বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

শাহাদাত আনসারী | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

নিরক্ষরতা দূর করে শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্ববোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছে। সবার জন্য শিক্ষা কর্মসুচি বাস্তবায়নের পর এখন সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এখন আধুনিকরুপে গড়ে তোলা হচ্ছে।

শিক্ষার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। আর শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হলে দেশের ভবিষ্যৎ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। কারণ দেশের পরিচালক তথা বড় বড় কর্তাগণের শিক্ষার মান ও যোগ্যতা তখন আশানুরুপ থাকে না। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাক্ষরতা হার ক্রমাগত বাড়ছে। এ বর্ধিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরণের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে আধুনিক করার জন্য শিক্ষদের জন্য আইসিটি ট্রেনিং এর মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তাঁরা বিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হচ্ছেন।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এর ১৭টি লক্ষ্যের অন্যতম লক্ষ্য- ‘সকলের জন্য নায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ’। বাংলাদেশ এ লক্ষ্যের সাথে একমত পোষণ করে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আবার অনেক প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণ নিসন্দেহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। আর এ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারবেন।

বর্তমানে শিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও প্রোজেক্টর এর মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান করা হচ্ছে। শিক্ষক ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায় প্রতি বছর বিজ্ঞপ্তির মাধমে মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি প্রইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এর ইনস্ট্রাক্টর ও পিটিআই অভ্যন্তরীণ পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ঘাটতি কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ নিশ্চয় টেকসই উন্নয়ন এর লক্ষ্য মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে। তবে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠান উপজেলা রিসোর্স সেন্টার এখনও জনবল ঘাটতিতে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে রিসোর্স সেন্টার আছে এবং এখানে একজন ইনস্ট্রাক্টর ও একজন সহকারি ইনস্ট্রাক্টর পদ রয়েছে। কিন্তু অধকাংশ সেন্টার একজন ইনস্ট্রাক্টর বা একজন সহকারি ইনস্ট্রাক্টর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রায় প্রত্যেক উপজেলা রিসোর্স সেন্টারে একজন করে অফিসার ঘাটতি। শিক্ষার মান উন্নয়নে অবশ্যই দ্রæত বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে এ ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান বৃদ্ধির জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং পিটিআই এর মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যালয় পরিদর্শন করলে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায় এবং পেশার প্রতি আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। এ জবাবদিহিতা ও পেশার প্রতি আন্তরিকতা মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে। আবার স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির মাধ্যমেও বিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ তাদের পেশার প্রতি দায়িত্বশীল ও কাজে যতœশীল হচ্ছেন। তবে বর্তমানে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি জন্য ইউনিয়নভিত্তিক বা এলাকাভিত্তিক বিশেষত পরিদর্শক থাকা প্রয়োজন। তাঁদের কাজ হবে শুধুই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে উর্ধ্বতন প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে প্রতিবেদন পেশ করা। এক্ষেত্রে শিক্ষায় বিশেষ ডিগ্রী যেমন- বিএড, ডিপিএড, সিএনএড ডিগ্রীধারীদের নিয়োগদানের মাধ্যমে পরিদর্শন ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করা যায়।

শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী পরিকল্পিত হওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে প্রত্যেক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক নামে একটি শ্রেণি আছে। এদের জন্য সরাসরি একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার এ ক্লাসের অভ্যন্তরীণ গঠন অন্য ক্লসের চেয়ে ভিন্ন। এ ক্লাসের শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। বিদ্যালয়ে শুধু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক থাকলেই হবে না এর সাথে অন্যান্য বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন যেমন- চারুকলা, সঙ্গীত, ক্রীড়া শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। আবার অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ শূন্য ছিলো। সহকারী শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) এর মাধ্যমে নন ক্যাডার পদ থেকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ফলে অবশ্যই এর অনেকটা সমাধান হয়েছে। আবার সিনিয়র শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এখনও অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রেখে শিক্ষার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য তথা মানসম্মত শিক্ষা অর্জন কঠিন হবে।

বর্তমানে শহরের বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনে কয়েকটা শিফট চালু আছে। এতে কর্মজীবী অভিভবকরা তদের সুবিধামতো শিশুকে স্কুলে পাঠাতে পারছেন। এতে একই স্কুলে দিনে অনেক শিশু শিক্ষালাভ করতে পারছে। আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বর্তমানে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি ভর্তি করতে হয়। বিশেষ করে গ্রামের বিদ্যালয়গুলোতে এটি বেশি। তাই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণের পরিবেশ থাকে না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিফট ব্যবস্থা চালু করা দরকার। এতে নতুন বিদ্যালয় তৈরি বা নতুন ভবন তৈরি না করে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব। এজন্য সাধারণ শিক্ষকের সাথে চারুকলা, সঙ্গীত, ক্রীড়া বিষয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।

প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়ার পর বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হিসেবে পিটিআই এর মাধ্যমে ১৮ মাস মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি ইডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে শিক্ষকের পেশাগত মনোভাব জোরদার হচ্ছে এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যেক পিটিআই এ একজন সুপারিনটেনডেন্ট ও একজন সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট ছাড়াও ১২জন ইনস্ট্রাক্টর (সাধারণ) ও ৪ জন বিষয়ভিত্তিক (কৃষি, বিজ্ঞান, চারকারু, শরীরচর্চা) ইনস্ট্রাক্টর পদ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ পিটিআই এ প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রাক্টর নাই। ফলে ইনস্ট্রাক্টরদের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া অনেকটা কঠিন হচ্ছে। এতে মানসম্মত শিক্ষার পরিকল্পনা দুরুহ হচ্ছে। তাই মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে ইনস্ট্রাক্টর ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিশুদেরকে আগামী দিনের স্বনির্ভর, সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেক বিদ্যালয়ে ক্ষুদে ডাক্তার আছে। আবার শিশুদের মধ্যে নেতৃত্ব চর্চার জন্য তাদের মধ্যে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে। আবার সপ্তাহের শেষদিন প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে অন্যান্য শিক্ষকসহ শিশুরা সামাজিক কাজ তথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ করে। এসব কিছু শিক্ষার মানকে বৃদ্ধি করবে। তবে তাৎক্ষণিক কোনো বিপদে পড়লে শিশুদের কী করণীয় হবে এ বিষয়ে অনেক বিদ্যালয়ে শেখানো হয় না। ফলে শিশুরা সহজেই অন্যের দ্বরা প্রতারিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের স্বাস্থ্য ও মেধাকে সবল করার জন্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এসব কর্মসূচি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অভিনয়ের ছলে শিখাতে হবে। তাহলে শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা নিজেকে বদলিয়ে সমাজ পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মোটা অঙ্কের বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। আবার ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এসকল পরিকল্পনা মানসম্মত শিক্ষার্জনে সহায়ক হবে। কিন্তু কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশের নিজস্ব প্রশস্ত খেলার মাঠ নাই। স্কুলের সামনে কোন বাগান নাই। ফলে শিশুরা শরীরচর্চা ও খেলাধুলা ছাড়া বেড়ে উঠছে। এতে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। আবার স্কুলের বাগান না থাকায় শিশুরা গাছ লাাগনো ও এর পরিচর্যা বিষয়ে শুধু পাঠ্যপুস্তক নির্ভর জ্ঞানার্জন করছে। বাস্তবে কীভাবে গাছ লাগাতে ও পরিচর্যা করতে হয় তা জানতে পারছে না। ফলে পরিবেশ বিষয়ে তারা যথেষ্ট সচেতন হতে পারছে না।

সকলের জন্য ন্যায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করতে হবে। বিদ্যালয়ে ও বাড়িতে তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু জিপিএ ৫ বা পাশের হার বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় সকল ঘাটতি পূরণ করে কোমলমতি শিশুকিশোরদের আদর্শ ও দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের সাথে সম্মুখে এগিয়ে যেতে পারবো এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারব।

লেখক: শিক্ষা গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন