

রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ দূষণের মূল কারণ হচ্ছে ইটভাটার ধোঁয়া এবং বিভিন্ন কল-কারখানা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও উন্নয়ন খোঁড়াখুঁড়ির ধূলিকণা। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নগরজুড়ে চলছে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাÐ। রাজধানীর অলিগলিতে পয়:নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনের কাজ চলছে। এ ছাড়া ড্রেন করে মাটির নিচ দিয়ে বৈদ্যুতিক তার সঞ্চালনের কাজও চলছে। এ সব কর্মকাÐের ফলে রাজধানীজুড়েই রাস্তার পাশেই দীর্ঘদিন ফেলে রাখা মাটি থেকে ধূলিকণা উড়ছে বাতাসে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ও এ ধূলিদূষণ নিয়ন্ত্রণে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. এস এম মঞ্জুরুল হান্নান বলেন, বায়ুদূষণের মাত্রা এত দুর্বিষহ হয়ে গেছে যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাই, মানুষকে পানির বোতলের সঙ্গে এখন অক্সিজেনের বোতল নিয়েও ঘুরতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় বলা হয়, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ গড়ে ২ লাখ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যান্সার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। বায়ুদূষণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শহরের বায়ু অত্যধিক দ‚ষিত হচ্ছে।
বাতাসে যেসব ধূলিকণা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারাত্মক হচ্ছে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা তার কম সাইজের ধূলিকণা এবং বাতাসের মাত্রাতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম, নিকেল ও সিসা। ঢাকা শহরের বাতাসে বর্তমানে সহনীয় মাত্রার প্রায় ২০০ গুণ বেশি রয়েছে ক্যাডমিয়াম। নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়ায় প্রায় ৩ গুণেরও বেশি। ইটভাটা থেকে নির্গত নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার-ডাইঅক্সাইড এবং বাতাসে ভাসমান পিএম ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটারের বালুকণার কারণে অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি সমস্যা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রেও সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়।
‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ঢাকার পরেই রয়েছে পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং। গত ২০ বছরের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশর রাজধানী ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বায়ু বা বাতাস। বায়ু ছাড়া প্রাণীজগত এক মুহ‚র্তও বাঁচতে পারে না। জীবন রক্ষার সে উপাদান দূষিত হয়ে আজ জীবনহানির অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে। বায়ুদূষণের অন্যতম কারন হল নিউক্লীয় আবর্জনা, কয়লা পুড়িয়ে ধোঁয়া ও গন্ধ বাতাসে মিশে বাতাস দূষিত হচ্ছে। দূষণের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হতে হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণা, ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে, নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত শহরের বাতাসে ক্ষতিকর ওই তিন উপাদানের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি থাকে।
বাংলাদেশে পরিবেশ সমীক্ষা-শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় হাজার খানেক ইটভাটা প্রতিবছরের নভেম্বর থেকে চালু হয়। সেগুলো এই বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। ঢাকা শহরে শুধু গাড়ির ধোঁয়া থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার ৭০০ টন সূ² বস্তুকণা প্রতিনিয়ত বাতাসে ছড়াচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নারী ও শিশুরা। চিকিৎসকরা বলছেন, সূ²কণার মাত্রা ২.৫ হলে তা ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করে আর মাত্রা ১০ হলে সেটি শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। বাতাসে এ সূ²কণার মাত্রা বাড়ার ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের সর্দি, কাশি, হাঁপানি, এলার্জি এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বেড়ে যাওয়াতে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। বাতাসে ভাসতে থাকা সিসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল খান বলেন, ভ‚মির ব্যবহারে সঠিক কোনো পরিকল্পনা নেই। বায়ুদূষণে সরকারের দায়বদ্ধতা ও ব্যর্থতা রয়েছে। শহরের পাশে বাফারের এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। ফলে, নগরবাসী দ‚ষণের শিকার হচ্ছে। বায়ু, ভ‚মি, মাটি এবং পরিবেশ রক্ষায় জোনিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ও বায়ুদূষণ বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মোট পরিমাণ চীন ও ভারতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবে বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে দ্রæত বায়ুদূষণ বাড়ছে, তার মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রায় এক যুগ ধরে ঢাকা ও বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করছেন। তার হিসাব অনুযায়ী মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। মূলত কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলায় এগুলো সৃষ্টি হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ড. আব্দুল মতিন বলেন, রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা হতাশাজনক। ঢাকার আশপাশে শত শত অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে এগুলো বন্ধে তারা কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে দু’একটিতে লোক দেখানো অভিযান চালালেও অনেকের অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এ সব ইটভাটা নির্বিঘেœ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পলিথিন, কালো ধোঁয়া বা ধূলিকণা এসবের ব্যাপারেও পরিবেশ অধিদপ্তর নিরব দর্শক।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন